ফিদেল অ্যালেজান্দ্রো ক্যাস্ট্রো রুজ; ছিলেন একাধারে কিউবান আইনজীবী, বিপ্লবী ও রাজনীতিবিদ। কিউবান বিপ্লবের কেন্দ্রীয় চরিত্র তিনি। কিউবান বিপ্লবের ফলাফল ছিল স্বৈরশাসক বাতিস্তার অপসারণের মাধ্যমে দেশে সাম্যবাদী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যা একইসাথে ছিল রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের মাধ্যম।
মানুষ ক্যাস্ট্রো একজনই ছিলেন। অথচ কিউবানদের মাঝে তাকে নিয়ে দেখা যায় সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মনোভাব। একদল ভাবেন ক্যাস্ট্রো ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ফ্রাংকেনস্টাইন যে কিউবাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে গেছে, অপর দল ভাবে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার করাল গ্রাস থেকে কিউবার উত্তরণ ঘটেছে স্রেফ ক্যাস্ট্রো ছিলেন বলেই। দশকের পর দশক যে মানুষটি বিশ্বের মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকে যাচ্ছেতাইভাবে কচুকাটা করে এসেছেন, তাকে যুক্তরাষ্ট্র বারবার হত্যা করার চেষ্টা করেছে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই।
জন্ম থেকেই ক্যাস্ট্রোর কপালে লেগে গিয়েছিল ‘অবৈধ সন্তান’ তকমাটি। বাবা অ্যাঞ্জেল ক্যাস্ট্রো নিরবচ্ছিন্নভাবে গৃহপরিচারিকা লিনা রুজ গঞ্জালেসের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক রেখেছিলেন। তাদের দুজনের একাধিক সন্তানের একজন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। কিছুকাল বাদে অ্যাঞ্জেলো তার বিবাহিত স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদের পর লিনাকে বিয়ে করেন। যদিও তাদের এই বিয়ে ফিদেলের পরিচয় থেকে ‘অবৈধ সন্তান’ অংশ মুছে দিতে পারেনি কোনোকালেই।
শৈশব থেকেই মেধাবী ক্যাস্ট্রো সিদ্ধান্ত নিলেন আইন বিষয়ে পড়াশোনা করবেন। ১৯৫৪ সালে ইউনিভার্সিটি অভ হাভানা ল স্কুলে ভর্তি হন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। সদস্য ছিলেন অর্থোডক্স পার্টির যারা সুনাম কুড়িয়েছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতি কমানোর জন্য।
একনজরে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর জীবন
- জন্ম: ১৩ আগস্ট ১৯২৬
- মৃত্যু: ২৫ নভেম্বর ২০১৬
- জন্মস্থান: বাইরান
- মৃত্যুস্থান: কিউবা
- রাজনৈতিক পদ, দায়িত্ব এবং মেয়াদ: কিউবান রাষ্ট্রপতি (১৯৭৬-২০০৮)
- কিউবান প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৯-১৯৭৬)
- রাজনৈতিক দল: কমিউনিস্ট পার্টি অভ কিউবা
- বিশেষ ভূমিকা: কিউবান রিভোলিউশন, বে অভ পিগস ইনভেশন, কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস
- প্রতিষ্ঠাতা: ২৬ জুলাই আন্দোলন
- উল্লেখযোগ্য পারিবারিক সদস্য: রাউল ক্যাস্ট্রো (ভাই)
- ধারণা করা হয়, অ্যামেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) ক্যাস্ট্রোকে তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালে সর্বমোট ৬৩৮ বার হত্যাচেষ্টা করে
- শুধু আর্থিক অসংগতি থাকায় জেস্যুট স্কুলে তার সতীর্থরা তার সাথে তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যবহার করত
- চিনি শিল্পের ক্ষতি হয় এবং চিনির উৎপাদনে ঘাটতি থাকে এই দাবী করে ক্যাস্ট্রো ১৯৬৯ সালে সরকারি ছুটি হিসেবে বড়দিনকে বাতিল ঘোষণা করেন
- ১৯৬১ সালের শেষ নাগাদ ক্যাস্ট্রো প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে স্বীকার করেন যে তিনি মার্কস-লেনিনপন্থী
ক্যাস্ট্রো, বিপ্লব, এবং কর্তৃত্ব
ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবী জীবন শুরু হয় ইউনিভার্সিটি অভ হাভানা, স্কুল অভ লতে শিক্ষার্থী থাকাকালেই। সে সময় তিনি ডমিনিকান রিপাবলিক এবং কম্বোডিয়ার চলমান বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫০ সালে কিউবান রাজনীতিতে তার প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ঘটে।
সেই বছর স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি সিদ্ধান্ত নেন এবার রাজনীতিতে মনোনিবেশ করবেন এবং ব্যাপক প্রস্তুতি ও প্রচারণা পর্ব শেষ করে অবশেষে ১৯৫২ সালে আইনসভায় যোগদানের জন্য নির্বাচনে অংশ নেন। যদিও সেই নির্বাচন শেষতক বাতিল হয়ে যায় বাতিস্তার জোরপূর্বক ও অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণের দরুন। কিউবান রাজনীতিতে এবার ক্যাস্ট্রোর সরাসরি আঘাত শুরু হলো। তিনি বাতিস্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের শুভ সূচনা করলেন। অবশ্য এসব আন্দোলনের প্রথমদিকের অধিকাংশই ব্যর্থ হয়। অবশেষে ক্যাস্ট্রোর গেরিলা বাহিনী প্রচণ্ড আগ্রাসী আক্রমণ চালায় একাধিকবার এবং তার সাথে ছিল বাতিস্তার বিরুদ্ধে প্রচারিত নানাবিধ প্রোপাগান্ডা। এসবের ফলাফল হিসেবে বাতিস্তা শেষ পর্যন্ত ১৯৫৯ সালে দেশত্যাগে বাধ্য হন। কিছুদিনের মাঝেই কিউবা পায় নতুন সরকার- কেন্দ্রে ছিলেন অবধারিতভাবেই ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
কিউবাকে পশ্চিম গোলার্ধের প্রথম সাম্যবাদী রাষ্ট্রে রূপ দেওয়ার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ক্যাস্ট্রোর। সুদীর্ঘ পাঁচ দশকের শাসনামলে তিনি একটি দেশকে আক্ষরিক অর্থেই আপাদমস্তক বদলে দেন। হ্যাঁ, এ কথা অনস্বীকার্য যে সাধিত পরিবর্তনসমূহের মাঝে কিছু ছিল সত্যিই উল্লেখযোগ্য, আর বাদবাকিগুলো ক্ষেত্রবিশেষে হিতে বিপরীত প্রমাণিত হয়।
ব্যক্তি থেকে শুরু করে জাতিগত পর্যায় পর্যন্ত কীভাবে বর্ণ বৈষম্যের মূলোৎপাটন করতে হয় তা ক্যাস্ট্রো দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। কিউবার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বিনা খরচে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা ছিল ক্যাস্ট্রোর গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মাঝে অসাধারণ এবং প্রশংসনীয়। তবে একটি সমাজের অন্যতম মৌলিক অধিকার, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন ক্যাস্ট্রো। একটি স্বাধীন ও স্বচ্ছ গণমাধ্যম ব্যবস্থাকে তিনি পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দেন। সরকারের যেকোনো ধরনের বিরোধিতা করা মাত্রই কারাবন্দী করা হত নাগরিকদের এবং এসবের মাধ্যমেই তিনি মূলত একদলীয় সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন।
ক্যাস্ট্রোর এই নীতি তাকে খুব সহজেই রাশিয়ার মিত্র দেশে পরিণত করে। বিপরীত দিক থেকে তাহলে ফলাফল কী ছিল? যুক্তরাষ্ট্র থেকে পুরোপুরিভাবে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, যেটি একবিংশ শতাব্দীতেও সমানভাবে কার্যকর। অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ক্যাস্ট্রো সুর নরম করতে বাধ্য হন। কিউবার অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তাকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে তুলনামূলক উদারপন্থী নীতি অনুসরণ করতে হয়।
১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন বুঝতে পারল যে গোপনে রাশিয়ান সরকার নিউক্লিয়ার মিসাইল তৈরির যজ্ঞ চালাচ্ছে, তখন আচমকা কিউবা বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রে চলে এলো। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সবাই ভেবেছিল, এবার বুঝি ক্যাস্ট্রোর গদি থেকে নেমে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। তবে সবাইকে অবাক করে ক্যাস্ট্রো যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও কিউবার শাসনের চূড়ায় অবস্থান করেন বহাল তবিয়তে।
২০০৬ সালে ক্যাস্ট্রো ঘোষণা করেন, তিনি সাময়িকভাবে তার ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। সে সময়ে তাকে পরিপাকতন্ত্রের অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বয়সের কারণে তার দেহে অস্ত্রোপচার পরবর্তী বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিলে আরও একাধিকবার তাকে চিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির নিচে যেতে হয়। ২০০৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ক্যাস্ট্রো আনুষ্ঠানিকভাবে কিউবার শাসনব্যবস্থা থেকে সরে দাঁড়াবার ঘোষণা দেন। রাউল ক্যাস্ট্রো ফিদেলের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ভার বুঝে নিলে যুক্তরাষ্ট্র আরও তেতে ওঠে। ভাইয়ের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে তাদের বক্তব্য ছিল- এতে শুধু পারিবারিক রাজনীতির পথই খোলাসা হবে এবং স্বৈরশাসন আরও জোরদার হবে।
২০১৪ সালে বারাক ওবামা কিউবা ভ্রমণে দেশটির সাথে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। বিগত ৯০ বছরের ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির সেটিই ছিল প্রথম কিউবা ভ্রমণ, যদিও ওবামা সেবার ক্যাস্ট্রোর সাথে সাক্ষাৎ করেননি।
২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর কিউবার সরকারি গণমাধ্যম থেকে ফিদেল ক্যাস্ট্রো মৃত্যুর ঘোষণা আসে। আইজেনহাওয়ার থেকে বারাক ওবামা- দীর্ঘ ১০ জন রাষ্ট্রপতি পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, আর এই পুরো সময় কিউবার নেতৃত্বে ছিলেন কেবল একজন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। রাশিয়া ছাড়াও ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ হুগো শাভেজের সাথে ছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক এবং বিশ্বসাহিত্যে জাদু বাস্তবতার প্রবাদপুরুষ হিসেবে খ্যাত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। মার্কেজের উপন্যাস ‘দি অটাম অভ দ্য প্যাট্রিয়ার্ক’ আংশিকভাবে ক্যাস্ট্রোকে ঘিরেই লেখা।