মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ রাষ্ট্রপ্রধান, ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একমাত্র এবং সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট। মার্ক্সিজম আর লেনিনইজমের অনুসারী এই রাষ্ট্রনায়ক স্থায়ীভাবে বদলে দেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি, স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি টানার পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার জন্যও দায়ী করা হয় তাকে।
নয় দশকের দীর্ঘ জীবন আর উত্থান-পতনের রাজনৈতিক জীবন কাটিয়ে মিখাইল গর্বাচেভ মৃত্যুবরণ করেছেন ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট। পশ্চিমা গণতন্ত্রকামীদের কাছে মিখাইল গর্বাচেভ যেমন নন্দিত হয়েছেন, সোভিয়েতপন্থী আর রাশিয়ান জাতীয়তাবাদীদের কাছে মিখাইল গর্বাচেভ নিন্দিত হয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার দায়ে। আলোচিত ও সমালোচিত এই রাজনৈতিক নেতার প্রয়াণে তার রাজনৈতিক লিগ্যাসি নিয়ে আলোচনা থাকছে পাঠকদের জন্য।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন
অক্টোবর বিপ্লবের পরে রাশিয়াতে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে যে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটি ছিল কর্তৃত্বপরায়ণ, রক্ষণশীল ও কঠোর। শাসনব্যবস্থা ছিল যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক অধিকার আর নাগরিক স্বাধীনতার বিপরীতে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করত উৎপাদনের প্রক্রিয়া, চাহিদা আর যোগানের সিদ্ধান্তও নিত রাষ্ট্র। সাথে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকা বিভিন্ন রিপাবলিকের মধ্যে বৈষম্য।
সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামো নাগরিকদের অর্থনৈতিক স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হচ্ছিল, রাজনৈতিকভাবেও তৈরি হয়েছিল এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির। সোভিয়েত শাসনব্যবস্থা ক্রমেই বৈধতা হারাচ্ছিল, কমছিল জনপ্রিয়তা। এমনই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেন মিখাইল গর্বাচেভ, চালু করেন গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রোইকা নীতি। তিনি সোভিয়েত শাসনব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছিলেন, কিন্তু এর ফলে ভেঙে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
রাশিয়াতে নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ শুরু হয়, শুরু হয় পুঁজিবাদী কাঠামোর বিস্তার। সোভিয়েত আমলের চেয়ে রাশিয়ানরা এখন বেশি রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার ভোগ করে, কিন্তু তারা নৈতিক বৈধতা দিচ্ছে কর্তৃত্ববাদী এক শাসককে। অর্থনীতিও রয়েছে অনেকটা কতিপয়তান্ত্রিক কাঠামোতে।
পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সহযোগিতামূলক নিরাপত্তা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর সোভিয়েত ইউনিয়ন একসাথে যুদ্ধ করলেও এর পর পরই শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। একপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব, আরেকপক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বিশ্ব। দুই বিশ্ব নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জিরো-সাম পলিসি অনুসরণ করেছে, বিভিন্ন স্থানে উভয়পক্ষই জড়িয়েছে প্রক্সি যুদ্ধে, হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, আর কিউবা সংকটের মতো ঘটনা।
মিখাইল গর্বাচেভ জিরো-সাম পলিসি থেকে দুই পক্ষের নিরাপত্তায় সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সূচনা করেন, ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি করেন মধ্যপাল্লার অস্ত্র সীমিত করার ব্যাপারে। একই বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাদের প্রত্যাহার করেন আফগানিস্তান থেকে। নিরাপত্তা সংক্রান্ত আরো বেশ কিছু চুক্তি হয় পশ্চিমা বিশ্বের সাথে, গড়ে ওঠে সহযোগিতার উষ্ণ সম্পর্ক।
মিখাইল গর্বাচেভের এই লিগ্যাসি সোভিয়েত ইউনিয়নের পরবর্তী যুগে খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পূর্ব ইউরোপে একের পর এক দেশ পুঁজিবাদী দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে, রঙিন বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে ভিড়েছে পশ্চিমা বিশ্বে। আধিপত্যের প্রতিযোগিতায় রাশিয়া আবারও পতিত হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন যুদ্ধফ্রন্টের পর ইউক্রেনে করতে হচ্ছে সরাসরি যুদ্ধ। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি।
পূর্ব ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ হারানো
১৯০৪ সালে স্যার হালফর্ড ম্যাকাইন্ডার প্রদান করেন তার বিখ্যাত ‘হার্টল্যান্ড থিওরি’, তার ‘দ্য জিওগ্রাফিকাল পাইভট অব হিস্টরি’ পেপারে। ম্যাকাইন্ডারের হ্যার্টল্যান্ড থিওরি অনুসারে, যে ইস্টার্ন ইউরোপ নিয়ন্ত্রণ করে, সে হার্টল্যান্ড শাসন করে। যে হার্টল্যান্ড শাসন করে, সে ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেয়। যে ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেয়, সে পুরো পৃথিবীই শাসন করতে পারে। হার্টল্যান্ড থিওরিতে ‘Pivot Area’ হচ্ছে ইউরেশিয়া, ইউরোপ, আর এশিয়া হচ্ছে ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ড।
সোভিয়েত ইউনিয়ন স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পুরো ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেছে, মিখাইল গর্বাচেভের নীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় সেখানে এখন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য। রাশিয়াকে হাজার কিলোমিটার সীমান্ত ভাগাভাগি করতে হচ্ছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সাথে, প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। ভ্লাদিমির পুতিনের মতো রাশিয়ান জাতীয়তাবাদীদের কাছে মিখাইল গর্বাচেভ তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার বিপর্যয়কর ঘটনার অনুঘটক।
মিখাইল গর্বাচেভের অবস্থান
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার কৃতিত্ব গণতন্ত্রপন্থীরা মিখাইল গর্বাচেভকে দিলেও, গর্বাচেভ কোনোদিনই চাননি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাক। অবসরজীবনে নির্ভৃতে তিনি সময় কাটিয়েছে সোভিয়েত আমলের গান শুনে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ে রচিত গান শুনে।