মানুষে মানুষে সংঘাত অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে হয়। দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় অর্থনৈতিক স্বার্থকে সামনে রেখেও। সভ্যতার শুরু থেকেই তাই মানুষ সম্পদের উপর কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন সংঘাতে জড়িয়েছে, একইভাবে সংঘাতে জড়িয়েছে রাজনৈতিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, ধর্মীয় আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। অর্থনৈতিক স্বার্থ আর রাজনৈতিক আদর্শকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে মতভিন্নতা বর্তমান সময়েও দেখা যায়, রাজনৈতিক আদর্শগুলোকে ক্রমাগত বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিকি বিতর্ক হয়, কখনো কখনো সেই বিতর্ক সংঘাতের রূপ নেয়।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনতান্ত্রিক মতবাদ হচ্ছে গণতন্ত্র। গত এক শতাব্দী ধরেই গণতান্ত্রিক বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণতন্ত্র মানবসভ্যতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনতান্ত্রিক মতবাদ হিসেবে পৃথিবীর সব প্রান্তে পৌঁছেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই। বার্লিন দেয়ালের পতনের সময়ই নিশ্চিত হয়ে যায় গত শতাব্দীতে গণতন্ত্র ও কমিনিজমে নিয়ে চলা দুই ঘরানার রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে চলা স্নায়ুযুদ্ধের ফলাফল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে সেই পতনের অবশিষ্ট আনুষ্ঠানিকতাই কেবল সম্পন্ন হয়।
গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সাধারণত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো বিরাজ করে। কারণ, এর মাধ্যমে নাগরিকদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সহজ হয়, নাগরিকেরা নিজেদের ইচ্ছামতো জীবিকা পছন্দ করতে পারেন। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জন ও সম্পদ নিজের মালিকানায় রাখার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়, নাগরিকদের নতুন নতুন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একজন নাগরিক মুনাফা অর্জন করতে পারেন, সেই মুনাফাকে কাজে লাগিয়ে নিজের সম্পদকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে পারেন। পুরো প্রক্রিয়াটি জুড়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকে খুবই সামান্য, চাহিদা ও যোগানকেন্দ্রিক বাজারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারের হস্তক্ষেপও থাকে খুবই সীমিত।
গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্ব দানকারী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মডেলও তাই পুঁজিবাদী। রাষ্ট্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খুব কম সময়ই হস্তক্ষেপ করে, নাগরিকদেরও রয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার স্বাধীনতা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক নাগরিক অধিকারের খাতগুলোও রয়েছে বেসরকারি খাতে, রাষ্ট্রের মালিকানাধীন কোনো বড় শিল্প কারখানা নেই। এ রকম পুঁজিবাদী একটি দেশেই উত্থান ঘটেছে বার্নি স্যান্ডার্সের মতো রাজনীতিবিদের, যিনি প্রকাশ্যে নিজেদের ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট হিসেবে পরিচয় দেন।
রাজনৈতিকভাবে এই পরিচয়টি দেওয়া খুব একটা সহজ না। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ বলছে, ২২ শতাংশ আমেরিকান এখনো সমাজতন্ত্রকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ এবং অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করেন , এদের বড় একটা অংশই সোশালিজম বেং ডেমোক্রেটিক সোশালিজমের মধ্যে পার্থক্য জানে না। বার্নি স্যান্ডার্সের রাজনৈতিক আদর্শকে ব্যবহার করে গত দুই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান ক্রমাগত ডেমোক্রেটদের সমাজতন্ত্রী হিসেবে রাজনৈতিক ব্লেইম দিয়েছে, রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি ভয়ে থাকা ভোটারদের নিজেদের দিকে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেছে।
পুঁজিবাদ, কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্র
গত শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত দুইটি অর্থনৈতিক মডেল ছিল পুঁজিবাদ ও কমিউনিজম। কমিউনিস্ট অর্থনৈতিক মডেলে সম্পদের মালিকানা থাকে রাষ্ট্রের হাতে, রাষ্ট্র কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে দেশের অর্থনীতিকে। রাষ্ট্র কৃষকদের কোন পণ্য উৎপাদন করতে হবে তা নির্ধারণ করে দেয়, বাজারে কোনো পণ্যের চাহিদাও সাধারণত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। যেকোনো পণ্যের চাহিদার ব্যাপারে সকল তথ্য পুঞ্জিভূত থাকে রাষ্ট্রের কাছে, যোগানের তথ্যও থাকে রাষ্ট্রের কাছেই। রাষ্ট্র তাই স্বাভাবিকভাবেই সর্বাত্মকবাদী হয়ে ওঠে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্য তৈরির একটা কমিউনিস্ট অর্থনৈতিক কাঠামোতে থাকে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকারগুলো নাগরিকেরা সাধারণত বিনামূল্যে একই ধরনের অবকাঠামো থেকে উপভোগ করেন।
অন্যদিকে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে বাজারের মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে থাকে না, বাজার পরিচালিত হয় মুনাফাকে কেন্দ্র করে। রাষ্ট্রের হাতে তথ্যের স্বল্পতা থাকে বাজারের ব্যাপারে, রাষ্ট্রও বাজারে সম্ভাব্য সবচেয়ে কম হস্তক্ষেপ করে। বাজারের গতিশীলতা নির্ধারিত হয় কোনো পণ্যের চাহিদা এবং যোগানের মাধ্যমে। বাজার হয় মুক্ত, বাজারে একই পণ্যের অনেক উৎপাদক ক্রিয়াশীল থাকে, বাজার হয়ে উঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।
অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে সমাজতন্ত্রের অবস্থান কমিউনিজম এবং গণতন্ত্রের মাঝামাঝিতে। কমিউনিজমে যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী রাষ্ট্র সম্পদের বরাদ্দ দেয় নাগরিকদের, সমাজতন্ত্রে সেখানে সম্পদের বরাদ্দ দেওয়া হয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান অনুযায়ী। সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে ব্যক্তি সম্পদের মালিক হতে পারে, কিন্তু সকল শিল্প আর উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হয় কমিউন দ্বারা, যেটি যেকোনো ধরনের সরকারের অধীনে কাজ করতে পারবে। অর্থাৎ, কমিউনিজমে সর্বাত্মকবাদী কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় থাকলেও, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেল গণতান্ত্রিক সরকার, স্বৈরতান্ত্রিক সরকার বা অভিজাততন্ত্রের অধীনে কার্যকর করা সম্ভব। তবে, সমাজতন্ত্রে কমিউনিজমের মতোই শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক খাতগুলো থাকে রাষ্ট্রের অধীনে।
ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম কী?
তাত্ত্বিকভাবে, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজমের অবস্থান আবার সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের মাঝামাঝি। সমাজতন্ত্র যেকোনো সরকারের অধীনে কাজ করতে পারলেও, যেকোনো এই অর্থনৈতিক কাঠামোতেও বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকে রাষ্ট্রের হাতে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকে, তাই রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে কার্যকর করা যায়। রাষ্ট্র বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে না, শিল্প কল-কারখানার জাতীয়করণ করে না।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর ব্যক্তির স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়, অধিকাংশ পণ্যের দামই বাজারে চাহিদা এবং যোগানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। অর্থনৈতিক সাম্যের চেয়ে ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজমের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সুযোগের সমতা তৈরি করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজমের মডেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক খাতগুলোকে রাষ্ট্রের অধীনে রাখা হয়। ধনীদের উপর উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়, কর রাজস্বের বড় অংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় না করে ব্যয় করা হয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক খাতগুলোতে।
বার্নি স্যান্ডার্সের ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম
আমেরিকান রাজনীতিতে বর্তমানে অন্যতম জনপ্রিয় একটি নাম বার্নি স্যান্ডার্স। ভারমন্টের এই স্বাধীন সিনেটর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সিনেটের বাজেট কমিটির, ২০১৬ ও ২০২০ সালের প্রেডিসেন্সিয়াল ইলেকশনে ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই তার ক্যাম্পেইন সংগ্রহ করে ১.৫ মিলিয়ন ডলারের ফান্ড, ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্যাম্পেইন শুরুর প্রথম ২৪ ঘন্টায় সেই আয় ছাড়িয়ে যায় ৬ মিলিয়ন ডলারকে। তবে, আমেরিকার রাজনীতিতে বার্নি স্যান্ডার্সের আলাদা পরিচয় তৈরি হয়েছে তার অর্থনৈতিক আদর্শের মাধ্যমে, যেটি পরবর্তীতে বার্নি স্যান্ডার্সকে এনে দিয়েছে পৃথিবীব্যাপী পরিচয়।
বার্নি স্যান্ডার্সের অর্থনৈতিক সংস্কারের পাঁচটি মূল স্তম্ভ রয়েছে, যেগুলো একদিকে তাকে তরুণদের মধ্যে অনেক বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে, আবার করে তুলেছে রিপাবলিকানদের প্রিয় প্রতিপক্ষ।
প্রথমত, বার্নি স্যান্ডার্স শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ানোর পক্ষে দাবি তুলছেন। এর মাধ্যমে সিনেটর স্যান্ডার্স আসলে বিভিন্ন শিল্প কারখানার মালিকদের যে আয়, তাতে শ্রমিকদের অংশ বাড়াতে চাচ্ছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ঘণ্টায় সর্বনিম্ন মজুরি ৭.৫ ডলার, যেটি বার্নি স্যান্ডার্স বাড়িয়ে ১৫ ডলার করার পক্ষে জনমত গড়ে তুলছেন।
দ্বিতীয়ত, সুযোগের সমতা তৈরি করা ডেমোক্রেট সোশ্যালিস্টদের অন্যতম দাবি এবং প্রস্তাবনা। সুযোগের সমতা তৈরি করতে বার্নি স্যান্ডার্সের দাবি হচ্ছে স্কুল এবং কলেজগুলোকে বিনামূল্যে করে দেওয়া, মেধার ভিত্তিতে সকল আমেরিকানকে সেখানে প্রবেশাধিকার দেওয়া।
তৃতীয়ত, বার্নি স্যান্ডার্স একজন প্রথাগত ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টের মতোই স্বাস্থ্যসেবাকে সকলের জন্য বিনামূল্যে করে দেওয়ার দাবি তুলছেন। এই ধরনের স্বাস্থ্যকাঠামো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশ কানাডাতে রয়েছে, রয়েছে স্ক্যান্ডানেভিয়ান দেশগুলোতে।
চতুর্থত, ধ্রুপদী সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের মতো বার্নি স্যান্ডার্সও শিল্পের যেকোনো ধরনের জাতীয়করণের বিরোধিতা করেন, বাজারের উপর রাষ্ট্রের স্থায়ী নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেন।
পঞ্চমত, বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের যে ট্যাক্স কাঠামো রয়েছে, তাতে অতিধনী ব্যবসায়ী এবং নাগরিকদের বিনিয়োগসহ অন্যান্য উপায়ে কর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। ফলে, চতুর ব্যবসায়ী বিভিন্ন আইনি ধারাকে ব্যবহার করে অনেক সময়ই ফেডারেল কর এড়িয়ে যান। বার্নি স্যান্ডার্স এই অবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন করে ধনিদের উপর করের হার বাড়াতে চান।
ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজমের ভবিষ্যৎ
বার্নি স্যান্ডার্স তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে দীর্ঘ সময় প্রতিনিধিত্ব করে বর্তমানে ভারমন্টের সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার উচ্চকক্ষে। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে স্যান্ডার্স ছিলেন তুমুল আলোচনাতে। স্যান্ডার্সের বয়স প্রায় আশি ছুঁইছুঁই, রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের যতি টানার কাছাকাছি সময়ে চলে এসেছেন তিনি। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বার্নি স্যান্ডার্সের সবচেয়ে বড় সফলতা, তিনি তার রাজনৈতিক আদর্শকে ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন, ডেমোক্রেটিক পার্টিতে উঠে এসেছে এজিলাবেথ ওয়ারেন, আলেকজান্দ্রো ওকাজিও কর্তেজের মতো ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট। এরা দীর্ঘমেয়াদে বার্নি স্যান্ডার্সের রাজনৈতিক মতাদর্শকে বহন করে যাবেন।