যুক্ত্ররাষ্ট্র-তালেবান শান্তি চুক্তি: আফগানিস্তানে আসলেই শান্তি আসবে কি?

ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা আফগানিস্তান বারবার বৈদেশিক পরাশক্তিগুলোর প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছে। সর্বশেষ জহির শাহের পতনের পর রক্ষণশীল ঘরানার দেশটিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, উদ্দেশ্য ছিলো কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা।

সোভিয়েতরা চলে যাওয়ার পরও আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসেনি। গোত্রভিত্তিক আফগান রাজনীতিতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর মুজাহিদদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ক্ষমতায় নিয়ে আসে তালেবানদের। কঠোর রক্ষণশীল ইসলামি ভাবধারার এ দলটির সময়েই আফগানিস্তান সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের ক্ষেত্র হিসেবে বৈশ্বিক মনোযোগে আসে। নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অংশ হিসেবে আফগানিস্তানে শুরু হয় ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’। বিমান হামলা আর স্থল আক্রমণে তালেবানরা ক্ষমতাচ্যুত হয়, নিয়ন্ত্রণ হারায় রাজধানী কাবুলের।

অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম ; Imagr Source : idsb.tmgrp.com
অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম; Image Source: idsb.tmgrp.com

এরপর কেটেছে প্রায় দুই দশক। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও পরাজিত করতে পারেনি তালেবানদের, স্তিমিত করতে পারেনি তাদের প্রভাব। ৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচের এ যুদ্ধে বিদেশী সেনা প্রাণ হারিয়েছে ৩,৫০০ জন, যার দুই-তৃতীয়াংশই যুক্তরাষ্ট্রের। এর সাথে প্রাণ গেছে অগণিত আফগানের। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। ফলে বিপুল সংখ্যক আফগান রয়েছে দারিদ্র্যসীমার নীচে, বিশ্বায়নের এই যুগেও জনগণের একটা ক্ষুদ্র অংশই পাচ্ছে আধুনিক সুবিধা।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলোর মতো আফগানিস্তানের যুদ্ধ জাতীয় স্বার্থ বহন করেনি। তালেবানদের কাছে একের পরে এক কৌশলে পরাস্ত হয়েছে মার্কিনীরা, ব্যর্থ হয়েছে রণকৌশল। কয়েকটি কারণে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সফল হয়নি।

প্রথমত, তালেবানরা শুরু থেকেই সাংগঠনিকভাবে জনসম্পৃক্ত একটি দল। রক্ষণশীল ইসলামি সংস্কৃতি অনুসরণের ব্যাপারে তাদের নিয়ে সমালোচনা আছে, কিন্তু সত্যটা হলো, এই রক্ষণশীলতা আফগান জনগণের একটি বৃহৎ অংশ ধারণ করে, সমর্থন করে তালেবানদের আদর্শকে। এই বিপুল জনসমর্থন তালেবানদের দীর্ঘ দুই দশক টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।

Taliban warriors
যুদ্ধক্ষেত্রে তালেবানরা; Image Source : Vox

দ্বিতীয়ত, আমেরিকা ইরাকে ব্যবহৃত কৌশল দিয়েই আফগানিস্তানে সফলতা চেয়েছে। কিন্তু আফগান রাজনীতির অভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলোর আচরণ ইরাক থেকে বেশ আলাদা এবং ইরাকে যেমন সাদ্দাম বিরোধীদের এক ছাতার নিচে আনা গিয়েছিলো, আফগানিস্তানে এরকম বড় মার্জিনের একত্রীকরণ কখনোই সম্ভব হয়নি।

তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত আফগান সরকার অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সরকার কাঠামোকে জনগণের গ্রহণযোগ্য কাঠামোতে কখনোই নিতে পারেনি। জনগণের কাছে হামিদ কারজাই বা আশরাফ ঘানির সরকার মার্কিন সরকারের পুতুল হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। ফলে মানুষের সমর্থন তালেবানদের দিকেই গিয়েছে।

চতুর্থত, রাজস্ব, মাদক ব্যবসা, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাত থেকে আয় তালেবানদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে শক্তিশালী করেছে এবং এই দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।

পঞ্চমত, আফগানিস্তানে তালেবানদের যাত্রা শুরু থেকে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ট্রেনিং এবং সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করেছে, গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের পাকিস্তানে আশ্রয়ের সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি তুরস্ক, রাশিয়ার মতো দেশগুলো অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে তালেবানদের টিকে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

শান্তিচুক্তি

দীর্ঘ দুই দশকের ফলাফলহীন যুদ্ধের পর হাত গুটিয়ে নিতে চাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরই ফলাফল ২০১৮ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া শান্তি আলোচনা। আট রাউন্ডের শান্তি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন জালমে খলিলজাদ, তালেবানদের মোল্লা আব্দুল ঘানি ও শেখ মোহাম্মদ আব্বাস। বেশ কয়েক দফা ভেস্তে যাওয়ার পর দীর্ঘ আলোচনা শেষে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির চারটি মূলস্তম্ভ রয়েছে।

peace deal
তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র শান্তিচুক্তি; Image Source : ABC News

প্রথমত, ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে কোনো বিদেশী সেনার উপস্থিতি থাকবে না। আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী হবে আফগান সরকারি বাহিনী, তারাই নিশ্চিত করবে জনগণের নিরাপত্তা।

দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সেনারা আগামী ১৪ মাসে পর্যায়ক্রমে আফগানিস্তান ত্যাগ করবে।

তৃতীয়ত, আফগানিস্তানে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংলাপ হবে। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গোত্র আর রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরি করবে আলোচনার টেবিল।

চতুর্থত, সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। তালেবানরা কোনো সামরিক বা বেসামরিক স্থাপনায় এই সময়ে হামলা চালাবে না, সংযমে থাকবে আমেরিকাও। এর উপর শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।

শান্তি আসলেই আসবে কি?

যুক্তরাষ্ট্র-তালেবানদের মধ্যে হওয়া শান্তিচুক্তি যথাযথভাবে কার্যকর যদি হয়ও, তবুও অভ্যন্তরীণ শান্তির জন্য আফগানিস্তানকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, মোকাবেলা করতে হবে অনেকগুলো অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

প্রথমত, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামোতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিচারব্যবস্থা, নারী স্বাধীনতাসহ বেশ কিছু ইস্যুতে সমাধানে আসতে হবে তালেবান এবং যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত আফগান সরকারকে। আদর্শগত পার্থক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পরে আফগান সরকার এবং তালেবানরা রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে আলোচনায় মুখোমুখি অবস্থানে থাকবে, বাধাগ্রস্ত করবে শান্তি প্রক্রিয়া।

দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গোত্রপ্রধানদের যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমনি তাদের মধ্যে রয়েছে সীমাহীন কোন্দল। অভ্যন্তরীণ বা জাতীয় কোনো ইস্যুতে ঐক্যমতে আসা গোত্রপ্রধানদের রাজনীতিতে বিরল ঘটনা। এই অভ্যন্তরীণ প্রভাবক শান্তি প্রক্রিয়ার অন্যতম বাধা।

afg Parliament
লয়া জিরগা, আফগানিস্তানের আইনসভা; Image Source : W. Commons 

তৃতীয়ত, আফগানিস্তানে তালেবানরাই একমাত্র সশস্ত্র সংগঠন নয়। হাক্কানি নেটওয়ার্ক, আল-কায়েদার পাশাপাশি আফগানিস্তানে রয়েছে আইএস এর উপস্থিতি। শুধু তালেবানদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিচুক্তি বাকি শক্তিগুলোকে নিষ্ক্রিয় করবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি তাদের শক্তি বিস্তারের নতুন ক্ষেত্র  তৈরি করবে।

চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পরে ক্ষমতার একটি শূন্যতা তৈরি হবে। পরাশক্তিগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে ইরান, চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান চাইবে আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাবের বলয় তৈরি করতে। অদক্ষ আফগান প্রশাসনের জন্য সেটা দৃশ্যত সহজ প্রক্রিয়া হবে না। শান্তি আনয়নে এটিও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।

পঞ্চমত, আফগানিস্তানে সোনা, লিথিয়াম, কপার, স্ক্যান্ডিয়ামসহ বেশ কয়েকটি খনিজের বিপুল মজুদ আছে। অবধারিতভাবেই পুজিবাদী দেশগুলোর নজর থাকবে এই খনিজগুলোর দিকে। আফগানিস্তানের মতো দরিদ্র দেশে খনিজের উপস্থিতি মানেই দুর্নীতি, ফলাফল  জন-অসন্তোষ আর স্বার্থের সংঘাত।

ষষ্ঠত, আফগানিস্তানের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ এখনো সশস্ত্র। আফগানিস্তানে আইএস শক্তি সঞ্চয় করছে, বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে সশস্ত্র ছোট ছোট গ্রুপ, গোত্রগুলোর কাছেও আছে অস্ত্রের বিপুল মজুদ। ফলে ভবিষ্যত রাজনীতি সংঘাতের দিকে মোড় নেওয়াটা অসম্ভব কিছু না। 

armed group
আফগানিস্তানে ক্রিয়াশীল সশস্ত্র গ্রুপ হুমকি হতে পারে শান্তি প্রক্রিয়ায়; Image Source : The NEw York Times

সপ্তমত, তালেবানদের মতো কিছু দল যেভাবে নিজেদের স্বাধিকারের জন্য লড়াই করেছে, তেমনিভাবেই হামিদ কারজাই, আশরাফ ঘানির মতো অনেকে পরাশক্তির কাছে দেশকে সমর্পণ করে ক্ষমতায় এসেছে। ভবিষ্যতে এই দুই শ্রেণীর দ্বন্দ্ব শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।

অষ্টমত, আফগানিস্তানের পাশ্ববর্তী তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তানে নতুন করে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হবে এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করতে পারে।

শান্তির সন্ধানে আফগানিস্তান 

পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আফগানিস্তানের যুদ্ধ ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনেনি। আমেরিকানরা এই অন্তহীন যুদ্ধের সমাপ্তি খুঁজছে, খুঁজছে গ্রহণযোগ্য বিকল্পের, মুক্তি খুঁজছে বিপুল অর্থ ব্যয়ের হাত থেকেও। সর্বশেষ শান্তিচুক্তি অনেকের দৃষ্টিতে পরাজিত যুক্তরাষ্ট্রের সম্মানজনক বিদায়ের চেষ্টামাত্র। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তালেবানের মতো সংগঠনের সাথে চুক্তিতে প্রভাবিত করেছে, রয়েছে নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার তাগিদও।

us fm
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পাম্পেও; Image Source : military.com 

অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মারপ্যাঁচ, দ্বন্দ্ব, দুর্বল গণতান্ত্রিক কাঠামো আর বৈশ্বিক পরাশক্তিদের প্রভাব আরো বহুদিন প্রভাবিত করবে আফগানিস্তানকে। ফলে আফগানিস্তানে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামাজিক সমস্যার প্রতি সংবেদনশীলতা, স্থিতিশীলতার পরিবেশ আসতে দীর্ঘদিন সময় লাগবে; শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে লাগবে বহুদিন, লাগবে নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব।

This article is written in Bangla about US-Taliban peace deal and future peace process . 

All necessary links are hyperlinked inside . 

Feature Image : Static Bangkok Post

.

Related Articles

Exit mobile version