সাম্রাজ্যবাদ শব্দটির সাথে পরিচয় থাকলে ‘সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দযুগলের সাথেও পরিচয় থাকার কথা। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ নতুন কোনো তত্ত্ব নয়। এই তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে মধ্যযুগে। তবে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের উদাহরণ মেলে প্রাচীনকালেও। সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ বলতে বোঝায় কোনো দেশের সংস্কৃতির প্রভাব অন্য কোনো দেশের উপর বিস্তার করা। বৃহৎ পরিসরে বললে, খর্ব শক্তির কোনো দেশের উপর নিজেদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে সে দেশের উপর মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করাই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ।
যখন ব্রিটিশদের প্রভাব-প্রতিপ্রত্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল, তখন পুরো বিশ্ব জুড়ে তারা তাদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে সে অবস্থানটি দখল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রাচীনকালে গ্রিক আর রোমানরা একই কাজ করেছে। তর্কসাপেক্ষে, বর্তমান বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতি পুরো বিশ্বে কতটা প্রভাবশালী তা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। তাছাড়া ছোট পরিসরে ভারত আর চীনের মতো দেশগুলোও আঞ্চলিকভাবে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করে চলেছে।
সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টির পেছনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ধরনের নিয়ামক কাজ করে। দেশের সীমার বাইরে পণ্যের বাজার ধরা, প্রচারণার মাধ্যমে জনমত নিয়ন্ত্রণ করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই সাম্রাজ্যবাদীদের মূল লক্ষ্য। একদিকে বিনোদন রপ্তানি করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের মুনাফা, অন্যদিকে নিজেদের সাংস্কৃতিক উপনিবেশের অধিবাসীদের স্বকীয়তা ও প্রথাগত ঐতিহ্য, মিডিয়াসৃষ্ট চাহিদা দ্বারা প্রতিস্থাপন করছে। এসব ক্ষেত্রে প্রচার প্রচারণা বদলে যাবার সাথে সাথে বদলে যায় চাহিদাও।
অন্যদিকে, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান শিকার হচ্ছে তারুণ্য। নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে কিংবা সুবিধামতো রাজনৈতিক মতাদর্শ জনপ্রিয় করতে তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘আধুনিকতা’ বিক্রি করছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, তরুণ সমাজও সহজেই তাদের প্রচারণার ফাঁদে পা দিয়ে তাদের দেখানো বিষয়গুলোকেই আধুনিকতা মনে করে সানন্দে গ্রহণ করছে।
শুধুমাত্র কিছু রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ফিল্টারে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদকে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সাম্রাজ্যবাদীদের এই সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব নিয়মানুগভাবে তৃতীয় বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে আচ্ছন্ন করে, তাদের আচার, প্রথা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে পুনর্বিন্যস্ত করে শাসক ও উঁচু শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর শোষণ উপযোগী করে তোলে। এতে সাম্রাজ্যবাদীদের উপর সে দেশের শাসক শ্রেণী সন্তুষ্ট থাকে এবং তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আর তাই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদকে খুঁজে পাওয়া যায় ঐতিহ্য এবং আধুনিকতায়।
অতীতে চার্চ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর সরকার প্রশাসনকে ধর্ম ও দেশপ্রেমের নামে সাধারণ জনগণের মন-মগজে দাসত্বের বীজ বপন করতে দেখা গেছে। কর্তৃত্বের এই হাতিয়ারগুলোকে আধুনিককালে প্রতিস্থাপিত করেছে গণমাধ্যম, প্রচার প্রচারণা ও বিজ্ঞাপন এবং সমাজের বুদ্ধিজীবীগণ। আধুনিককালে তো ভ্যাটিকানের চার্চ কিংবা বাইবেলের বক্তৃতার চেয়ে অধিক প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে হলিউড আর ডিজনিল্যান্ডের মতো বিনোদন পণ্যগুলো।
বিংশ শতাব্দীতে তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটার পর সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের ধরনও অনেকটা বদলে গেছে। গত শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক ধারণার সাথে এ শতাব্দীতে যুক্ত হয়েছে নতুন বৈশিষ্ট্য। পণ্ডিতগণ একে ‘কনটেম্পোরারি কালচারাল কলোনিয়ালিজম’ বা সিসিসি নামে অভিহিত করেছেন। সিসিসি যেসকল ক্ষেত্রে পূর্বের চেয়ে আলাদা সেগুলো এক নজরে দেখে নেয়া যাক।
- এটি এখন অভিজাত শ্রেণীর মাঝে প্রভাব বিস্তারের চেয়ে সাধারণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে অধিক আগ্রহী।
- আধুনিক গণমাধ্যম (ইন্টারনেট ও নিউজ পোর্টালের ছড়াছড়ি) সাম্রাজ্যবাদের বীজ নিয়ে সরাসরি এবং আগের চেয়ে শক্তিশালীরূপে মানুষের গৃহে প্রবেশ করছে।
- আধুনিক সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের মূল শক্তি হচ্ছে বিশ্বায়ন।
- নব্য উদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম অভিজাতকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে যা আদতে সাম্রাজ্যবাদকেই শক্তিশালী করছে।
- মুক্ত বাজারের মরীচিকা সদৃশ সাফল্যের গালগল্প শুনিয়ে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদীরা বিনোদন পণ্যের বাজার দখল করে নিজদের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করছে।
- জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে আন্তর্জাতিকতাবাদ, নিজস্ব সংস্কৃতির স্থলে বিশ্বসংস্কৃতি, ঐতিহ্যের স্থলে আধুনিকতার মতো শব্দগুলো ব্যবহার করছে সাম্রাজ্যবাদীরা, যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হবে। অথচ আধুনিকতা আর ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে তৃতীয় বিশ্বের আচার প্রথা, পারিবারিক আর সামাজিক বন্ধন, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছু বিনষ্ট হচ্ছে।
বর্তমান পৃথিবীতে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আলোচনা হলে তার অধিকাংশই আমেরিকান আধিপত্য নিয়ে হতে বাধ্য। আর হবেই না কেন, যুক্তরাষ্ট্রই তো দেশীয় সীমানার বাইরে সংস্কৃতি প্রচারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার গণমাধ্যমের সিংহভাগ দখল করে রেখেছে। গণমাধ্যম ব্যবসা মার্কিনীরা এতটাই নিজেদের করে নিয়েছে যে, এখন তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তিগণ সব গণমাধ্যম দিয়েই ধনী হচ্ছেন।
১৯৮২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ৪০০ ধনী ব্যক্তির তালিকায় গণমাধ্যম ব্যবসায়ী মাত্র ৯.৫ শতাংশ। অথচ বর্তমানে সর্বোচ্চ ধনীদের প্রতি ৫ জনে একজন গণমাধ্যম মালিক! আর এভাবেই গণমাধ্যমের আধেয়গুলোকে (সংবাদ, শিল্প, সাহিত্য) পণ্যে রূপান্তরিত করে সর্বোচ্চ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীরা।
রোনাল্ড রিগ্যান যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন প্রথমবারের মতো তার সরকার আন্তর্জাতিক রাজনীতির কড়চা থেকে নিজ দেশের সুশীল সমাজকে দূরে রাখতে গণমাধ্যমের আধেয় নিয়ে কাজ শুরু করেন। তারপর থেকে এই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়েছে। একদিকে তৃতীয় বিশ্বে নানাবিধ মার্কিন নীতির খপ্পরে পড়ে নাভিশ্বাস অবস্থা সেখানকার জনগণের।
অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধনী-গরীব বৈষম্য বৃদ্ধি, কী ঘটছে না সেসব দেশে? এসকল স্পর্শকাতর ব্যাপারে বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের প্রতিক্রিয়া থাকা উচিত নয় কি? উচিত এবং মানুষ প্রতিক্রিয়াও দেখায়। কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়াকেই ধীরে ধীরে স্তিমিত করে এনেছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিনোদন বিপণনের মাধ্যমে। প্রচুর পরিমাণে বিনোদন সামগ্রী সরবরাহ করে সমালোচনায় মুখর মুখগুলোকে নিষ্ক্রিয় দর্শকে পরিণত করছে গণমাধ্যমের সাম্রাজ্যবাদ।
সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করতে মিডিয়াকে আরেকটি ভয়ানক কাজে ব্যবহার করা হয়। ‘ডি-সেনসিটাইজেশন’ বা সুবেদিতা হ্রাসকরণ সেই কাজের নাম। হ্যাঁ, গণমাধ্যম ব্যবহার করে এখন মানুষের সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনীর বোমায় হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে নাড়া দেয়ার কথা।
নাড়া একেবারে দিচ্ছে না তা-ও নয়, বরং এই সংবেদনই এখন নিষ্ক্রিয় রূপ নিয়েছে। তৈরি করা হয়েছে এমন ভিডিও গেম, যেখানে ইরাকের ‘সন্ত্রাসী’দের উপর বোমা ফেলে ফেলে একেকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। সাধারণ মানুষ নিহতের ঘটনায় মানুষের মনে যে সংবেদন সৃষ্টি হবার কথা, তা ‘আধুনিক যুদ্ধশাস্ত্র’ শেখানোর নামে প্রশমিত করে দিচ্ছে ভিডিও গেম! আর সিনেমায় প্রতিপক্ষকে বর্বর, অসভ্য ও অমানবিক হিসেবে তুলে ধরার ব্যাপার তো আছেই।
আধুনিক বিশ্বের নব্য উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরিকাঠামো বেশ ইতিবাচক এবং সাম্যবাদী মনে হতে পারে। কেননা নব্য উদারবাদ এক নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের কথা বলে, যেখানে ধনী-গরীব সকলে সমান সুযোগ পাবে ব্যবসা করার। চমৎকার শোনাচ্ছে, তাই নয় কি? এবার একটি উদাহরণ দেয়া যাক।
ধরুন, বাংলাদেশের বাজারে নব্য উদারবাদী কাঠামো প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে দেশি আর বিদেশি পণ্য সমান সুযোগ পাচ্ছে এখানে এবং কোনোটিরই অতিরিক্ত কর প্রদান করতে হচ্ছে না। এখন এই বাজারে যখন কোনো আমেরিকান পণ্য প্রবেশ করবে, যারা কি না অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে যোজন যোজন এগিয়ে আছে, তাদের পণ্যের উপর যদি কোনো অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপ করা না হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই দেশীয় পণ্য প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়বে। কারণ বাংলাদেশ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশ হয়ে ওঠেনি। আর এভাবেই উদারবাদের নামে দেশীয় পণ্যের বাজার দখল করে নিচ্ছে অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো।
এবার ঠিক এ ব্যাপারটিই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভাবুন। উদারবাদের দোহাই দিয়ে খর্ব শক্তির সংস্কৃতি আর প্রভাবশালী বড় সংস্কৃতিকে একই সমতলে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেখানে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে ছোট সংস্কৃতিটি। প্রভাবশালী দেশগুলোর সিনেমা আর স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো অবাধে প্রবেশ করছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোও তা গ্রহণ করছে দু’হাত ভরে। ফলে তাদের দেশীয় বিনোদন খাত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, প্রভাবিত হয়ে অন্যদের অনুকরণের চেষ্টা করে স্বকীয়তা হারাচ্ছে।
মিডিয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো প্রকট। ডিজনি, ভায়াকম, সিবিএসের মতো মিডিয়া কোম্পানিগুলো ‘অবাধ তথ্য প্রবাহে’র সুযোগ নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নিজেদের ইচ্ছামতো জনমত গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করছে। আর অর্থনৈতিক ব্যাপারটা তো আছেই। বলা চলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী থেকে ভৌগোলিক উপনিবেশবাদ মুছে গেছে ঠিক, কিন্তু সূচিত হয়েছে মনস্তাত্ত্বিক উপনিবেশবাদের, সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদের।
কার্ল মার্ক্সের শ্রেণী সংগ্রামের ধারণা থেকে আমরা জানতে পারি যে, সমাজের শাসক বা বুর্জোয়া শ্রেণী কোনো না কোনোভাবে শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করছে। তবে মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, একদিন শ্রমিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হবে এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শিকড় উপড়ে ফেলবে। মার্ক্সের শ্রেণী সংগ্রামের ধারণা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই ইতালিয়ান দার্শনিক অ্যান্তনিও গ্রামস্কি ‘কালচারাল হেজেমনি’ বা সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদের ধারণা দেন।
তবে তার ধারণা শেষটায় গিয়ে মার্ক্সের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ তার বিশ্বাস, মিডিয়া ও এর দ্বারা প্রচারিত সংস্কৃতি এতটাই প্রভাব ফেলতে সক্ষম যে, তা শ্রমিক শ্রেণীকে একটি অসম সমাজব্যবস্থাও গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। তার এই ধারণার সারাংশ হচ্ছে এই যে, আধুনিক পুঁজিপতিদের মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে মিডিয়া, যা কি না শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার মতো যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। ফলে সাধারণ মানুষ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় যে, তারা শোষিত হচ্ছে এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে সর্বোত্তম বলে গ্রহণ করে নেয়।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেস্টুরেন্ট চেইন ম্যাকডোনাল্ডসের বিশ্বজুড়ে আউটলেটের সংখ্যা বর্তমানে ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে। তাদের ‘I’m lovin’ it‘ স্লোগান সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত স্লোগানগুলোর একটি। এত জনপ্রিয়তা দেখে মার্কিন গবেষক এরিক স্ক্লোসার মজা করে বলেছিলেন,
খ্রিস্টানদের ক্রুশের চেয়ে ম্যাকডোনাল্ডসের লোগো অধিক পরিচিত!
এ উক্তির বাস্তব ভিত্তি না থাকতে পারে, তবে উক্তিটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী ম্যাকডোনাল্ডসের অস্বাভাবিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে আছে মার্কিন সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী কার্যকরণ। যেকোনো দেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তাদের খাদ্যাভ্যাস। তাই সংস্কৃতিতে কর্তৃত্ব করতে হলে পরিবর্তন আনতে হবে খাদ্যাভ্যাসেও। তাত্ত্বিকগণ এ ব্যাপারটিকে প্রকাশ করতে একটি শব্দের প্রচলন করেছেন। ‘ম্যাকডোনাল্ডাইজেশন’ বা ম্যাকডোনাল্ডকরণ! এই শব্দটি জর্জ রিটজারের বই ‘দ্য ম্যাকডোনাল্ডাইজেশন অব সোসাইটি’ থেকে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ম্যাকডোনাল্ডাইজেশন শব্দটি শুধুমাত্র ম্যাকডোনাল্ডসের বিস্ময়কর বিস্তৃতির প্রতীক না। এই শব্দটি মূলত এরকম আরো বহু শব্দের যোগান দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে সিনেমার জগতে হলিউডের দাপটকে ‘হলিউডাইজেশন’, ইন্টারনেটে ‘গুগলাইজেশন’ আর ‘ফেসবুকাইজেশন’, মিডিয়া জগতে ‘ডিজনাইজেশন’ আর সামরিক সংবাদের ক্ষেত্রে ‘পেন্টাগনাইজেশন’ এর মতো শব্দগুলো ব্যবহার করলেও খুব একটা ভুল হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে মিডিয়ার মাধ্যমে আমেরিকান সংস্কৃতি ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো বিশ্বে। আর তাতে করে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন ও নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।
যুক্তরাষ্ট্র যে সমগ্র বিশ্বে তাদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তো বটেই, ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতেও যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির প্রভাব অসীম। ১৯২০ সালের পর থেকেই ইউরোপে আমেরিকান চলচ্চিত্রের প্রভাব বাড়তে থাকে। ২০১১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, পুরো ইউরোপে প্রতিবছর যত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়, তার ৯০ ভাগই হলিউডের ছবি যেখানে ইউরোপীয় সিনেমা মাত্র ৫ ভাগ! আর চলচ্চিত্র যে কত বড় প্রচার যন্ত্র, তা আমেরিকান চলচ্চিত্রের সাথে পরিচয় থাকলে সহজেই বুঝতে পারা যায়।
বিজ্ঞানভিত্তিক আর কাল্পনিক চলচ্চিত্র বাদে অধিকাংশ আমেরিকান সিনেমাই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে সর্বোত্তম বলে প্রচার করে। রাশিয়া, চীন, ইরান আর উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো আমেরিকান সিনেমায় সবসময়ই নেতিবাচকভাবে ফুটে উঠে। বিপরীতক্রমে, আমেরিকাকে বর্ণনা করা হয় মানবতা আর ন্যায় বিচারের ধারক বাহক হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথাই বলা যাক।
আমেরিকার অযাচিত যুদ্ধের ফলে লাখো বেসামরিক মানুষ নিহত হয় ভিয়েতনামে। মার্কিন বাহিনীর গণ্ডায় গণ্ডায় ফেলা বোমাগুলোর কিছু এখনো ভিয়েতনামের মাটিতে অবিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া যায়। অথচ ‘অ্যাপোক্যালিপস নাও’, ‘দ্য ডিয়ার হান্টার’, ‘রেসকিউ ডন’ সহ অসংখ্য সিনেমা নির্মিত হয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের উপর, যেখানে মার্কিন সৈন্যদের ‘মহানুভবতা’, ‘বীরত্ব’, ‘মানবতাবোধ’ আর ভিয়েতনামিদের ‘পৈশাচিকতা’, ‘নির্মমতা’, ‘অমানুষত্ব’ ফুটে উঠেছে! স্বাভাবিকভাবেই এসব সিনেমা নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস বর্ণনা করবে ভিন্ন স্বরে, ভিন্ন আঙ্গিকে।
সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের সমালোচকেরও অভাব নেই। অনেকের মতে, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বটি সম্পূর্ণ আধুনিকতা এবং উদারবাদ পরিপন্থী। তাদের মতে, একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি একটি দুর্বল সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে না, বরং ঝিমিয়ে পড়া সংস্কৃতিগুলোকে চাঙা করে, উজ্জীবিত করে। বিশ্বায়নের এ যুগে ভিন্ন সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের ভয়ে নিজের সীমার মধ্যে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত?
কিন্তু সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বের প্রবক্তাদের পাল্টা প্রশ্ন থাকে, বিশ্বায়ন বা উদারবাদই কতটা সাম্যের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে? গভীর পর্যবেক্ষণে তো বরং দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বায়নের ফলে শক্তিশালী সংস্কৃতি আরো শক্তিশালী হচ্ছে, দুর্বল সংস্কৃতি আরো ক্ষীণকায় হয়ে একসময় হারিয়ে যাচ্ছে। আর যে আধুনিকায়নের কথা বলা হচ্ছে, সেই আধুনিকায়নের বৈশিষ্ট্য বা মাপকাঠি কী? যা কিছু পাশ্চাত্য, যা কিছু আমেরিকান, তা-ই কী আধুনিকতা? অবশ্যই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের এ প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর খুঁজে পেলে সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসাই উত্তম। অন্যথায় নিজস্ব সংস্কৃতি, স্বকীয়তা, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের উপর ভিনদেশী প্রভাব ও কর্তৃত্ব নিয়ে ভাবতে বসাটা জরুরি।