মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির নাম রাষ্ট্র। মানুষের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মৌলিক একক হিসেবে কাজ করেছে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের মৌলিক প্রভাবকও ছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। সময়ের সাথে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের আকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে, পরিবর্তন এসেছে রাষ্ট্রের কাজ করার পরিধিতেও। প্রাচীনকালে রাষ্ট্র ছিল নগরকেন্দ্রিক, নগররাষ্ট্রের আকার ছিল ছোট, পলিটিক্যাল এনটিটি হিসেবে এর অধীনে থাকা মানুষের সংখ্যাও ছিল কম। নগররাষ্ট্রের পরবর্তী সময়ে শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদের যুগ, একেকজন সম্রাটের অধীনে থাকতো বিশাল বিশাল ভূখণ্ড। শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে শুরু হয় জাতিরাষ্ট্রের যুগ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের আকৃতি হয় মাঝারি। নগররাষ্ট্রের চেয়ে কয়েকগুণ বড়, আবার সাম্রাজ্যের চেয়ে কয়েকগুণ ছোট।
আইনসভার বিবর্তন
রাষ্ট্রের আকৃতিকেন্দ্রিক এই বিবর্তনের সময়টার সাথে সাথে বিবর্তন ঘটেছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আর কার্যাবলির ধারণাতেও। নগররাষ্ট্র আর জাতিরাষ্ট্রের যুগেই মূলত বিকশিত হয়েছে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা, শাসক নির্বাচিত হয়েছে নাগরিকদের মধ্যে থেকে, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা বা এসেম্বলি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা সহজভাবে গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত। বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা, মানুষের শাসনতন্ত্র কেন্দ্রিক পরীক্ষা নিরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে গণতন্ত্র।
আইনসভা হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নিয়মিত বিভিন্ন সভায় মিলিত হন। আইনসভা প্রকৃতিগতভাবে দুই ধরনের। ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন কাজে মিলিত হন, কাঠামোগত সভা করেন, সেটি পরিচিত লোকাল এসেম্বলি হিসেবে। দেশের সকল প্রান্ত থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যখন সম্মিলিত এসেম্বলিতে মিলিত হন, সেই এসেম্বলি পরিচিতি পায় ন্যাশনাল এসেম্বলি হিসেবে। লোকাল এসেম্বলি ও ন্যাশনাল এসেম্বলি তাদের নির্ধারিত অঞ্চলগুলোর নীতিনির্ধারণী কাজগুলো করে থাকেন।
জাতিরাষ্ট্রে আইনসভা
আটলান্টিক রেভ্যলুশনের পরে যে জাতিরাষ্ট্রের উত্থান শুরু হয়, তার পূর্ণতা পায় আফ্রিকার বিউপনিবেশায়নের মধ্যে দিয়ে। এরমধ্যে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই, উনবিংশ শতাব্দীজুড়ে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন চলেছে ইউরোপের দেশগুলোতে। জাতিরাষ্ট্রে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটেছে, যেসব প্রতিষ্ঠান শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে নিজদের অপরিহার্য প্রমাণ করেছে, আইনসভা তার মধ্যে অন্যতম।
বর্তমানে দুই ধরনের আইনসভা দেখা যায়। এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। পরিণত গণতন্ত্রের অধিকাংশ দেশের আইনসভাই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার উচ্চক্ষের নাম সিনেট, নিম্নকক্ষের নাম হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ। সিনেটের সদস্য সংখ্যা ১০০ জন, সিনেটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট, সিনেটে থাকেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, থাকে সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতা। ৪৩৫ সদস্য বিশিষ্ট হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের নেতৃত্ব দেন স্পিকার, বর্তমানে স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির ন্যান্সি প্যালোসি।
ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষের নাম রাজ্যসভা, নিম্নকক্ষের নাম লোকসভা। লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, দায়িত্ব পালন করেন সরকারপ্রধান হিসেবে। যুক্তরাজ্যের আইনসভার নিম্নকক্ষের নাম হাউজ অব কমন্স, উচ্চকক্ষের নাম হাউজ অব লর্ডস।
আইনসভার কাজ
তবে, কেবল নীতি নির্ধারণী কাজকর্ম ছাড়াও, এসেম্বলিগুলোর কার্যতালিকায় নানাবিধ দায়িত্ব থাকে।
প্রথমত, আইনসভার সদস্যরা নির্ধারিত পলিটিক্যাল এনটিটি হিসেবে রাষ্ট্র বা অঙ্গরাজ্যের জন্য আইন তৈরির কাজগুলো করে থাকেন। আইন তৈরির মাধ্যমে আইনসভার সদস্যরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজকর্মের ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড তৈরি করে দেন, বৈধ আর অবৈধ কাজের মধ্যে সীমারেখা তৈরি করেন। সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তার সাথে সাংঘর্ষিক কাজগুলোকে শাস্তির আওতায় আনার বিধানও তৈরি করে আইনসভার সদস্যরা।
দ্বিতীয়ত, আইনসভার সদস্যরা সরকারের রাজস্ব আদায়ের পলিসি নির্ধারণ করে দেন। আমরা জানি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের নিয়মিত কাজগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। এই অর্থের যোগান আসে নাগরিকদের পকেট থেকে, বিভিন্ন ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ করের মাধ্যমে। কিন্তু, রাষ্ট্র বা শাসক চাইলেই যাতে সীমাহীন কর নির্ধারণ করতে না পারেন, সেজন্য কর নির্ধারণের কাজটি করে থাকেন আইনসভার সদস্যরা। জনমত, জনগণের সামর্থ্যের নিরিখে তারা করনীতি নির্ধারণ করে থাকেন, নির্ধারণ করে দেন রাষ্ট্রের রাজস্ব আদায়ের উপায়ও। সাধারণভাবে, রাষ্ট্র নাগরিকদের আয়ের উপর একটি অংশ প্রত্যক্ষ কর হিসেবে আদায় করে, আবার রাষ্ট্র বিভিন্ন ব্যয়ের উপর মূল্য সংযোজন করও আদায় করে পরোক্ষ কর হিসেবে। ক্ষতিকর দ্রব্যের ব্যবহার কমাতে আরোপ করা হয় আবগারি শুল্ক, বিদেশি পণ্যের ব্যবহার কমাতে বিদেশী পণ্যের আমদানির উপরও সাধারণত উচ্চহারে কর নির্ধারণ করা হয়।
তৃতীয়ত, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের কাজ করে থাকে আইনসভা, জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যায় আইনসভার সদস্যরা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকা নির্বাহী বিভাগ সাধারণত বিপুল ক্ষমতা চর্চার সুযোগ পায়, সুযোগ পায় রাজনৈতিক কর্তৃত্বের। সরকারের কোনো অংশ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকা আমলারা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন কিনা, সেগুলোর মানদণ্ড সাধারণত আইনসভা নির্ধারণ করে দেন। ক্ষমতার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বিচ্যুতি ঘটলে, সেটিকে জবাবদিহিতায় আনার কাজও তাত্ত্বিকভাবে আইনসভার সদস্যদের উপরই বর্তায়।
চতুর্থত, আদিমকালে প্রকৃতির রাজ্যের নৈরাজ্য থেকে বাঁচতে মানুষ একত্রিত হয়ে রাষ্ট্র তৈরি করেছিল, আবদ্ধ হয়েছিল অলিখিত সামাজিক চুক্তিতে। আধুনিক সময়ে, জাতিরাষ্ট্রের যুগে এই সামাজিক চুক্তির লিখিত রূপ হচ্ছে সংবিধান। একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক আদর্শ কী, রাষ্ট্রের সরকারপ্রকৃতি কী, নাগরিকেরা কতোটুকু রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন, কতটুকু বাকস্বাধীনতা চর্চার সুযোগ পান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সুযোগ পান, তা নির্ধারিত হয় সংবিধানের মৌলিক ভিত্তিগুলোর মাধ্যমে। আইনসভার সদস্যরা সংবিধান তৈরি করেন, সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের উপর নিয়মিতভাবে বিতর্কে অংশ নেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে আনা হয় সংবিধানের সংশোধনী। অর্থাৎ, সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শগুলো নির্ধারণের কাজ করে থাকেন আইনসভার সদস্যরা।
আইনসভায় কীভাবে আইন তৈরি হয়?
আইনসভায় আইন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় বিল উত্থাপনের মধ্যে দিয়ে। আইনসভার একজন সদস্য, আইনসভার বিভিন্ন কমিটি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বিল উত্থাপন করতে পারেন। বিল উত্থাপনের পর বিলের প্রস্তাবনা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি আইনসভার সদস্যদের সামনে উপস্থাপন করে আইনসভার সচিবালয়। সাধারণত, বুকলেটের মাধ্যমে এই তথ্য উপস্থাপনা করা হয়, অনেক সময় এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও যুক্ত হয়। এই বুকলেটটিকে বেশ কিছু দেশে বলা হয় ‘গ্রিন পেপার’। এরপর আইনসভাতে প্রস্তাবিত বিলের উপর বিতর্ক চলে, চলে সংশোধনী প্রস্তাবনা। আইনসভাতে প্রাথমিক বিতর্কের পর বিলের উপর প্রস্তুতকৃত গ্রিন পেপারটি আবার মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত হয়, প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর উপর আইনি এবং সামগ্রিক ব্যাখ্যা দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
এই পর্যায়ের সংশোধনী শেষে যে বুকলেটটি প্রস্তুত হয়, সাধারণত সেটিকে বলে হোয়াইট পেপার। সংশোধনী আসার পর কিছু কিছু দেশে পুনরায় বিতর্ক হয় বিলের সংশোধিত প্রস্তাবনার উপর, কিছু দেশে সরাসরি আইনসভার সদস্যদের ভোটের জন্য প্রেরণ করা হয়। আইনসভায় বিল পাশ হলে সেটি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে পাঠানো হয়, অনুমোদনের জন্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপ্রধান প্রস্তাবিত বিলটিতে স্বাক্ষর করেন, রাষ্ট্রপ্রধান বিলে স্বাক্ষর করলে সেটি আইনে পরিণত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধান বিল নাকচ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা না থাকায় রাষ্ট্রপ্রধান পুনরায় আলোচনার জন্য আইনসভাতে প্রেরণ করেন। এভাবেই আইনসভার মাধ্যমে তৈরি হয় আইন।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভার ভূমিকা
আইনসভা মূলত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকেন্দ্রিক একটি ধারণা। প্রাচীনকালে শাসকেরা কর সংক্রান্ত অর্থের জন্য প্রতিনিধত্বমূলক শাসনকে উৎসাহিত করতেন, সুযোগ দিতেন নাগরিকদের মধ্যে থেকে প্রতিনিধিত্ব উঠে আসার। আধুনিক সময়ে এসে এই প্রক্রিয়া অনেক বেশি কাঠামোগত হয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাজের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা তৈরি হয়েছে।
প্রাচীন নগররাষ্ট্রের যুগের আইনসভাগুলো ছিল অনেকটা জেন্টলম্যানস ক্লাবের মতো, কেবল সামর্থ্যবান আর প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরাই আইনসভার সদস্য হওয়ার সুযোগ পেতেন, চর্চা করতে পারতেন প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের। নারী আর দাসদের সেই যুগে আইনসভার সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল না। আধুনিক যুগে এসে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব আরো সীমিত হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে কেবল নির্বাচিত একজনই আইনসভার সদস্য হওয়ার সুযোগ পান।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তিগুলো হচ্ছে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা আর নাগরিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এই মৌলিক ভিত্তিগুলো পূরণের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আইনসভা, আইনসভার নির্বাচিত সদস্যগণ।
রাষ্ট্রের অসীম কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠা আটকাতে পারে আইনসভা, রাষ্ট্রের চরিত্রও নির্ধারিত হয় করে আইনসভার সদস্যদের কার্যক্রম এবং মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে। অযোগ্য ব্যক্তি আইনসভাতে আসা, ব্যবসায়ী শ্রেণির আধিক্য, আইনসভার উপর অর্পিত দায়িত্ব আর মূল্যবোধগুলোর বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করে।