১৯৩০ এর দশক ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এক সময়। এ সময় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন চরমে ওঠে, এবং তারা নিজেদের প্রভাব বিস্তারে অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে এই টানাপোড়েনের ফলে বিশ্বে শুরু হয় জোট গঠনের খেলা। বিরোধী দেশগুলোকে চাপে রাখতে এবং তাদের বিস্তার ঠেকাতে প্রত্যেকটি দেশই তৎপরতা শুরু করে। এই একই সময়ে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব ও পশ্চিমের দুই ক্যাপিটালিস্ট দেশ জার্মানি এবং জাপান আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। কমিউনিজম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তার ঠেকাতে উঠে-পড়ে লাগে তারা।
১৯১৯ সালে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে তৃতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিন্টার্নের যাত্রা শুরু হয়। কমিন্টার্নের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্ববিপ্লব। সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বিশ্ববিপ্লবের ধারণাকে স্বাভাবিকভাবেই অন্য দেশগুলো ভালোভাবে নেয়নি। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের পর জার্মান সরকার কমিউনিস্টবিরোধী একটি জোট গঠনের চেষ্টা শুরু করে। জার্মানির এই মনোভাব বার্লিনে জাপানের তৎকালীন সামরিক সহদূত হিরোশি ওশিমা বেশ পছন্দ করেন। ওশিমা ছিলেন কমিউনিজমের ঘোর বিরোধী, এবং সাইবেরিয়ায় জাপানি সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের পক্ষে। তিনি যেকোনো মূল্যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাপে ফেলতে চেয়েছিলেন।
জাপানের ওশিমার মতোই জার্মানিরও সোভিয়েতবিরোধী এবং জার্মান-জাপানি মিত্রতার পক্ষে একজন ছিল। তিনি জোয়াখিম ভন রিবেনট্রপ। রিবেনট্রপ ছিলেন হিটলারের অত্যন্ত কাছের মানুষ। ওশিমা রিবেনট্রপকে হিটলারের পর জার্মানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করেন। একপর্যায়ে রিবেনট্রপের সঙ্গে ওশিমার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রিবেনট্রপের সহযোগিতায় ওশিমা নাৎসি নেতা হিটলারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। কিছুদিন পর জার্মানি ও জাপানের মধ্যে একটি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়।
হিরোশি ওশিমার প্রচেষ্টায় জার্মানি ও জাপান তাদের আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ওশিমা এই চুক্তি নিয়ে জাপানের সরকারের চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল। এককথায়, জার্মানির সঙ্গে একটি চুক্তি করতে হিরোশি ওশিমা একপায়ে খাড়া ছিলেন। তবে জার্মানির সঙ্গে চুক্তির ফলে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ভয়ে ছিল জাপানি সরকার। শেষপর্যন্ত ওশিমা জাপানি সরকার ও বার্লিনে জাপানি রাষ্ট্রদূতকে জার্মান-জাপানিজ চুক্তির পক্ষে বোঝাতে সক্ষম হন।
একপর্যায়ে জার্মানি ও জাপানের মধ্যে আলোচনা বেশ গতি পেতে থাকে। ১৯৩৬ সালের জুনে জাপানের প্রতিনিধির সঙ্গে এক আলোচনায় বসেন জার্মান নেতা হিটলার। এই আলোচনার পর, পূর্ব এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাবের বিরুদ্ধে বেশ শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে জাপানের ভূমিকা আশা করেন হিটলার। তিনি চেয়েছিলেন পূর্ব দিকে জাপানের মতো শক্তিশালী দেশের মিত্রতার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোণঠাসা করে ফেলতে।
হিটলারের নির্দেশে আলোচনা আরো গতিশীল হয়। ১৯৩৬ সালের ২৫ নভেম্বর বার্লিনে জাপানি রাষ্ট্রদূত কিন্টোমো মোশানোকোজি ও জার্মান অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ জোয়াখিম ভন রিবেনট্রপ এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দুই দিন পর ২৭ নভেম্বর হিটলার এই চুক্তির আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেন। জার্মানির পক্ষে এই চুক্তির প্রধান কুশীলব ছিলেন রিবেনট্রপ। রিবেনট্রপের কারণেই এই চুক্তি সম্ভব হয়েছে। এই চুক্তির পর রিবেনট্রপ নাৎসিদের মধ্যে বেশ প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
সেদিন মূলত দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একটি ছিল প্রকাশ্য, অন্যটি ছিল গোপন। প্রকাশ্য চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি ও জাপান উভয় দেশ কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য আদানপ্রদানে সম্মত হয়। সেই সঙ্গে কমিন্টার্নের এসব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সম্মিলিত ব্যবস্থা নিতে সম্মত হয় দেশ দুটি। জার্মানি ও জাপান উভয়ই এই চুক্তিতে তৃতীয় কোনো দেশের অন্তর্ভুক্তিকে আমন্ত্রণ জানায়। যেসব দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ব্যাঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে বিপন্ন হচ্ছে, সেসব দেশ আত্মরক্ষার্থে জার্মানি ও জাপানের সম্মতিতে উক্ত চুক্তিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিকভাবে এই চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর নির্ধারিত হয় এবং চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এটি বাড়ানোর বিষয়ে উভয় দেশ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে বলে সম্মত হয়।
এছাড়া সেদিন জার্মানি ও জাপানের মধ্যে একটি গোপন চুক্তিও হয়। গোপন চুক্তিটিই ছিল এন্টি-কমিন্টার্ন প্যাক্টের মূল উদ্দেশ্য। গোপন চুক্তিতে সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম উল্লেখ করা হয়। নাৎসি জার্মানি ও ইম্পেরিয়াল জাপান উভয় দেশ স্বীকার করে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যাপকভাবে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে এবং এই উদ্দেশ্য অর্জনে তার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে চায়। এই দুই দেশ আরো স্বীকার করে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের এসব কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র জার্মানি ও জাপানের অস্তিত্বের জন্যই হুমকি নয়, উপরন্তু এটি বিশ্বশান্তি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করছে।
উভয় দেশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, জার্মানি কিংবা জাপানের যেকোনো একটি দেশ যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়, তবে অন্য দেশ এমন কোনো ব্যবস্থা নেবে যেন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বাধ্য হয়। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে উভয় দেশ নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে সেই বিষয়ে পরামর্শে বসবে। এই চুক্তিতে থাকাকালীন জার্মানি কিংবা জাপান পারস্পরিক সম্মতি ব্যতীত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না বলেও সিদ্ধান্ত নেয়।
এন্টি-কমিন্টার্ন চুক্তির ফলে জার্মানি ও জাপানের মধ্যে মিত্রতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। চুক্তির এক বছরের মাথায় ১৯৩৭ সালের ৬ নভেম্বর ইতালিও এই চুক্তিতে অংশগ্রহণ করে। স্পেন এবং হাঙ্গেরি ১৯৩৯ সালে এই চুক্তিতে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন আরো কয়েকটি দেশ উক্ত চুক্তিতে যুক্ত হয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স এন্টি-কমিন্টার্ন প্যাক্টের সমালোচনা করে।
১৯৩৭ সালে শুরু হওয়া চীন-জাপানি যুদ্ধে জার্মানির নীরবতা জাপানকে কিছুটা হতাশ করে। এই যুদ্ধের ফলে জার্মানি দোটানায় পড়ে যায়, কারণ জাপান ও চীন উভয় দেশই জার্মানির মিত্র ছিল। এরপর ১৯৩৯ সালে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে হওয়া মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির ফলে জাপান ও জার্মানির মধ্যে দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। জাপান সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে তার বৃহত্তম শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। তবে জার্মান-জাপানি সহযোগিতা তখনও অব্যাহত ছিল। ১৯৪০ সালে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে জাপান ইউরোপে জার্মানি ও ইতালির নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দেয়, এবং জার্মানি পূর্ব এশিয়ায় জাপানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়।
এন্টি-কমিন্টার্ন প্যাক্ট ছিল বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ চুক্তিগুলোর মধ্যে একটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তির ভিত্তি ছিল এই এন্টি-কমিন্টার্ন প্যাক্ট। তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে আগ্রাসী ও সামরিক শক্তিধর দুটি দেশ একে অপরের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে এই চুক্তির মাধ্যমে। তাদের এই মিত্রতা স্বাভাবিকভাবেই বাকি বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। যদিও চুক্তিটি বাহির থেকে দেখলে রক্ষণাত্মক মনে হয়, কিন্তু এই চুক্তির ফলে শান্তির বদলে যুদ্ধের সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। গোপন চুক্তি অনুযায়ী স্পষ্টতই সোভিয়েত ইউনিয়নকে লক্ষ্য বানানো হয়েছিল। ফলে এই চুক্তিকে বৃহৎ অর্থে ‘সোভিয়েত বিরোধী’ চুক্তি বললে ভুল হবে না।