এরিস্টটলের দর্শন অনুযায়ী, পৃথিবীতে ছয় ধরনের শাসনতন্ত্র রয়েছে। একজনের শাসনের বিশুদ্ধ রূপ রাজতন্ত্র, বিকৃত রূপ স্বৈরতন্ত্র। কয়েকজন মিলে যে শাসনতন্ত্র পরিচালনা করে, তার বিশুদ্ধ রূপ অভিজাততন্ত্র, বিকৃত রূপ কতিপয়তন্ত্র। সামষ্টিক শাসনের বিশুদ্ধ রূপ পলিটি, বিকৃত রূপ গণতন্ত্র। মধ্যযুগে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদের জয়জয়কার চলেছে, তখন শাসনতন্ত্র ছিল মূলত রাজতান্ত্রিক। মধ্যযুগের শেষদিকে এসে শাসনব্যবস্থা হিসেবে রাজতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা কমতে শুরু করে, শুরু হয় গণতন্ত্রের বিকাশ পর্ব।
রেনেসাঁর ছোঁয়া ইউরোপের অন্যান্য প্রান্তের মতো রাশিয়াতেও লাগে, উত্থান ঘটে সংস্কারবাদীদের। আটলান্টিক রেভ্যলুশনের ঢেউও লাগে রাশিয়াতে, ইউরোপে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের প্রভাবও পড়ে সেখানে। ফলে, উনবিংশ শতাব্দীতেই রাশিয়াতে পার্লামেন্ট গঠিত হয়, রাজাকে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে। কিন্তু, সংস্কারবাদীরা প্রথম প্রাধান্য বিস্তারকারী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে, ১৯১৭ সালে রাশিয়া প্রত্যক্ষ করে দুটি বিপ্লব।
প্রথম বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যেটি পরিচিতি পায় ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ নামে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে, রাশিয়া আত্মপ্রকাশ করে রিপাবলিক হিসেবে। এই বিপ্লবের পাল্টা বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লব ঘটে অক্টোবরে, যেটি পরিচিতি পায় ‘অক্টোবর বিপ্লব’ হিসেবে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা গণতন্ত্রপন্থীদের হটিয়ে ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্টরা, তাদের মাধ্যমেই রাশিয়াতে শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির শাসন।
কমিউনিস্ট পার্টিতে নিকিতা ক্রুশ্চেভ
নিকিতা ক্রুশ্চেভ কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম নেতা, যিনি একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে শীর্ষপদে আরোহণ করেছিলেন। তার পূর্ববর্তী নেতা, যেমন লেনিন, স্ট্যালিন অক্টোবরের প্রতিবিপ্লবের সাথে নেতৃত্বের পর্যায়ে সংযুক্ত থাকায় কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপদ থেকেই রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। ক্রুশ্চেভ এদিক থেকে ব্যতিক্রম। অক্টোবর বিপ্লবে তিনি অংশ নেন সাধারণ একজন সৈন্য হিসেবে, গৃহযুদ্ধ পরবর্তী বিপ্লবে তার উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
তবে, বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়নে দ্রুত উত্থান ঘটতে থাকে ক্রুশ্চেভের, পার্টিতে আবির্ভূত হন অন্যতম সম্ভাবনাময় উদীয়মান রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে। দ্রুত প্রমোশন পেয়ে ১৯৩৬ সালেই মস্কোর আঞ্চলিক ফার্স্ট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ইউক্রেনে। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়েও এই দায়িত্বে বহাল ছিলেন তিনি।
উদীয়মান এই রাজনৈতিক নেতা স্ট্যালিনের সময়ে কেবলমাত্র টিকেই থাকেননি, স্ট্যালিনের অন্যতম আস্থাভাজন সেনানী ছিলেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। স্ট্যালিনের আমলে ক্রুশ্চেভ দেখভাল করেন কৃষি উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত ইস্যুগুলো, ছিলেন প্রথাগত কৃষি দর্শনের বিশ্বাসী। যদিও, কৃষিক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন আসেনি তার সময়ে। উৎপাদন বৃদ্ধিতেও ক্রুশ্চেভ তেমন কোন সাফল্য দেখাতে পারেননি। বরং, তার সময়েই কৃষিখাত অস্থিতিশীল হয়েছে, উৎপাদনের হ্রাস ঘটেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কৃষিক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে না পারার ব্যর্থতা অনেকটা নিকিতা ক্রশ্চেভের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা।
কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষপদে উত্থান
স্ট্যালিনের পরে কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়নে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল তিনজনের। এরা হলেন, নিকোলাই বুলগানিন, জর্জ মালেনকভ ও নিকিতা ক্রুশ্চেভ। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে, স্ট্যালিনের যুগের একক কর্তৃত্ববাদী শাসনের কুফল প্রত্যক্ষ করে, কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন সামষ্টিক নেতৃত্বের ধারণা প্রবর্তন করে। ক্ষমতা যাতে একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, স্ট্যালিনের যুগ যাতে আরেকবার ফিরে না আসে, সেই লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছিলো এই উদ্যোগ।
স্ট্যালিনের মৃত্যুর ছয় মাসের মধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়নের ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হন নিকিতা ক্রশ্চেভ, যেটি শীর্ষ দুই পদের একটি। ১৯৫৮ সালে ফার্স্ট সেক্রেটারির পদ থেকে নিকিতা ক্রশ্চেভকে অপসারণের চেষ্টা করে পার্টির একটি অংশ। অন্যান্য অংশগুলোর সমর্থন আদায় করে নিকিতা ক্রশ্চেভ কেবল ক্ষমতায় টিকেই থাকেননি, পার্টির বিশাল অংশের সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে অধিষ্ঠিত হন কাউন্সিল অব মিনিস্টারস এর চেয়ারম্যান হিসেবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যে পদটি ছিল রাষ্ট্রপ্রধানের। রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েই নিকিতা ক্রশ্চেভ রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেন তার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, নিকোলাই বুলগানিন ও জর্জ মালেনককে। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিকিতা ক্রুশ্চেভ টিকে ছিলেন ছয় বছর।
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ক্রুশ্চেভ
নিকিতা ক্রুশ্চেভের বিশেষত্ব ছিল একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তার প্রেসিডেন্সিতে কৃষিখাত ক্রমাগত প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকে, কৃষি উৎপাদনে ক্রমাগত ব্যর্থতার চিত্র ফুটে ওঠে। জনসমর্থন জেতার জন্য তাই নিকিতা ক্রুশ্চেভকে শেষ পর্যন্ত শিল্প খাতের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল, শিল্পখাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর খরচ, শিল্পের উৎপাদন আর কৃষিখাতের ক্রমাগত অবনতির মধ্যে একটি ভারসাম্য আনার প্রচেষ্টাও ছিল ক্রুশ্চেভের শাসনকালের মধ্যে।
ক্রুশ্চেভের সময়ে সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক ঘটনা ছিল কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস। ক্রমাগত সমর্থন হারাতে থাকা ক্রুশ্চেভের শাসনামলের সর্বশেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় এই ঘটনাটিই। সামরিক উপদেষ্টাদের পরামর্শের বিরুদ্ধে গিয়েই কিউবাতে মিসাইল সরবারহের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ক্রশ্চেভ, যেটি পরবর্তীতে অত্যন্ত অপরিণামদর্শী এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পরিণত হয়। কিউবা থেকে মিসাইল সরাতে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করে, পাশাপাশি শুরু হয় নৌ অবরোধ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কূটনৈতিক তৎপরতা আর রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় সেবার একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের হাত থেকে বেঁচে যায় পৃথিবী। পৃথিবী পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বেঁচে গেলেও, বাচেনি নিকিতা ক্রুশ্চেভের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। কিউবাল মিসাইল ক্রাইসিসের ব্যর্থতা সমাপ্তি নিয়ে আসে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে, ক্ষমতাচ্যুত হন রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে। সমাপ্ত হয় তার ছয় বছরের প্রেসিডেন্সির।
যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত হন
স্ট্যালিন যুগের একনায়কতন্ত্রের তিক্ত অভিজ্ঞতা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির অনেকের মধ্যেই ছিল, যার ধারাবিকতা ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রচেষ্টা। স্টালিনের ক্ষমতাচ্যুতির পরে কয়েক মাসের জন্য এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেও, সম্ভাব্য বিদ্রোহকে ব্যবহার করে ক্ষমতাকে আবার কেন্দ্রীভূত করেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে একটা বিশাল অংশ এই প্রক্রিয়াকে ভালোভাবে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিসাইল ক্রাইসিসের পাশাপাশি তার সময়ে চীনের সাথেও সম্পর্ক শীতল হয়ে যায়। জনসমর্থনও নিকিতা ক্রশ্চেভের পক্ষে ছিল না।
ফলে, ১৯৬৪ সালে জর্জিয়াতে নিকিতা ক্রুশ্চেভ যখন ছুটি কাটাচ্ছিলেন, সেখান থেকে তাকে রাশিয়াতে ফিরিয়ে আনা হয়, তাকে বাধ্য করা হয় পদত্যাগ করতে। ক্রুশ্চেভের সামনে বাধ্যতামূলক অবসর মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। এর পাশাপাশি, তাকে রাজনীতি থেকেও অবসরে যেতে হয় পুরোপুরি। পরবর্তীতে তাই নিকিতা ক্রুশ্চেভকে নিভৃত জীবনই কাটাতে হয়েছে।
ক্রুশ্চেভের রাজনৈতিক লিগ্যাসি
তার রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো যেমন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে ভুগেছে, একইভাবে গ্রহণযোগ্যতার সংকটে ভুগেছে তার আন্তর্জাতিক রাজনীতির দর্শনও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্রুশ্চেভ অপেক্ষা করতে করতে একেবারে শেষ সময়ে এসে সিদ্ধান্ত নিতেন, তৃণমূল থেকে উঠে আসলেও তার রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলোর অধিকাংশই ছিল অদূরদর্শী, অপরিমাণদর্শী ও অপরিপক্ক।
তার সময়েই শুরু হয় বার্লিন দেয়াল নির্মাণ, পশ্চিম জার্মানি থেকে পূর্ব জার্মানিতে যাওয়া আটকাতে। কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, ক্রুশ্চেভ সোভিয়েতদের পরিবর্তিত রাজনৈতিক চরিত্রগুলো বুঝতে ব্যর্থ হন। নেতৃত্বের দক্ষতাতেও ঘাটতি ছিল তার। চীনের সমসাময়িক কমিউনিস্টদের মতে, নিকিতা ক্রুশ্চেভ পুঁজিবাদের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ক্রুশ্চেভের অপরিণামদর্শিতা আর অপরিপক্ক রাজনৈতিক পদক্ষেপের পরিণামগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে বহন করতে হয়েছে, দুই যুগের মধ্যেই রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
তবে, এই রাজনৈতিক ব্যর্থতাগুলোর পরেও, নিকিতা ক্রুশ্চেভের কিছু সাফল্য ছিল। তার সময় থেকেই পাশ্চাত্যের সাথে রাজনৈতিক সহাবস্থান শুরু হয়, ক্রুশ্চেভের সময়েই সোভিয়েত সমাজে উদারীকরণ শুরু হয়, যার চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে সমাপ্ত হয় অর্ধশতাব্দী ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে প্রতিষ্ঠিত হয় পনেরোটি স্বাধীন রাষ্ট্র, রাশিয়া যাত্রা শুরু করে রিপাবলিক হিসেবে।