আয়তনের দিক থেকে রাষ্ট্রকাঠামো তিনটি যুগ পার করেছে। নগরাষ্ট্রের যুগে রাষ্ট্রের আকৃতি ছিল ছোট, সাম্রাজ্যবাদের যুগে সম্রাটদের অধীনে থাকা সাম্রাজ্য তৈরি হতো বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের আকৃতি মধ্যম প্রকৃতির, অধিকাংশ দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে কর সংগ্রহ আর শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য নতুন নতুন রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিতরণের নতুন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।
নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, যারা পাবলিক অফিসগুলোতে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করেন, নেতৃত্ব দেন বেসামরিক প্রশাসনের। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সরাসরি যুক্ত ব্যক্তিদের বলা হয় রাজনীতিবিদ। স্থানীয় প্রশাসনের একজন কাউন্সিলর থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সরকারপ্রধান যেমন রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দলের সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত যুক্ত সকল ব্যক্তিই রাজনীতিবিদ।
বর্তমানে গভর্ন্যান্সের আরেকটি আলোচিত মডেল হচ্ছে কর্তৃত্ববাদ, যেখানে ক্ষমতাসীন সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকে, রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিজেদের অনুকূলে রাখতে ব্যবহার করেছে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ফলে, কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক কাঠামো যেসব ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ব্যবহার করে সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকে, তারাও রাজনীতিবিদ।
রাজনীতিবিদরা কী করেন?
রাজনীতিবিদরা প্রার্থী হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নেন, রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করেন, রাজনৈতিক দলের ইশতেহার তৈরি করেন, সরকার গঠন করলে সেই ইশতেহার তৈরির বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য সকল চেষ্টাই রাজনীতিবিদরা করেন, নির্বাচনী ক্যাম্পেইন পরিচালনার পাশাপাশি ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন।
তবে, রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে কাজ করা। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরোধী দল সরকারের কার্যক্রমকে প্রতিনিয়ত ভারসাম্যের মাঝে রাখে, ক্ষমতার নিরঙ্কুশ ব্যবহার আটকায়, আটকায় রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা।
রাজনীতিবিদদের মিথ্যা বলা
২৬ জানুয়ারি, ১৯৯৮; হিলারি ক্লিনটনকে পাশে নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে মনিকা লিউনস্কির সাথে অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারে বিল ক্লিনটন বলেন, “আমার সাথে মিস লিউনস্কির কোনো ধরনের শারীরিক সম্পর্ক ছিল না।” অথচ, পরবর্তীতে অকাট্য সত্যের মতো প্রমাণিত হয়েছে, বিল ক্লিনটন শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন মনিকা লিউনস্কির সাথে, অনেকবার সম্পর্কে জড়িয়েছেন হোয়াইট হাউজে নিজ অফিসেই।
মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা গেছে বিল ক্লিনটনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশের মাঝেও, টনি ব্লেয়ারের সাথে যোগসাজশ করে ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্রের উপস্থিতির অভিযোগ তুলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন; অগণিত ইরাকি নাগরিক হতাহত হবার পাশাপাশি নিহত হয় হাজারো আমেরিকান সেনা। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে, রাসায়নিক অস্ত্রের উপস্থিতির অভিযোগ ভুয়া ছিল।
একই ধরনের মিথ্যা বলার প্রবণতা পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের রাজনীতিবিদদের মধ্যেই আছে। রাজনীতিবিদগণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে মিথ্যা বলেন, মিথ্যা বলেন বিভিন্ন কারণে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদরা যেমন বিভিন্ন ইস্যুতে মিথ্যা বলেন, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদরা মিথ্যা তৈরি করেন। কিন্তু, রাজনীতিবিদরা কেন মিথ্যা বলেন?
সমর্থক শ্রেণি টিকিয়ে রাখা
রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে হয়, প্রয়োজনে তৈরি করতে হয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সেসব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের সমর্থক শ্রেণি তৈরি করতে হয়। সমর্থকদের মাধ্যমে রাজনীতিবিদরা নির্বাচনে জয়ের পথ তৈরি করেন। অনেক সময়ই দেখা যায়, সমর্থকদের বড় এক অংশের মূল্যবোধের সাথে রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ মিলে না। তখন সমর্থক শ্রেণিকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনীতিবিদদের ক্রমাগত নিজেদের বিশ্বাসের ব্যাপারে মিথ্যা বলতে হয়, সমর্থকদের খুশি রাখার জন্য নির্বাচনী ইশতেহারে সেটি অন্তর্ভূক্ত করতে হয়, বাস্তবায়ন করতে হয় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা গ্রহণ করলে।
যেমন, বারাক ওবামার যে সমর্থক শ্রেণি ছিল, তার মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল যারা সমলিঙ্গের বিয়েতে বিশ্বাস করতো। বারাক ওবামা ব্যক্তিগতভাবে সমলিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে ইতিবাচক না হলেও, সমর্থক শ্রেণিকে খুশি রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে সমলিঙ্গের বিয়ের পক্ষে তাকে কথা বলতে হয়েছে।
রাজনৈতিক অবতারবাদ টিকিয়ে রাখা
তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একটি বড় অংশ অর্পিত থাকে একক ব্যক্তির কাছে। এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে নির্বাহী আর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ক্ষমতা। ফলে, এক ব্যক্তির হাতে অসীম পরিমাণ ক্ষমতা এসে কেন্দ্রীভূত হয়। সমর্থকরা সেই এক ব্যক্তির দর্শনকে অভ্রান্ত বলে মনে করতে থাকে। তার কথাকে চরম সত্য হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করে। তার কাজের পক্ষে নিরঙ্কুশ সমর্থন তৈরি করে রাজপথে।
একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় আসার জন্য এমন রাজনৈতিক অবতার জরুরি, জরুরি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। রাজনৈতিক অবতারদের দেখে সাধারণ ভোটাররা তাদের ভোট প্রদানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন, সিদ্ধান্ত নেন দলীয় সমর্থন দানের ব্যাপারে। ফলে, দলীয় প্রচেষ্টাতেও অনেক সময় রাজনৈতিক অবতারবাদের উত্থান ঘটে।
এরকম একজন রাজনৈতিক অবতার ভুল করেছে স্বীকার করলে সমর্থক শ্রেণির মাঝে ভাঙন ধরতে পারে, ভাঙন ধরতে পারে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির ব্যক্তিগত ইমেজেও। ফলে, যেকোনো মূল্যে সেই রাজনৈতিক অবতারের ইমেজ ধরে রাখার প্রচেষ্টা চলতে থাকে, চলতে থাকে ভাবর্মূতি কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ হলে সেটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। এবং সেটি করতে গিয়ে অধিকাংশ সময়ই মিথ্যা বলেন রাজনীতিবিদেরা, অস্বীকার করেন ব্যর্থতাগুলো। ভুলগুলোকে দাবি করেন মিথ্যা তথ্য বা গুজব হিসেবে, তৈরি হয় সত্য-মিথ্যার ধোঁয়াশা।
যেমন, কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা শাসনতন্ত্র রাজনীতিকরণ করেন, সিভিল সোসাইটি ধ্বংস করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে নিয়ন্ত্রণারোপ করেন, আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিকভাবে অনুগত রাখতে গিয়ে নৈতিক মূল্যবোধ পাল্টে দেন। এসব কারণে একসময় রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে পড়ে, তৈরি হয় দুর্ভিক্ষ আর গৃহযুদ্ধের মতো শাসকসৃষ্ট দুর্যোগ। পরবর্তীতে, সেই শাসকের অনুসারীরা কখনোই শাসকের ভুলগুলোকে স্বীকার করেন না। বরং, ভুলগুলো এড়িয়ে শাসককে মহিমান্বিত করেন, শাসকের ভুলের কারণে সৃষ্ট দূর্যোগের ব্যাপারে নতুন সত্য তৈরি করে রাজনৈতিক ইতিহাসকে বদলে দেন। এই প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন সেই দলের অনুসারী মধ্যম সারির রাজনীতিবিদেরা।
ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধার করা
রাজনীতির পুরো প্রক্রিয়ার সাথেই জড়িয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের কর্তৃত্বমূলক বরাদ্দ পাওয়ার প্রচেষ্টা, নিজের সমর্থক গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের বড় একটি অংশ এনে দেওয়া। এরিস্টটলের দর্শনে গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে চতুর দরিদ্ররা বৈধ আর অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করে, সম্পদ অর্জনের জন্য ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেখা যায়, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে প্রায়ই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, অভিযোগ ওঠে রাষ্ট্রীয় তহবিলের বেআইনি ব্যবহারের। অনেক সময় রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকল্পের আইনি প্রক্রিয়াগুলো পাশ কাটানো হয়, সুগম হয় রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের পথ।
এই ধরনের দুর্নীতির সত্য অভিযোগে ধরা পড়লে সাধারণত কোনো রাজনীতিবিদই স্বীকার করেন না, দুর্নীতি অভিযোগগুলোকে ক্রমাগত দাবি করতে থাকেন বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের অপকৌশল হিসেবে। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বাঁচানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলতে থাকেন রাজনীতিবিদেরা, মিথ্যা বলেন নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো বজায় রাখার জন্যও।
জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা
রাজনীতিবিদরা অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ আর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার রক্ষার ধারণাকে পেছনে ফেলেন, মিথ্যা বলেন জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে। রাষ্ট্রীয় অনেক গোপনীয় তথ্য থাকে, যেগুলো সাধারণ জনগণ জানলে হয়তো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, তৈরি হবে রাজনৈতিক দুর্যোগ। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরেও অনেক ধরনের কোন্দল থাকে, ব্যক্তিগত সংঘাত থাকে, থাকে স্বার্থের সমীকরণ। জনসমক্ষে সেগুলো স্বীকার করা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোকে নেতিবাচক প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত করতে পারে, জনগণকে বাধ্য করতে পারে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর বিশ্বাস হারাতে।
চতুর রাজনীতিবিদদের জন্য তাই কথা বলার কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিথ্যা উত্তর দিতে হবে, এমন প্রশ্নগুলোতে সাধারণত চতুর রাজনীতিবিদেরা এমন উত্তর দেন, যা সত্যও না, আবার মিথ্যাও না। চতুর রাজনীতিবিদরা সাধারণত গণমাধ্যমের সামনে কথা বলেন কম, দেন প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর। অধিকাংশ চতুর রাজনীতিবিদ প্রশ্নের উত্তর তিন শব্দে দেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিতর্ক এড়াতে চান।
রাজনীতিবিদরা মিথ্যা বলা কি বন্ধ করবেন?
ব্যক্তিগত জীবনে আমরা অধিকাংশ মানুষই মিথ্যা বলি, নিজের ব্যক্তিগত জীবন আর সামাজিক জীবনের মধ্যে রাখি সুস্পষ্ট বিভাজন। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ব্যক্তিগত জীবন আর সোশ্যাল মিডিয়ার জীবনেও একই ধরনের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে, মানুষ নিজেকে দুই জগতে দুইভাবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে। রাজনীতিবিদরাও এর ব্যতিক্রম নন, নিজেদের সবচেয়ে পারফেক্ট হিসেবে উপস্থাপনের তাড়া তারাও অনুভব করেন। আবার কাজ করতে গিয়ে ভুলও করেন। কিন্তু, ক্রমাগত নিজেকে পারফেক্ট হিসেবে উপস্থাপনের প্রবণতা রাজনীতিবিদদের মিথ্যা বলতে প্ররোচিত করে।
‘একদল ভালো মানুষ’ একটি ইউটোপিয়ান ধারণা। ফলে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকে হয়তো মিথ্যা কথা বলা বন্ধ করতে পারলেও, রাজনীতিবিদদের পক্ষে সেটি সম্ভব হবে না।