সম্প্রতি ফাঁস হওয়া প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার গোপন ইরানি
ডকুমেন্টের ওপর সংবাদ মাধ্যম ইন্টারসেপ্ট পাঁচ পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছে ইরাকে ইরানের রহস্যময় ভূমিকার অনেক গোপন তথ্য। ইন্টারসেপ্টের এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করেই আমাদের এই ‘ইরান ক্যাবল‘ সিরিজ।
আজ পড়ুন সিরিজের সপ্তম পর্ব। পূর্ববর্তী পর্বগুলো পড়ুন এখান থেকে: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব
ইরানের কুদস ফোর্স হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শিয়াপ্রধান রাষ্ট্র ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডস কোরের একটা অভিজাত ইউনিট। অন্যদিকে মুসলিম ব্রাদারহুড হচ্ছে রাষ্ট্রবিহীন, কিন্তু সুন্নি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সংগঠন। আদর্শিকভাবে দুই সংগঠনের অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। সিরিয়াতে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু এর মধ্য দিয়েই ২০১৪ সালে এই দুই আপাত শত্রু সংগঠন গোপনে একত্র হয় তুরস্কের একটি হোটেলে। তাদের উদ্দেশ্য, উভয়ের সাধারণ শত্রু সৌদি আরবের বিরুদ্ধে একত্রে কাজ করা যায় কিনা, সে সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। গোপন এই বৈঠকের বিস্তারিত তথ্য প্রথমবারের মতো উঠে এসেছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ইরান ক্যাবলে।
মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি যখন মিসরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন ২০১২ এবং ২০১৩ সালে ইরানের সাথে মিসরের বেশ কয়েকটি প্রকাশ্য সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি। ক্ষমতায় এসেই তিনি ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালান। ফলে, এর নেতাদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়, বাকিরা নির্বাসনে চলে যেতে বাধ্য হয়।
সে সময় কুদস ফোর্সেরও খারাপ সময় যাচ্ছিল। জঙ্গি সংগঠন আইসিস একের পর এক ইরাকের সুন্নিপ্রধান এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছিল। তাদের তীব্র আক্রমণের মুখে ইরান সমর্থিত ইরাকি সেনাবাহিনী অসহায়ভাবে পিছু হটছিল। কুদস ফোর্সের পছন্দের ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকির জনপ্রিয়তা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছিল এবং তার পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়ে উঠছিল। এরকম পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষই সম্ভাব্য সব পক্ষের সাথে মিত্রতা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে। ফলে, ধীরে ধীরে দু পক্ষের মধ্যে গোপনে একটি বৈঠকের আলোচনা শুরু হয় এবং ২০১৪ সালের এপ্রিলে তুরস্কের একটি হোটেলে সে বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
যে ব্যাপারটা দুই পক্ষের কেউই জানত না, সে সভায় সবার অলক্ষ্যে উপস্থিত ছিল একজন গুপ্তচর- কুদস ফোর্সের প্রতিদ্বন্দ্বী, ইরানের মিনিস্ট্রি অভ ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি MOIS-এর গুপ্তচর। নথিপত্র থেকে জানা যায়, রেভোল্যুশনারি গার্ডদের অতিরিক্ত ক্ষমতার ব্যাপারে ভীত এবং সন্দিহান MOIS সবসময়ই তাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানোর চেষ্টা করে এসেছে। তাদের কমান্ডাররা কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, কী আলোচনা করছে, তা জানার জন্য MOIS ঐ সভায় নিজেদের একজন এজেন্টকে প্রেরণ করে। নথিগুলো থেকে দেখা যায়, ঐ এজেন্ট শুধু সভায় উপস্থিতই ছিল না, সে কুদস ফোর্সের হয়ে ঐ মিটিংয়ের কো-অর্ডিনেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিল। কিন্তু সভাশেষে সে প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিয়েছিল MOIS-এর সদর দপ্তরে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সভাটির স্থান হিসেবে তুরস্ককে বাছাই করা হয়েছিল, কারণ তুরস্কই ছিল একমাত্র রাষ্ট্র, যাদের সাথে উভয় পক্ষের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু, তারপরও তুরস্কের সরকার নিজেদের দেশে ইরানি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ফলে তারা কুদস ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সোলায়মানির অনুপস্থিতিতে বৈঠকে ইরানি দলের নেতৃত্ব দেন তার একজন ডেপুটি, আবু হুসাইন। অন্যদিকে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিত্ব করেন এর তিনজন বিখ্যাত মিসরীয় নেতা: ইবরাহিম মুনির মুস্তাফা, মাহমুদ আল-আবিয়ারি এবং ইউসেফ মুস্তাফা নাদা। নাদা অবশ্য পরবর্তী সময়ে ইন্টারসেপ্টের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তার উপস্থিতির কথা অস্বীকার করেন।
MOIS-এর গুপ্তচরের পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে সভায়্য মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্য শুরু করেছিলেন নিজেদের সংগঠনের অর্জন নিয়ে গর্ব করার মধ্য দিয়ে। তারা উল্লেখ করেন, বিশ্বের ৮৫টি দেশে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালু আছে। তারা বলেন, শিয়া বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে ইরানের এবং সুন্নি বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যকার পার্থক্য পরিষ্কার। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির বিবেচনায় দু’ পক্ষের মধ্যে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা আছে।
যে বিষয়টিতে ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেন, তা ছিল তাদের উভয়ের মধ্যেই তাদের ‘সাধারণ শত্রু’ সৌদি আরবের প্রতি বিদ্বেষ আছে। তারা প্রস্তাব করেন, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে দু’ পক্ষ একত্রে কাজ শুরু করতে পারে। এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হতে পারে ইয়েমেন, যেখানে ইরান সমর্থিত হুথিদের সাথে সৌদি সমর্থিত ইয়েমেনের সরকারি বাহিনীর মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলছে। ব্রাদারহুডের নেতারা বলেন,
“ইয়েমেনে হুথিদের উপর ইরানের প্রভাব এবং সশস্ত্র সুন্নি গোত্রগুলোর উপর ব্রাদারহুডের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করা উচিত।”
একইসাথে ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিরা ইরাকে শান্তি স্থাপনেরও দাবি জানান। তারা সেখানে শিয়া-সুন্নি বিভাজন হ্রাস করে, সুন্নিদেরকে ক্ষমতার অংশীদার করে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে কুদস ফোর্সকে অনুরোধ করেন। কিন্তু ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিরা এটাও জানতেন, তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার একটা সীমা আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিরিয়ার পরিস্থিতি এতই জটিল, তারা সে ব্যাপারটা আলোচনাতেই আনতে চাননি। তাদের বক্তব্য ছিল, সিরিয়ার পরিস্থিতি ইরান এবং ব্রাদারহুড, উভয়েরই নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে।
নথি থেকে আরও দেখা যায়, যদিও মুসলিম ব্রাদারহুডকে মাত্র এক বছর আগেই অন্যায়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা করা হয়েছিল, তবুও তাদের নেতারা মিসরে তাদেরকে সাহায্যের জন্য ইরানের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা গ্রহণ করবেন না বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবত এ কারণে যে, ইরানের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করলে মিশরে সেটা তাদের বিরুদ্ধে ঋণাত্মক প্রচারণায় ব্যবহৃত হতে পারে।
ইরানের সাথে সহযোগিতার ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও ব্রাদারহুডের নেতারা কুদস ফোর্সকে অপমান করতেও ভোলেননি। ডকুমেন্ট থেকে দেখা যায়, তারা উল্লেখ করেছিলেন, তারা মধ্যপ্রাচ্যকে পরিবর্তনের জন্য ‘সংস্কারমূলক এবং শান্তিপূর্ণ’ পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। তারা এমনভাবে কথাটা বলেছিলেন, যা ইঙ্গিত করে যে, কুদস ফোর্স শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণ করছে না। একইসাথে তারা এটাও উল্লেখ করেন যে, তারা নিজেদেরকে ‘ইরানিদের চেয়ে অনেক বেশি ধৈর্যশীল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বাস্তবেও ঐতিহাসিকভাবেই মুসলিম ব্রাদারহুড সবসময় সহিংসতাবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে এসেছে। এর বিপরীতে কুদস ফোর্স হচ্ছে একটা সামরিক সংগঠন। সম্ভবত এ কারণেই ট্রাম্প প্রশাসনও ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করতে এবং এর ওপর অবরোধ দিতে চাইলেও ভেতরে-বাইরে প্রচণ্ড সমালোচনার কারণে শেষপর্যন্ত সফল হয়নি।
কিন্তু তারপরেও এ ধরনের বৈঠকে প্রতিপক্ষকে এভাবে ইঙ্গিত করে কথা বলা স্বাভাবিক না। এ থেকে বোঝা যায়, সম্ভবত মিটিংয়ের শেষদিকে এসে ব্রাদারহুডের নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন এই মিটিং অর্থবহ হবে না। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের সাথে সহযোগিতা করার ব্যাপারে কুদস ফোর্সের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। বাস্তবেও বৈঠক শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, কুদস ফোর্সের সাথে মিটিংয়ে যেসব ইরানি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, তারা শিয়া এবং সুন্নিদের মধ্যে কোনো ধরনের ঐক্যের ব্যাপারে বিরোধী ছিলেন।
এই মিটিং ব্যর্থ হলেও MOIS-এর গুপ্তচর তার রিপোর্টের শেষে উল্লেখ করেছিল, সে পরবর্তী যেকোনো সভায় যোগ দিতে পুনরায় তুরস্কে কিংবা বৈরুতে যেতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু সেরকম কোনো সভা আদৌ অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা, নথিগুলো থেকে তা জানা যায়নি।
মূল প্রতিবেদক: জেমস রাইজেন
প্রকাশের তারিখ: ১৮ নভেম্বর, ২০১৯
আগামী পর্বে থাকছে আমেরিকা কীভাবে ইরাককে ধ্বংস করে ইরানের হাতে তুলে দিয়েছিল, সে ইতিহাস।
সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/