২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো সৌদি আরবের কোনো বাদশাহ হিসেবে সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ রাশিয়া সফর করেন। রাজকীয় এই সফরে তার সাথে ছিলেন ১,৫০০ জন সফরসঙ্গী। সেই সাথে তিনি মস্কো পৌঁছানোর পর বিমান থেকে নামার জন্য দেশ থেকে নিয়ে যান সোনায় মোড়ানো চলন্ত সিঁড়ি। সফরসঙ্গীদের থাকার জন্য ভাড়া করেন মস্কোর দুটি হোটেল। এসব কারণে বিশ্বজুড়ে বাদশাহ সালমানের এই সফরটি বেশ আলোচিত হয়। তবে সফরের এসব খুঁটিনাটি বিষয়ের বাইরে কূটনৈতিক দিক দিয়েও তার সফরটি ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ তার পূর্বসূরিরা সৌদি আরবের নিরাপত্তার জন্য প্রথমে ব্রিটেন এবং পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল।
কিন্তু বাদশাহ সালমান যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রাশিয়ার সাথেও সম্পর্ক তৈরিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে রাশিয়া সফর করেন। সেই সময় রাশিয়ার কাছে থেকে ৩০০ কোটি ডলারের অস্ত্র কেনার জন্য চুক্তি করে সৌদি আরব। এর মধ্যে রয়েছে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থাসহ আরো বেশকিছু অস্ত্রসস্ত্র। সেই সাথে ১০০ কোটি ডলারের জ্বালানি এবং আরো ১০০ কোটি ডলারের উচ্চ-প্রযুক্তি খাতের চুক্তি সম্পন্ন করে রাশিয়া ও সৌদি আরব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে সৌদি আরব রাশিয়ার সাথে ওতপ্রোত সম্পর্কে জড়াবে সেটা অনেকেই ভাবেনি। কিন্তু সৌদি আরব মূলত রাশিয়ার প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের শক্তিসামর্থ্যকে আরো বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
সৌদি বাদশাহর পর ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানও মস্কো ঘুরে এসেছেন। তার সফরের সময়ও রাশিয়ার সাথে বেশ কিছু চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। ক্রেমলিনের সাথে বর্তমানে সৌদি আরবের যে দহরম-মহরম চলছে সেটা খুবই অল্প দিনের। এর আগে দীর্ঘদিন রাশিয়ার সাথে সৌদি আরবের কোনো প্রকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। ২০০৩ সালে সৌদি আরবের পূর্ববর্তী বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ (তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স) রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করার জন্য সচেষ্ট হন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে বর্তমান বাদশাহ এবং তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স সালমান বিন আবদুল আজিজ রাশিয়া সফর করেন। অথচ ১৯২৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি রাজতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে জোসেফ স্টালিনের উত্থান এবং তার হাতে দুজন মুসলিম রুশ রাষ্ট্রদূতের মৃত্যুকে ঘিরে মস্কো ও রিয়াদের মধ্যকার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।
মস্কো ও রিয়াদের সুসম্পর্কের প্রথম অধ্যায়
গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে মস্কো ও রিয়াদের মধ্যে বেশ উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ ইবনে সৌদকে হেজাজ ও নজদের রাজা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। গত শতকের প্রথম থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান শক্ত করা এবং ব্রিটিশদের মোকাবেলা করার জন্য নিজেদের মিত্র তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারই ধারাবাহিকতায় পারস্য উপসাগরে সোভিয়েত জাহাজের আনাগোনা বাড়তে থাকে এবং তারা কুয়েতে একটি ঘাঁটিও তৈরি করে। ১৯০১ সালে রাশিয়ার বিখ্যাত ভারইয়াগ ক্রুজার কুয়েতে নোঙর করে এবং সেই জাহাজের নাবিককে আমির মুবারাক আল সাবাহর পক্ষ থেকে অভিবাদন জানানো হয়। সেই সময় রাশিয়ানদের সাথে আবদুর রহমান আল সৌদ ও তার ছেলে আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের সাথে পরিচয় হয়। আবদুর রহমান তখন কুয়েতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন।
এর এক বছর পর আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ রিয়াদ জয় করেন। তিনি সেখান থেকে রশীদিদের হটিয়ে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার বিদেশিদের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। ব্রিটিশরা তখন আবদুল আজিজের প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। সে কারণে তারা তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। ফলে তরুণ আবদুল আজিজ মস্কোর দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। এবং আবদুল আজিজ পারস্যের বুশেহের শহরে থাকা রাশিয়ান দূতকে তার সাথে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ১৯০৩ সালে রাশিয়ার সামরিক জাহাজে করে কুয়েতে আসেন রুশ দূত। রুশরা আবদুল আজিজের ডাকে সাড়া দিলেও তারা তখনও পারস্য উপসাগরে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেনি। এছাড়া তখনও মক্কা ও মদিনার কর্তৃত্ব ছিল শরীফ হুসেইনের হাতে, যার মুসলিম বিশ্বের উপর অধিক কর্তৃত্ব ছিল।
ব্রিটিশদের সাথে শরীফ হুসেইনের গভীর সম্পর্ক থাকলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে মতভেদ প্রকট হয়ে ওঠে। এ কারণে তিনিও রোমে দূত পাঠিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আলোচনা শুরু করেন। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিনিধি জর্জি চিচেরিন মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে বুঝতে পারেন। কিন্তু আরবদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করার জন্য একজন মুসলিম দূতের প্রয়োজন ছিল। সে কারণে ১৯২৪ সালে করিম খাকিমভকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত হিসেবে জেদ্দায় পাঠানো হয়। তিনি ছিলেন একজন তাতার মুসলিম।
খাকিমভ জেদ্দায় নামার আগেই আবদুল আজিজ হেজাজ জয় করেন। ফলে তিনি বেশ বড় সমস্যায় পড়ে যান। তিনি মক্কার শরীফ হুসেইনকে সমর্থন জানাবেন নাকি আবদুল আজিজকে সমর্থন জানাবেন সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। তখন এই সোভিয়েত প্রতিনিধি প্রকাশ্যে কারো সমর্থন না জানিয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার জন্য তাকে মস্কো থেকে পাঠানো হয়েছে বলে উভয় পক্ষকে জানান। কিন্তু ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আবদুল আজিজ যখন মক্কার দখল নেন, তখন খাকিমভ তার সমর্থনকে প্রকাশ্যে আনেন। তিনি আবদুল আজিজের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য তার সাথে সাক্ষাত করতে চান।
১৯২৫ সালের এপ্রিলে জেদ্দা যখন প্রায় আবদুল আজিজ আল সৌদের অধীনে, তখন করিম খাকিমভ মক্কায় ওমরাহ হজ্ব পালনের অনুমতি পান। সেখানে তিনি আবদুল আজিজের সাথে দেখা করেন এবং বেশ ইতিবাচকভাবে তাদের আলাপ আলোচনা সম্পন্ন হয়। ১৯২৫ সালের শেষ দিকে আবদুল আজিজ জেদ্দা জয় করেন এবং ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিজেকে হেজাজের বাদশাহ এবং নজদের সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। এই খবর শোনামাত্র রাশিয়ানরা তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯২৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি করিম খাকিমভ তার সোভিয়েত পতাকাবাহী ব্যক্তিগত গাড়িতে করে জেদ্দা থেকে আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের বাসভবনে যান। সেখানে তিনি সোভিয়েত সরকারের পক্ষ থেকে ইবনে সৌদকে দেওয়া স্বীকৃতিপত্র তুলে দেন।
পরবর্তীতে মস্কোর সাথে রিয়াদের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার হতে থাকে। আর এই সম্পর্ক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখেন করিম খাকিমভ। ১৯২৮ সালে তার জায়গায় সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সৌদি আরব আসেন আরেক মুসলিম নাজির বে তুরইয়াকুলভ। তিনিও তার পূর্বসূরি খাকিমভের মতোই সফল হন। তার সময়ে বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ রুশ পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ব্রিটেনের প্রভাবে দীর্ঘদিন সৌদি আরবে এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। এছাড়া সৌদির কেরোসিন ও বেনজিনের বাজারে ব্রিটিশদের একচেটিয়া প্রভাব হ্রাস করার ক্ষেত্রেও তুরইয়াকুলভ বড় ভূমিকা পালন করেন।
দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি
১৯৩২ সালে বাদশাহ আবদুল আজিজ মস্কোর আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব ফেরত দেন। বিপরীতে তিনি ব্রিটিশদের সহায়তা গ্রহণ করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে আর কোনো সহায়তা না নেওয়ার অঙ্গীকার করেন। বাদশাহর হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের পেছনে বড় কারণ ছিল ব্রিটেনের কাছে থাকা তাদের ঋণ। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তের কারণে মস্কোর সাথে রিয়াদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
এদিকে জোসেফ স্টালিনের ক্ষমতা বাড়ার সাথে মুসলিম বিশ্বের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৩২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন অনানুষ্ঠানিকভাবে মুসলিমদের হজ্বের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে সৌদিতে তখনও তাদের মিশনগুলো চলমান ছিল। দুই দেশের মধ্যকার তিক্ততা দূর করার জন্য করিম খাকিমভ আবারও জেদ্দায় ফিরে আসেন। এর আগে তিনি বেশ কয়েক বছর ইয়েমেন ও মস্কোতে কাজ করেন। খাকিমভ সৌদি বাদশাহর সাথে নতুন করে বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু মস্কোর এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না।
স্টালিন সৌদি আরবের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ককে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখতেন। তার মতে বাদশাহ আবদুল আজিজের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে সম্পর্ক সেটা থেকে কোনোভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। উল্টো কখনো যদি সম্পর্কের অবনতি ঘটে তাহলে সেটা তাদের প্রতিপক্ষ ব্রিটেনকে সুবিধা দেবে। এর ফলে ১৯৩৭ সালে আরব বিশ্বে কাজ করা সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতরা স্টালিনের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হন।
সে বছর সেপ্টেম্বরে করিম খাকিমভকে মস্কোতে ডেকে পাঠানো হয়। এটি ছিল তার নিয়মমাফিক সফর। কিন্তু মস্কো পৌঁছানোর পর তাকে এবং তার সহযোগী তুরইয়াকুলভকে আটক করা হয়। তাদের দুজনের বিরুদ্ধে নিয়ম বহির্ভূত গোয়েন্দাগিরি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে তুরইয়াকুলভকে এবং করিম খাকিমভকে তার পরের বছর জানুয়ারিতে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। তবে তারা কোনো রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেননি। মূলত তাতার মুসলিমদের প্রতি স্টালিনের যে ক্ষোভ, তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল দুজন মুসলিম রাষ্ট্রদূতের মৃত্যুদণ্ড।
এই খবর শোনার পর বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কারণ খাকিমভ ও তুরইয়াকুলভকে সৌদি বাদশাহ নিজের বন্ধু মনে করতেন। খাকিমভের মৃত্যুদণ্ডের দুই মাসের মাথায় মার্কিন ভূতত্ত্ববিদরা সৌদি আরবের দাহরানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেলের খনির সন্ধান পায়। আর এই খবরে নড়েচড়ে বসে মস্কো। তারা জেদ্দায় নতুন রুশ রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সৌদি বাদশাহ তাতে অসম্মতি জানান। তিনি খামিকভ ও তুরইয়াকুলভের জায়গায় অন্য কাউকে দেখতে চান না বলে জোর গলায় বলে দেন। পরবর্তীতে সৌদি আরবে থাকা অন্যান্য রুশ কর্মকর্তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এবং সৌদি আরবের সাথে সৌভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও রিয়াদের পক্ষ থেকে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়নি। অবশেষে সেই বন্ধ্যাত্বের অবসান ঘটেছে ২০১৭ সালে। তবে সেটা কতদিন স্থায়ী হবে সেটাও দেখার বিষয়, কেননা রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক একেবারে সাপে-নেউলে।