জেমস বন্ড। নামটি সবার বিলক্ষণ পরিচিত। সুপুরুষ ও সৌম্যকান্তি, দুর্ধর্ষ গুপ্তচর, নারীদের চোখের মণি এই চরিত্রটিকে নানা ভঙ্গিমায় বহু বছর ধরে চলচ্চিত্রে দেখানো হচ্ছে। গুপ্তচর ও গুপ্তচরবৃত্তিকে ঘিরে যে গ্ল্যামার, তার বড় একটা অংশ এই জেমস বন্ডকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। এহেন চরিত্র কিন্তু পর্দার পাশাপাশি বাস্তব জগতেও ছিল। আজ এমনই একজনের গল্প শোনাবো। রিচার্ড সোর্গে নাম্নী এই ব্যক্তি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুপ্তচর হিসেবে বিবেচিত। জেমস বন্ড চরিত্রটিও অনেকাংশে রিচার্ড সোর্গের ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত।
সোভিয়েত নেতা ট্রটস্কি চেয়েছিলেন বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে। সেই লক্ষ্যে গড়া হয়েছিল দুর্ধর্ষ এক গুপ্তচর বাহিনী। রিচার্ড সোর্গে ছিলেন এদের অন্যতম। ট্রটস্কি পরে ক্ষমতার দাবা খেলায় হেরে যান। ফলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ট্রটস্কিপন্থী গুপ্তচরেরা ঈর্ষণীয় সাফল্য পেলেও সোভিয়েত উচ্চপর্যায়ে এদেরকে বেশ বিপজ্জনক হিসেবে দেখা হতো। অনেকটা এ কারণে সঠিক তথ্য দিলেও বহু ক্ষেত্রে সোর্গে আর তার সহকর্মীদের অবদান এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেককেই তিরিশের দশকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়। স্ট্যালিন নিজেও এদের তেমন বিশ্বাস করতেন না। তবে স্ট্যালিনের মুখ্য গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডি সোর্গেকে নির্ভরযোগ্য হিসেবেই দেখতো।
কে এই সোর্গে
রিচার্ড সোর্গে ওরফে রামসের জন্ম রুশ সাম্রাজ্যের ককেশাস পার্বত্য অঞ্চলে (বর্তমানের আজারবাইজান)। ১৮৯৫ সালে। প্রবাসী জার্মান পিতা আর রুশী মাতার সন্তান। তার চাচা সম্পর্কিত ঠাকুর্দা ছিলেন কার্ল মার্ক্স এর সেক্রেটারি। প্রথম জীবনে জার্মান সেনাদলে যোগ দিয়ে বিশ্বযুদ্ধে লড়েন। বেজায় আহত হয়ে ফেরত আসেন ও কম্যুনিস্ট ভাবধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। পিতার মতোই শুরুতে কট্টর জাতীয়তাবাদী হলেও পরবর্তী জীবনে সমাজতন্ত্রের সেবাকে ধ্যান-জ্ঞান করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি গুপ্তচরবৃত্তি করতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে। জার্মানী আর চীনে গুপ্তচরগিরিতে সাফল্য পাওয়ার পর তাকে পাঠানো হয়েছিল জাপানে। সেখানেই মৃত্যু হয় ১৯৪৪ সালে।
নীল চোখের দীর্ঘদেহী, সুদর্শন সোর্গে গুপ্তচরগিরিতে নিজের রমণীমোহন চেহারাটি কাজে লাগাতে ভুল করেননি। বস্তুত এ বাবদ তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি হাতিয়ে নিতেন। বেপরোয়া মোটরসাইকেল দাবড়ে বেড়ানো ছিল শখ। বোহেমিয়ান হাবভাবের এই গুপ্তচর মদ গিলতেন দেদার, শিকারকে মাতাল করে টাপেটোপে তথ্য বের করে নিতেন আর তার ক্যারিশমার জালে আকছার আটকাতেন মেয়েদেরকে। খোদ জার্মান রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীকে বশ করে হাতিয়ে নিয়েছেন গোপন নথিপত্র। ছায়াছবির গুপ্তচরদের সাথে বাস্তবের এমন মিল কমই পাওয়া যায়।
জার্মানী ও চীন
সোর্গে ছোটবেলায় পিতার সাথে জার্মানীতে চলে আসেন। সেখানে প্রথম মহাযুদ্ধ যুদ্ধ শেষে অর্থনীতি আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরে জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দেওয়ার কারণে তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। চলে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। গুপ্তচরগিরির হাতেখড়িও সেখানেই শুরু। ইংল্যান্ড, স্ক্যাণ্ডিনেভিয়া আর তুরস্কে কিছুকাল কাজ করেছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে সোর্গে জিআরইউ অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল গোয়েন্দা সংস্থাতে যোগ দেন। এদের নির্দেশে তিনি জার্মান পত্রিকা ‘ফ্রাংকফুর্টের জেইতুং’ এর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩০ সালে তাকে সাংহাইতে পাঠানো হয়। কৃষি সম্পর্কিত ব্যাপারে ছিলেন বিশেষজ্ঞ। বই লিখেছেন, লেখক হিসেবেও সুনাম ছিল। সাংবাদিকতার আড়ালে চলতো গোয়েন্দাগিরি। চীনা সমাজতান্ত্রিকদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন।
হিটলার ক্ষমতায় আসলে পরে সোর্গে জার্মানীতে যেয়ে নাৎসী পার্টির কর্তাদের সাথে দহরম মহরম গড়ে তোলেন। নাৎসীপন্থী লেখক-সমালোচক হিসেবেও প্রচুর নাম কামান। স্বয়ং জার্মান প্রোপাগাণ্ডা মন্ত্রী, হের গ্যোয়েবলস পর্যন্ত সোর্গের গূনমুগ্ধ ছিলেন। কেও ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করেনি এই লোক সোভিয়েতের গোয়েন্দা। সোভিয়েতকে প্রকাশ্যে গাল পাড়তেন আর নাৎসী পার্টির প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। হিটলারের মেইন ক্যামফ ঝাড়া মূখস্ত করেছিলেন।
জাপান
১৯৩৩ সালে সোর্গে নাৎসী পার্টির ঘনিষ্ঠ সংবাদদাতা হিসেবে জাপানে হাজির হন। চীনে থাকাকালীন সোর্গের সাথে পরিচয় হয় হজুমী ওসাকি নামের এক জাপানীর। কোনভাবে এই ওসাকি পরে জাপানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স কনোয়ের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন হন। ক্লাইউজেন নামের আরেক জার্মান গুপ্তচর ও সোর্গের সাথে কাজ করতেন। আর জার্মান দূতাবাসের অসংখ্য কর্মচারী, ডাঙর কর্মকর্তা ও অবশ্যই কর্মকর্তাদের বৌ এর সাথেও সোর্গে হৃদ্যতা গড়ে তোলেন। গড়ে ওঠে শক্তিশালী গোয়েন্দা চক্র।
যাহোক, সোভিয়েত ইউনিয়নে সে আমলে সবাই ভাবতো এই বুঝি জাপান হামলা চালিয়ে বসে। কাজেই সোর্গের মূল কাজ দাঁড়ালো জাপানী কর্তাদের অন্ধি-সন্ধি বের করা। পাশাপাশি মোটর ব্যবসাও শুরু করেন, টাকাও নাকি কামাচ্ছিলেন বেশ। ওপরে ওপরে অবশ্য সবাই তাকে গোড়া নাৎসী বলে চিনতো। জাপানীদের অত্যধিক গোপনীয়তার কারণে খোদ জার্মানরা তাদের নিয়ে কিঞ্চিত দ্বিধায় ভুগতো। সোর্গে দুই পক্ষেই তাল মেলাতে থাকেন। তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বেশ নিখুঁত হওয়ায় জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্তারা সোর্গেকে তোয়াজ করে চলতো।
সোর্গের কৃতিত্ব
সোর্গের গুপ্তচরগিরির সবসেরা দুটি কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন জাপানে। সেগুলি হল
১। সোর্গে খবর পাঠিয়েছিলেন হিটলার আচমকা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসবে।
১৯৩৯ এর আগস্টে মলোটোভ-রিবেনট্রপ অনাক্রমণ চুক্তির পর সোভিয়েত ইউনিয়ন আর জার্মানী মিলে হতভাগ্য পোল্যান্ডকে ভাগ করে নেয়। দেশ দুটি নিজেদের মধ্যে লড়াই করবে না; এই ছিল চুক্তির মূলকথা। কিন্তু সোর্গে চুক্তিভঙ্গের সম্ভাবনার কথা তো জানিয়েছিলেনই, সাথে অনুমান করেছিলেন জার্মান আক্রমণ ঘটবে ১৯৪১ এর ২০ জুন। সোর্গে আরো জানান যে জার্মানরা অন্তত দেড়শো ডিভিশন সৈন্য সোভিয়েত সীমান্তে মজুত করছে। তাকে সমর্থন দেয় ধুরন্ধর গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডি। কিন্তু স্বয়ং স্ট্যালিন এই ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস করেননি। আর হিটলার সোভিয়েতে হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন অত্যন্ত সঙ্গোপনে, জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তর তো বটেই, এমনকি মুসোলিনি পর্যন্ত এটা জানতেন না।
যথারীতি হিটলার চুক্তি ভেঙ্গে আক্রমণ করে বসেন, সোভিয়েত কর্তারা হতচকিত হয়ে যায়। ২০ জুনের পরিবর্তে হামলা হয়েছিল মাত্র দুদিন পর, ২২ জুন। ঠিক কী উপায়ে এই খবর সোর্গে যোগাড় করেছিলেন বলা শক্ত। সেকালে জাপান-জার্মানি সরাসরি যোগাযোগ ছিল না আর জার্মানীর খবর গোপনে বেতারে পাওয়াও ছিল প্রায় অসম্ভব। কাজেই সোর্গে সম্ভবত খুব উচুঁ পর্যায়ের জার্মান নেতৃত্বের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করতে পেরেছিলেন।
২। সোর্গে নিশ্চিত ছিলেন জাপান কখনো সোভিয়েত ভূখণ্ডে হামলা চালাবে না।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবর জাপানী হামলার ভয় পেত। ১৯০৫ এ জাপানীরা রুশদের যে বেধড়ক মার দিয়েছিল তাতে তো গোটা বিশ্বই অবাক হয়ে যায়। আর জাপানের ভয়েই বিরাট একটা সেনাদলকে সোভিয়েত দূরপ্রাচ্যে মোতায়েন রাখা হয়েছিল। পরে জাপান মাঞ্চুরিয়া দখল করে নিলে জাপানী হামলার আশঙ্কা আরো বৃদ্ধি পায়। হিটলার নিজেও বারবার জাপানকে সোভিয়েতে হামলার জন্য উসকে দিয়েছেন।
কিন্তু এই সোর্গেই বারবার আশ্বস্ত করেন যে জাপান কখনো সোভিয়েত ভূমিতে হামলা চালাবে না। সীমান্তে দু-পাঁচটা গোলাগুলি আখছার ঘটলেও তা যুদ্ধে গড়াবার সম্ভাবনা নেই। যাহোক, সোর্গের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সোভিয়েতরা তাদের বিরাট বাহিনী পশ্চিম সীমান্তে চালান দেয়। বাড়তি সেনাদল আর ভয়ংকর শীতের প্রভাবে মস্কোর যুদ্ধে প্রথমবারের মত ভরাডুবি ঘটে জার্মান সৈন্যদের। অবশ্য অনেকের ধারণা সোভিয়েত কর্তারা জাপানী সাংকেতিক বার্তা থেকে জাপানী পরিকল্পনা আগেভাগে জেনে গিয়েছিলেন। জাপান সোভিয়েত ইউনিয়নে হামলা না চালিয়ে মনোযোগ দেয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।
পতন
বেশ কিছুকাল ধরে জাপানীরা শক্তিশালী গোয়েন্দা চক্রের উপস্থিতি টের পাচ্ছিল। ১৯৪১ এর ১৭ অক্টোবর পরিচিতজনের বিশ্বাসঘাতকতায় সোর্গে গ্রেফতার হন। কিছুদিন ধরেই তার ওপর নজরদারী চলছিল। মাসখানেক আগেই কনোয়ে, যাকে দুইয়ে সোর্গে আর ওসাকি হাড়ির খবর চালান দিতেন, পদত্যাগ করেছেন, সম্ভবত এহেন কেলেংকারীর খবর পেয়েই। যাহোক, জাপান চেয়েছিল সোর্গের বিনিময়ে সোভিয়েতের হাত থেকে বন্দী জাপানী গুপ্তচরদের ফেরত নিতে। কিন্তু তখন যুদ্ধের মৌসুম, তাছাড়া গুপ্তচরদের সম্বন্ধে অস্বীকৃতি জানানোই চিরকালের রেওয়াজ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোর্গের দায় নিল না। শুধু তাই নয়, তার স্ত্রী কাতিয়াকে ধরে জার্মান গুপ্তচর সন্দেহে গুলাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৪৪ সালের ৭ নভেম্বর রিচার্ড ‘রামসে’ সোর্গেকে টোকিও এর কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়।
মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল ধরে সোর্গে সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্রাত্য ছিলেন। ফাঁসিতে ঝোলাবার প্রায় বিশ বছর পর, পূর্ব জার্মানীতে গুপ্তচরদের এক মহা সম্মেলন হয়। সেখানে ঘটা করে সোর্গের গুণগান গাওয়া হলে বিশ্ব এই দুর্ধর্ষ গুপ্তচরের কথা জানতে পারে। তাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান, হিরো অব দ্যা সোভিয়েত ইউনিয়ন খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে।