একসময়ের প্রভাবশালী অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরসূরী বর্তমান তুরস্ক। সেই অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সিরিয়া। শুধু বর্তমান সিরিয়া নয়, তিন মহাদেশে উসমানীয় সুলতানদের প্রভাব ছিল। কালের বিবর্তনে একসময় দুর্বল হয়ে পড়ে ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী এই সাম্রাজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারের পর অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।
বাংলায় একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘নদী শুকিয়ে গেলেও তার চিহ্ন থেকে যায়।’ তেমনি একসময়ের শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্য হারিয়ে গেলেও তাদের উত্তরসূরী তুর্কিদের প্রভাব কিন্তু একেবারেই কমে যায়নি। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের রিপোর্ট অনুযায়ী, সামরিক শক্তিতে তুরস্ক বর্তমানে বিশ্বের ১১তম রাষ্ট্র।
তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান চাইছেন তাদের হারানো সাম্রাজ্য আবারো ফিরিয়ে আনতে। তিনি হয়তো হারানো ভূখণ্ড ফেরত পাবেন না। কিন্তু তবুও নিজেকে অটোমান সুলতানদের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বনেতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। যদিও দেশে তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে।
হঠাৎ করেই এরদোয়ানকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ। সিরিয়ার হামলায় এখন পর্যন্ত ৫০ জনের বেশি তুর্কি সেনা নিহত হয়েছেন। যদিও বাস্তবিক অর্থে তুরস্ককে মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা আসাদ সরকারের নেই। তারা এই সাহসিকতা দেখিয়েছে রাশিয়ার মদদে। রাশিয়া তুরস্কের ঐতিহাসিক শত্রু ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এরদোয়ান ও পুতিন বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন। তবে তাদের দুজনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন পরীক্ষার সম্মুখীন।
এরদোয়ান নিজের গদি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সিরিয়াকে শক্ত জবাব দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তুর্কি হামলায় সিরিয়ার অন্তত ২,৫০০ সেনা মারা গেছে বলে দাবি করছে তুরস্ক। প্রকৃত সংখ্যা এত বেশি না হলেও অন্তত কয়েকশ সেনা তুর্কি বিমান হামলায় নিহত হয়েছে। পাশাপাশি তিনটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে তুরস্কের সেনারা।
তবে ইদলিবে যুদ্ধের হিসাবনিকাশ পুরোপুরি পাল্টে দিচ্ছে তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ড্রোন। সিরিয়ার হামলার পর এরদোয়ানের নির্দেশে যে পাল্টা আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ড্রোনগুলো। যুদ্ধের ময়দানে তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এসব ড্রোন দেশটির আত্মবিশ্বাস অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে তুরস্ক নিজস্ব প্রযুক্তিতে অস্ত্র তৈরির ওপর জোর দিয়েছে। এদিক থেকে তারা বড় এক সাফল্যই অর্জন করেছে বলা যায়।
তুর্কি ড্রোনগুলো যেভাবে হামলা চালাচ্ছে
ইদলিবে তুরস্কের সেনাদের ওপর সিরিয়ার হামলার পর বেশ নড়েচড়ে বসেন এরদোয়ান। এরপর তার নির্দেশে তুর্কি সেনারা সর্বাত্মক হামলা শুরু করে। তবে সিরিয়ার বিপক্ষে হামলার জন্য তুরস্ক তাদের যুদ্ধবিমানের চেয়ে ড্রোনগুলো বেশি ব্যবহার করছে। যাকে সামরিক ভাষায বলা হয় ‘আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকালস’, সংক্ষেপে ‘ইউএভি’। তবে এগুলো ড্রোন হিসেবেই অধিক পরিচিত।
কয়েক দশক ধরে সামরিক ড্রোনগুলো গোয়েন্দাগিরি, নজরদারি ও পরিদর্শন বা নিরীক্ষার কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়া গুপ্তহত্যার কাজেও দেখা যাচ্ছে সামরিক ড্রোনের ব্যবহার। তবে ব্যবহারের ব্যপ্তিতে বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে তুর্কি সেনারা। প্রথম সেনাবাহিনী হিসেবে তারা বৃহৎ আকারে শত্রুপক্ষের সেনাদের বিরুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করছে।
তুরস্কের ড্রোনগুলো সিরিয়ার আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেগুলো একইসাথে নজরদারি ও হামলার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। মূলত তুরস্কের এই ড্রোনগুলো ইদলিবে যুদ্ধ পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে।
তুরস্ক এর আগে ২০১৮ সালে সিরিয়ান কুর্দিদের বিপক্ষে ‘অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চ’ চালানোর সময় ড্রোন ব্যবহার করেছিল। তবে এবারই প্রথম তারা নিজেদের তৈরি আঙ্কা-এস এবং বায়রাকতার-টিবি টু ড্রোন ব্যবহার করছে।
তুরস্কের এসব ড্রোন শুধু নির্দিষ্ট করে সিরিয়ার সেনাদের অবস্থান ও সেনাবহরে হামলা করছে না। পাশাপাশি সেগুলো আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন এলাকার অভ্যন্তরে হামলা করছে। এছাড়া আলেপ্পো ও হামা শহরের সামরিক বিমানবন্দরেও হামলা চালাচ্ছে তুর্কি ড্রোনগুলো। তুরস্কের সেনাবাহিনী অবশ্য ড্রোনের মাধ্যমের সিরিয়ার সেনাদের হত্যা করেই সন্তুষ্ট নয়। তারা আসাদ সরকারের বেশ কয়েকটি বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও ধ্বংস করেছে।
সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক বাহিনী কয়েক ডজন ড্রোন মোতায়েন করেছে। এসব ড্রোন আরো একটি কাজ সফলতার সাথে করে যাচ্ছে; তা হলো উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের গোপন হামলার মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া। গত শনিবার দক্ষিণ আলেপ্পোর জারবা শহরে সিরিয়ান সেনাবাহিনী ও ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর কমপক্ষে ১০ জন কর্মকর্তাকে ড্রোন হামলার মাধ্যমে হত্যা করেছে তুরস্ক।
এছাড়া তালহিয়া অঞ্চলের তাফতিনাজ শহরের কাছে আলাদা আলাদা ড্রোন হামলায় কমপক্ষে ৯ জন হিজবুল্লাহ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে তুর্কিরা। এছাড়া আরো বেশ কিছু ইরান সমর্থিত আসাদ সরকারের হয়ে যুদ্ধরত মিলিশিয়াকেও হত্যা করা হয়েছে ড্রোনের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত তাদের একটি ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে। অপরদিকে, সিরিয়ান নিউজ এজেন্সি সানা বলছে, কমপক্ষে তিনটি ড্রোন গুলি করে নামানো হয়েছে।
যেভাবে তুরস্কের ড্রোন বিপ্লবের সূত্রপাত
তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টি বা পিকেকে’র বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে আসছে। সেসব অভিযানের অধিকাংশই ছিল প্রায় বিচ্ছিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে। সেখানে বিদ্রোহীদের বেশ প্রভাব ছিল। ফলে তুরস্ক সেখানে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছিল না।
তুরস্ক তখন ড্রোনের কথা ভাবতে শুরু করে। ইতোমধ্যে তারা পাকিস্তানে বিভিন্ন যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলার সাফল্য দেখেছে। তুর্কি সেনাবাহিনী একইভাবে কুর্দিদের বিরুদ্ধে ড্রোন হামলার কথা বিবেচনা করছিল। কিন্তু তাদের কাছে উপযুক্ত ড্রোন ছিল না।
এক্ষেত্রে তুরস্কের ভরসা ছিল মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের কাছে তাদের ড্রোন প্রযুক্তি শেয়ার কিংবা বিক্রি করতে সংকোচবোধ করছিল। এর বদলে তারা তুরস্ককে অস্ত্রবিহীন কিছু মৌলিক ড্রোন বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। তখন তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে তুরস্ক অন্য উপায় বের করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সেসময় ইজরায়েল তাদের ড্রোন শিল্পকে বিস্তৃত করছিল। তুরস্কের কাছে ইজরায়েল ছিল প্রাথমিক পছন্দ। তাদের কাছে থেকে অল্প কিছু হেরন ইউএভি ক্রয় করে। কিন্তু এই ড্রোনগুলো সরবরাহ করতে ইজরায়েল অনেক দেরি করে। ফলে এখানেও তুরস্কের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। তখন তুরস্ক অনুধাবন করতে পারে প্রযুক্তি ও গোয়েন্দাগিরি নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হলে নিজেদেরই ড্রোন তৈরি করতে হবে।
ঠিক তখন দৃশ্যপটে হাজির হন সেলজুক বায়রাকতার, যিনি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জামাতা। তাকে তুরস্কে ড্রোন শিল্পের দাদা হিসেবে গণ্য করা হয়। বায়রাকতার তখন পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি যৌথভাবে একটি পেপার লেখেন। সেখানে তিনি একসাথে একাধিক ড্রোন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার উপায় তুলে ধরেন।
এরপর বায়রাকতার তার পিএইচডি গবেষণা ছেড়ে তুরস্ক চলে আসেন। দেশে ফিরে তিনি ‘বায়কার টেকনোলজিস’ নামে একটি কোম্পানি চালু করেন। তিনি তার কোম্পানি থেকে তুরস্কের সেনাবাহিনীর জন্য ড্রোন নির্মাণ শুরু করেন। শুরুতে বায়কার টেকনোলজিস লোকসানের মুখোমুখি হয়। কিন্তু পরে তিনি সরকারের সহায়তায় ঘুরে দাঁড়ান।
তুরস্ক সরকার তাদের ইউএভি প্রোগ্রামের উন্নতি করার চেষ্টা করছিল। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছে ড্রোন বিক্রি করছিল এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে কিছু সংকটের মুখোমুখি হয় তুর্কি সেনারা। ফলে তাদের শক্তিশালী ড্রোনের প্রয়োজন ছিল, যা বায়রাকতারকে সুযোগ করে দেয়।
বায়রাকতার টিবি-টু ইউএভি তৈরি করে করে সেলজুকের কোম্পানি। ১৫০ কিলোমিটার রেঞ্জের ড্রোনটি তুর্কি সেনাবাহিনীর জন্য একেবারে উপযুক্ত ছিল। এরপর এই ড্রোনের মাধ্যমে তুরস্ক পিকেকে-এর ওপর হামলা চালিয়ে বেশ সাফল্যও পায়৷
পরবর্তীতে সিরিয়ার আফরিনে অভিযানের সময় তুরস্ক একইসাথে ইউএভি ও আর্টিলারির পরীক্ষা চালায়৷ তাদের এই ট্যাকটিস ইদলিবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এই যুদ্ধে তুরস্ক শুধু বায়রাকতার টিবি-টু ব্যবহার করছে করছে না। পাশাপাশি নতুন ও উন্নত আনম্যানড কমব্যাট এরিয়াল ভেহিকালস (ইউসিএভি) ব্যবহার করছে। এছাড়া ইদলিবে প্রথমবারের মতো আরো শক্তিশালী, অস্ত্রযুক্ত ও স্যাটেলাইটের সাথে লিঙ্ক করা আঙ্কা-এস ড্রোনও ব্যবহার করা হয়েছে। তুরস্ক তাদের ড্রোনগুলো বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে।
লাভজনক ব্যবসা
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রতিরক্ষা শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে তুরস্ক এক উচ্চবিলাসী স্বপ্নের পথে হাঁটছে। তারা একইসাথে বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও অস্ত্র বিক্রেতার তালিকায় যাওয়ার চেষ্টা করছে। এরদোয়ান ২০২৩ সালের মধ্যে শীর্ষ দশ অস্ত্র বিক্রেতার মধ্যে তুরস্ককে নিয়ে যেতে চান। এক্ষেত্রে তাদের ইদলিব অভিযান বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
তুরস্ক ইতোমধ্যে ইউক্রেনে ১২টি এবং কাতারে ৬টি টিবি-টু ড্রোন বিক্রি করেছে। তিউনিসিয়ার কাছে তুরস্ক নিজস্ব ড্রোন বিক্রির একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও ইউক্রেন তুরস্কের প্রযুক্তিতে ড্রোন তৈরির কাজ করছে। বর্তমানে ড্রোন উৎপাদনে ইজরায়েলকে ছাপিয়ে চীনের কাছাকাছি চলে গেছে তুর্কিরা। তাদের কিছু ড্রোন আবার যুক্তরাষ্ট্রের সমমানের। এমন কিছু ইউসিএভি রয়েছে তাদের, যা রাশিয়ার কাছেও নেই!
তুরস্কের ড্রোন ব্যবসা ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা ইদলিবে তারা নিজেদের ড্রোনের সফল ব্যবহার করেছে। যুদ্ধের ময়দানে যেসব অস্ত্র সফলতা অর্জন করে, সেসবের প্রতি সকলের বাড়তি আগ্রহ থাকে। তাই ভবিষ্যতে হয়তো তুরস্কের ড্রোন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আকাঙ্ক্ষিত অস্ত্রেও পরিণত হবে।
এদিকে নিজস্ব প্রযুক্তিতে অস্ত্র তৈরির বিষয়টি তুরস্কের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ন্যাটোর সাথে তুরস্কের সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। এ কারণে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তুরস্ক যে পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে, তা অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়।