বর্তমানে পৃথিবীর বিচ্ছিন্নতম দেশ উত্তর কোরিয়া। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের কোলাহল থেকে নিজেদের পুরোপুরি সরিয়ে রেখেছে দেশটি, বহির্বিশ্বের সাথে দেশটির যোগাযোগও অতি সামান্যই। উত্তর কোরিয়ার এই সামগ্রিক বিচ্ছিন্নতা অবশ্য নতুন কিছু নয়। কনফুসিয়ান সংস্কৃতির প্রভাব আর নিজেদের বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচাতে চতুর্দশ শতক থেকেই বিচ্ছিন্নতার পথ বেছে নেয় কোরিয়ানরা, বিচ্ছিন্নতা বজায় ছিল চোসন রাজবংশের শাসনের পুরো সময় জুড়ে। আত্মবিচ্ছিন্নতার জন্য কোরিয়া পরিচিতি পায় হারমিট কিংডম নামে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কোরিয়ার আত্মবিচ্ছিন্নতার সমাপ্তি ঘটে, কোরিয়া চলে যায় জাপানের নিয়ন্ত্রণে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জাপান বিজয়ী মিত্রশক্তির অংশ হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারা ছিল পরাজিত অক্ষশক্তির অংশ। যুদ্ধে পরাজিত অন্যান্য দেশের মতো জাপানকেও হারাতে হয় উপনিবেশগুলোর অধিকার, কোরিয়া চলে যায় বিজয়ী মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণে। বিজয়ীদের মধ্যে কোরিয়ার সরকারব্যবস্থা নিয়ে দ্বন্দ্বে দুই ভাগ হয় কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বলয়ে আসে দক্ষিণ কোরিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট বলয়ে চলে যায় উত্তর কোরিয়া।
শুরু থেকেই উত্তর কোরিয়া শাসন করছে কিম পরিবার, নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্রকাঠামো, প্রভাবিত করছে রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে। বর্তমান সময়ে কিম পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের শাসন চলছে উত্তর কোরিয়াতে, তাদের তত্ত্বাবধানেই গড়ে উঠেছে উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
জুচে থিওরি
প্রতিষ্ঠার পর পর পঞ্চাশের দশকেই ভূরাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয় উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার একদিকে ছিল মাওবাদী চীন, আরেকদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুটিই কমিউনিস্ট দেশ হওয়ার পরেও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছিল দুই দেশের মধ্যে। উত্তর কোরিয়ার জন্য যেকোনো একদিকে হেলে যাওয়ার অর্থই ছিল আরেক পক্ষকে অসন্তুষ্ট করা। এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে উত্তর কোরিয়া তখন আত্ম-নির্ভরশীলতার তত্ত্ব নিয়ে আসে, কোরিয়ান ভাষায় যেটি পরিচিতি পায় জুচে নামে।
মার্ক্সিজম, প্রথাগত কনফুসিয়ান দর্শন আর কোরিয়ান জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে জুচে থিওরি, সাথে যুক্ত হয় সাম্রাজ্যবাদী জাপানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক আচারও। এই তত্ত্বের মূল ধারণা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের সাথে নিজের বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখবে, নিজের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতার উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করবে এবং কোরিয়ার জনগণ কিম পরিবারের নির্দেশনা অন্ধভাবে অনুসরণ করবে।
জুচে থিওরি এখনও উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় তাত্ত্বিক দর্শন হলেও সময়ের সাথে জুচে থিওরি পরিবর্তিত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে, উত্তর কোরিয়া নিজেদের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে সামরিক বাহিনীর আকার বৃদ্ধি করে, বাড়ে সামরিক ব্যয়ও, কোরিয়ানদের আত্ম-নির্ভরশীলতা হয়ে ওঠে সামরিকায়নকেন্দ্রিক। গত দশকে আবারও পরিবর্তন হয়েছে কোরিয়ানদের আত্মনির্ভরশীলতার ধারণার, সামরিক সক্ষমতার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও।
জুচে থিওরি কিম পরিবারকে উত্তর কোরিয়া শাসনের নৈতিক বৈধতা দিয়েছে কোরিয়ানদের কাছে, রাষ্ট্রকাঠামোতে তাদের প্রতিষ্ঠা করেছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে কাজ করা কোরিয়ান ফিলোসফির উপর বিশেষজ্ঞ ড্যান ব্রাউনের মতে, জুচে থিওরির অর্থ হলো, যতদিন কিম পরিবার আছে, ততোদিন কোরিয়ানদের ইশ্বরের প্রয়োজন নেই।
রাজনৈতিক অবতারবাদ
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা যায়, কোনো বিশেষ নেতাকে তার সমর্থকেরা অবতারের মতো দোষ-ত্রুটি-ভুলের উর্ধ্বে বিবেচনা করেন, তাকে অন্ধভাবে অনুসরণের পাশাপাশি তার চিন্তা ও বক্তব্যকে অভ্রান্ত বলে উপস্থাপন করা হয়। যাবতীয় ভালো আর পূণ্যের সাথে জড়িয়ে দেওয়া হয় তার নাম, সাফল্যের সকল স্বীকৃতিও যায় তার ঘরে। এরূপ রাজনৈতিক অবস্থাকে, যখন নেতা সাধারণের একজন না হয়ে, সাধারণের উর্ধ্বে একক ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন, সেই অবস্থাকে রাজনৈতিক অবতারবাদ বলে।
উত্তর কোরিয়াতেও কিম পরিবারের শাসকদের অবতাররূপে উপস্থাপন করা হয়, কোরিয়ার কথিত সমৃদ্ধির নায়ক হিসেবে তুলে ধরা হয় কিমদের। রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে কিম পরিবারের হাতে, ক্ষমতা চর্চার সুযোগ পায় কিম পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া অভিজাত শ্রেণি। কেন্দ্রীভূত কাঠামোতে কিমদের ক্ষমতাকে সীমিত করার মতো কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নেই, নেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুযোগ। কিমদের প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় অভিজাত শ্রেণি আর সামরিক বাহিনী।
এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া তিনজন সুপ্রিম লিডার পেয়েছে। কিম ইল সুং, কিম জন ইল ও কিম জন উন। সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে তারা ওয়ার্কাস পার্টির শীর্ষপদে থাকেন, নেতৃত্ব দেন প্রেসিডিয়াম, পলিটিব্যুরো আর সেক্রেটারিয়েটকেও, দায়িত্ব পালন করেন সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে। প্রভাবশালী এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় কোরিয়াতে সবকিছু করার ক্ষমতা রাখেন কিমরা। ফলে সমর্থকদের মনে ক্ষমতার প্রতি সমীহ তৈরি হয়, দেখতে শুরু করেন অবতাররূপে।
ওয়ার্কাস পার্টির রাজনৈতিক মনোপলি
আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর অন্যতম একটি উপাদান ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ক্ষমতার পরিধি চিহ্নিত করে দেওয়া হয়, আনা হয় জবাবদিহিতার সুযোগও। সরকার ও রাজনৈতিক দল এ রকমই দুটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যাদের কাজ আর ক্ষমতার পরিধি আলাদা হওয়ার কথা। কিন্তু অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশের মতো, উত্তর কোরিয়াতেও সরকার ও রাজনৈতিক দল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা উপভোগ করে। এই দলের নাম ওয়ার্কাস পার্টি অব কোরিয়া।
নীতিনির্ধারণী কাজে ওয়ার্কাস পার্টির চারটি প্রধান কাঠামো ভূমিকা রাখে- ওয়ার্কাস পার্টির সেন্ট্রাল কমিটি, পলিটিক্যাল ব্যুরো (পলিটিব্যুরো), দ্য কন্ট্রোল কমিশন, এবং এক্সিকিউটিভ পলিসি ব্যুরো। সেন্ট্রাল কমিটির আবার বিশটির মতো বিভাগ রয়েছে, সরকারি সংস্থাগুলো যাদের কাছে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। সেন্ট্রাল কমিটির অধীনে থাকা বিভাগগুলো প্রকল্পের প্রস্তাবনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে। তারা অনুমোদন দিলেই সরকারি সংস্থাগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমতি পায়। ওয়ার্কাস পার্টির এক্সিকিউটিভ কমিটি কোরিয়ার গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে, রাষ্ট্রের শীর্ষপদে নিয়োগগুলোর ব্যাপারে পরামর্শ দেয়, দল আর কেবিনেটেও থাকে তাদের অপরিসীম প্রভাব।
সামরিক বাহিনীর অসীম ক্ষমতা
আকারের দিক থেকে কোরিয়ার সামরিক বাহিনী বিশ্বের বড় সামরিক বাহিনীগুলোর একটি। বর্তমানে প্রায় বারো লক্ষ সক্রিয় সামরিক সদস্য রয়েছে কোরিয়ান পিপলস আর্মিতে, যাদের মধ্যে দুই লাখের অধিক সদস্যের রয়েছে স্পেশাল অপারেশনে অংশগ্রহণের ট্রেনিং। বারো লাখ সক্রিয় সদস্যের পাশাপাশি আরো প্রায় দশ লাখ সৈন্য আছে রিজার্ভে। সামরিক বাহিনীতে চাকরি কোরিয়ান সমাজে অন্যান্য পেশার চেয়ে সম্মান আর শ্রদ্ধার সাথে দেখা হয়।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রকাঠামোতে সামরিক বাহিনী সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কোরিয়ান পিপলস আর্মির সাংগঠনিক কাঠামো অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সুগঠিত, কার্যকর চেইন অব কমান্ড রয়েছে, কোরিয়ান সমাজে রয়েছে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা। রাষ্ট্রীয় অস্ত্রের মজুত তাদের নিয়ন্ত্রণে, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণেই। অর্থনীতির বিশাল অংশ রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণে, অর্থনৈতিক রিসোর্সগুলোর নিয়ন্ত্রণও তাদের কাছেই।
ফলে কিম পরিবারকে সবসময় সামরিক বাহিনীর সাথে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়েছে। কিম জং ইলের সময় উত্তর কোরিয়াতে সামরিকায়নের গতি বৃদ্ধি পেলে পাল্লা দিয়ে বাড়ে সামরিক বাহিনীর প্রভাবও। কিম পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের এই শাসক সামরিক নেতৃত্বের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাখতেন, কাঠামোগত পরিসরগুলোকে এড়িয়ে সামরিক বাহিনীতে দিতেন ক্ষমতা চর্চার সুযোগ।
নির্বাচনী কাঠামো
আপনি হয়তো জেনে অবাক হবেন, উত্তর কোরিয়াতে নিয়মিত নির্বাচন হয়। সুপ্রিম ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হয়, প্রতি বছর দশ দিনের জন্য বসে অধিবেশন, কাজ করে জাতীয় আইনসভা হিসেবে। স্থানীয় অ্যাসেম্বলিগুলোতে চার বছর অন্তর অন্তর নির্বাচন হয়, জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন নাগরিকদের সরাসরি ভোটে। স্থানীয় আর জাতীয় পর্যায়ের অ্যাসেম্বলিগুলোর নির্বাচনে ভোটার টার্নআউট প্রায় শতভাগ।
ওয়ার্কাস পার্টির বাইরেও উত্তর কোরিয়াতে আরো দুটি রাজনৈতিক দল রয়েছে, কোরিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও কনডোইস্ট চংগু পার্টি। এই তিন পার্টিকে নিয়ে গঠিত হয়েছে ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ফর দ্য রিইউনিফিকেশন অব ফাদারল্যান্ড। এই ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতার অনুমোদন দেয়। কোরিয়ানদের এই ফ্রন্টের একমাত্র প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে হয়। এই ফ্রন্টের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে কোনো প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বীতার ঘটনা বেশ বিরল। বিদ্রোহী প্রার্থীকে ভোট দিতে হলে আলাদা বুথে গিয়ে নাগরিকদের ভোট দিতে হয় এবং একে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উত্তর কোরিয়াতে ভোট দেওয়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হওয়া প্রত্যেক প্রজার জন্য বাধ্যতামূলক।
উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
উত্তর কোরিয়া কোনো কৌতুক নয়, একে আখ্যায়িত করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জেলখানা হিসেবে। এটি ভয়ংকর, নিষ্ঠুর, অমানবিক এক শাসনব্যবস্থা। তবে শীঘ্রই এই জেলখানে থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই কোরিয়ানদের। উত্তর কোরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো সহিংসতা উৎপাদনে মনোপলি উপভোগ করে। এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই তারা টিকে থাকে যুগের পর যুগ ধরে।