১৮ আগস্ট, ২০১৮; পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন একসময় ব্যাটে-বলে পৃথিবী কাঁপানো ইমরান খান, দুই যুগের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধরা স্বপ্ন বাস্তব হয় ইমরান খানের। লাহোরের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করা ইমরান খান পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্যারিয়ার গড়েছিলেন ব্যাট-বলের দুনিয়ায়। তার নেতৃত্বেই পাকিস্তান প্রথমবারের মতো ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়, পাকিস্তানজুড়ে নায়কে পরিণত হন তিনি। ক্রিকেটের মাধ্যমে পাওয়া জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির পথে নামেন ইমরান, স্বপ্ন ছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী বেশ খোলামেলা হস্তক্ষেপ করে, স্বাধীনতার পরে সাত দশকের মধ্যে একটা বড় সময় ক্ষমতায় ছিল সামরিক বাহিনীর জেনারেলরাই। রাজনীতিবিদেরা সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের অধীনে বিভিন্ন প্রদেশে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দায়িত্ব নিয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের। নব্বইয়ের দশকের পর গণতন্ত্রায়নের ঢেউয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বেসামরিক নেতৃত্বের হাতে গেলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্থান-পতন এখনও নির্ভর করে সেনাদের পছন্দের উপরই। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এর বাইরে রয়েছে দুটি প্রভাবশালী পরিবার: শরীফ পরিবার আর ভুট্টো পরিবার। এই দুই পরিবারের বাইরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনেকটা আউটসাইডারের মতো প্রবেশ ঘটে ইমরান খানের। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।
রাজনীতিতে ইমরান খান
রাজনীতিতে ইমরান খানের প্রথম এক দশক কেটেছে অনেকটাই সহযোগী দলের নেতার মতো, ভুট্টো পরিবার আর নেওয়াজ পরিবারের প্রতাপে আড়ালেই ছিলেন রাজনীতিতে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খানের প্রকৃত উত্থান শুরু হয় ২০১১ সালের পর থেকে। তার র্যালিগুলোতে অনেক বেশি মানুষ জড়ো হওয়া শুরু করে। ক্রিকেটার হিসেবে তার পরিচয় আর জনতুষ্টিবাদী রাজনৈতিক বক্তব্য তার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। পিটিআই-এর নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট, দলীয় পতাকায় ইসলামিক মূল্যবোধের সাথে মিশ্রণ দেখানো হয়েছে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের। জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিতে ইমরান খান একদিকে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, প্রশাসনের অদক্ষতা আর নৈতিকতার অবক্ষয় নিয়ে কথা বলেছেন, অন্যদিকে কথা বলেছেন দেশের রাজনীতিতে আমেরিকার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও।
২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনেই তেহরিক-ই-ইনসাফ তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৩৪২ সিটের মধ্যে পিটিআই-এর দখলে ছিল ৩৫টি সিট। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে পিটিআইএর আসন বাড়ে ১১৪টি; পার্লামেন্টে ১৪৯টি সিট নিয়ে পিটিআই আবির্ভূত হয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে। সেই বছরের ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইমরান খান।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান যখন দায়িত্ব নেন, তখন বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির ঢেউ চলছে, বিশ্ববাজারে চলছে বিভিন্ন পণ্যের দামের উত্থান-পতন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে চলছে ধীর প্রবৃদ্ধি, অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য না থাকায় কর্মসংস্থানের অভাবে রয়েছে উচ্চ বেকারত্বের হার। এর মধ্যেও ইমরান খান প্রতিশ্রুতি দেন পাকিস্তানের অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফেরানোর, প্রতিশ্রুতি দেন শাসনতন্ত্রে কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিতের। শুরুতে আত্মনির্ভরশীলতার কথা বললেও দ্রুতই আইএমএফ-এর কাছে ঋণ চাইতে হয় ইমরানের সরকারকে, চীনা বিনিয়োগের পাশাপাশি নিতে হয় সৌদি ঋণও। যদিও এসবের মাধ্যমে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে টেনে তুলতে পারেননি ইমরান খান।
এর মধ্যে পৃথিবীব্যাপী আঘাত হানে করোনা মহামারি। নাজুক পাকিস্তানের অর্থনীতিকে আরো বেসামাল করে দেয় অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধি আর কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার সুযোগ নেয় বিরোধীরা। বেশ কয়েকবার ইমরান খানের বিরুদ্ধে রাজপথে নামে মুসলিম লীগ-নেওয়াজ, পিপিপি-ভুট্টোর মতো দলগুলো। তবে, স্বাস্থ্যবীমা চালুর কৃতিত্ব পাবেন ইমরান খান, উচ্চকণ্ঠ ছিলেন সুশাসন নিশ্চিতের ব্যাপারেও।
সেনাপ্রধান বাজওয়ার সাথে প্রধানমন্ত্রী ইমরানের দূরত্ব
পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন সেনাপ্রধান। ইমরান খানের ক্ষমতায় আসার পেছনে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্যের গুঞ্জন ছিল, গুঞ্জন ছিল সেনাবাহিনীর সাথে আপোষ-রফা করেই ইমরান ক্ষমতায় এসেছেন। ইমরান আর সেনাবাহিনী, দু’পক্ষই এমন গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়েছে। তবে, পাকিস্তানের রাজনীতির বাস্তবতা হলো, সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা করেই সরকার পরিচালনা করতে হবে রাজনৈতিক দলকে, পররাষ্ট্র আর প্রতিরক্ষানীতি নির্ধারিত হবে সেনাসদর থেকেই। প্রধানমন্ত্রীকে গদি টিকিয়ে রাখতে সেনাপ্রধানের সাথে যেকোনো ধরনের সংঘাত এড়িয়ে চলতে হবে।
ক্ষমতায় আসার সময় এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বললেও প্রথাগত জনতুষ্টিবাদীদের অনুসরণ করে এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে ইমরান খান কোনো পদক্ষেপ নেননি। বরং, নিজেই এস্টাবলিশমেন্টের অংশ হয়েছেন, সেনাবাহিনীতে কর্মরত আর সাবেক অফিসারদের মধ্যে তৈরি করেছেন নিজের অনুগত গ্রুপ। ভবিষ্যৎ ক্ষমতার সুরক্ষায় নিজের বলয়ে থাকা সেনা অফিসারদের মধ্যেই পরবর্তী সেনাপ্রধান আর আইএসআই প্রধান চেয়েছিলেন ইমরান খান, বর্তমান সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার সাথে ইমরান খানের দ্বন্দ্বের শুরুও এখান থেকেই।
পাকিস্তানে সাধারণত আইএসআই প্রধানরা সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। ইমরান খান আইএসআই প্রধান হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফাইয়াজ হামিদের মেয়াদ বাড়াতে চাচ্ছিলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া আইএসআই প্রধান হিসেবে চাচ্ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আহমেদ আঞ্জুমকে। সামরিক আর বেসামরিক নেতৃত্বের মধ্যে দুই সপ্তাহের নজিরবিহীন টানাপোড়েনের পর ইমরান খানকে হার মানতে হয়, আইএসআই প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান জেনারেল বাজওয়ার পছন্দের প্রার্থী লেফটেন্যান্ট জেনারেল আঞ্জুম। এই সংকটের মাস চারেকের মধ্যেই পদত্যাগ করতে হয় ইমরান খানকে।
কেবল আইএসআই প্রধানের ইস্যুতে ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়তে হয়েছে- ব্যাপারটা এমন না। সাধারণত পররাষ্ট্রনীতি আর প্রতিরক্ষানীতি সেনাবাহিনীই নির্ধারণ করে পাকিস্তানে। ইমরান খানের ক্রমাগত যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য আর ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিন রাশিয়া সফরে যাওয়া সেনাবাহিনীর সাথে পররাষ্ট্রনীতিতে ইমরানের দূরত্ব বাড়ায়।
ইমরান খানকে সেনাবাহিনী থেকে দুটি বিকল্প দেওয়া হয়। প্রথমত, পদত্যাগ করা; দ্বিতীয়ত, নো-কনফিডেন্স ভোটের মাধ্যমে পদচ্যুত হওয়া। ইমরান সংকট সামাল দিতে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করে দেন প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে, ঘোষণা দেন নতুন সাধারণ নির্বাচনের। কিন্তু বিরোধীরা তার এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায়, অবৈধ ঘোষিত হয় পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করার প্রস্তাব। সেই সপ্তাহেই পার্লামেন্ট অধিবেশন বসে, জোট সঙ্গীদের পক্ষ বদলে প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান ইমরান খান।
ইমরান খানের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ
প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর পরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে ইমরান খানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি দেখেছিলেন, দেখেছিলেন রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারানোর সম্ভাবনা। ইমরান খান রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভবিষ্যৎবাণীগুলোকে ভুল প্রমাণ করেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে ফিরে এসেছেন ইমরান খান।
প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর পর থেকেই একের পর এক র্যালি করছেন ইমরান খান, নিজেকে দেখাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র আর সেনাবাহিনীর চক্রান্তের ভিক্টিম হিসেবে। ইমরান খানের র্যালিগুলোতে বিপুল জনসমাগম হচ্ছে, বাড়ছে তার জনপ্রিয়তা। ইমরানের প্রত্যাবর্তনকে সহজ করেছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধি আর অর্থনৈতিক দুরবস্থা। তার প্রত্যাবর্তনের প্রমাণ হয়ে আছে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচন, ইমরানের দল পিটিআই জয়লাভ করেছে ২০টি আসনের মধ্যে ১৫টিতে। আরেক দফা নাটকীয়তা শেষে পাঞ্জাবের ক্ষমতায় ফিরেছে ইমরানের দল পিটিআই।
সম্প্রতি ইমরান খানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ দমন আইনে মামলা করেছে পুলিশ, মামলা দায়ের করেছে ১৪৪ দফা ভঙ্গের অভিযোগেও। পিটিআই চেয়ারম্যানের চিফ অব স্টাফ শাহবাজ গিলের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে আয়োজিত সমাবেশে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের হুমকি প্রদানের অভিযোগ আনে পুলিশ। ইমরান খান সেই সমাবেশে প্রতিশ্রুতি দেন শাহবাজ গিলকে নির্যাতন করা অফিসারদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ারও। মামলা করলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ইমরানকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে দোটানা থাকায় গ্রেপ্তার হচ্ছেন না ইমরান খান।
সব মিলিয়ে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর পরেও একইভাবে প্রাসঙ্গিক আছেন ইমরান খান। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমর্থন আর সাংগঠনিক শক্তি ব্যবহার করে পাকিস্তানের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে সেনাবাহিনী। চলমান সংকটের দায় সেনাবাহিনীর উপর চাপিয়ে আর ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার করে সেনাবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা কমাচ্ছেন ইমরান খান। সেনাবাহিনীতে নিজের অনুগত বলয় তৈরি করে চেষ্টা করছেন সেনাবাহিনীতে রাজনীতিকরণের। আবার, ক্যারিশমেটিক বক্তৃতা দিয়ে তরুণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে নিজের দলে টানছেন ইমরান খান, বাড়াচ্ছেন সমর্থক শ্রেণী। ইতোমধ্যেই সদস্যপদের দিক থেকে পিটিআই পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।
ইমরান খানের এই পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর সাথে সম্ভাব্য কোনো সমঝোতায় পিটিআইকে ভালো অবস্থানে রাখবে, সেনাবাহিনীকে বাধ্য করবে তার সাথে সমঝোতায় আসার। তবে, সেনাবাহিনী কতক্ষণ তাকে রাজনীতি করতে দেবে এটাও আলোচিত বিষয়। অতীতে যারাই রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব কমাতে চেয়েছেন, সেনাবাহিনী বেসামরিক প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ইমরানও একই কাজ করছেন, প্রশ্নবিদ্ধ করছেন সেনাবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা, সেনাবাহিনীকে তুলে ধরছেন পররাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল এক সংস্থা হিসেবে। সেনাবাহিনীও ইমরান খানকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে। পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর একবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না গেলে এই রাজনৈতিক লড়াই পরবর্তী সেনাপ্রধানকেও মোকাবেলা করতে হবে। অর্থাৎ, পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন না ইমরান খান।