তুর্কি প্রেসিডেন্টের আকস্মিক বিবৃতি
I Call out to those who have kept turkey waiting at the ‘EU’ door for more than 50 years, pave the way for turkey and we will pave the way for Sweden.
প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান
১০ জুলাই ২০২৩ সালে ন্যাটো সম্মেলনে যোগদানের জন্য ভ্রমণকালে এয়ারপোর্টে দেয়া এরদোয়ানের এ বক্তব্য চমকে দিয়েছিল পৃথিবীর সবগুলো দেশকে। বিবৃতিতে এরদোয়ান সহজ ভাষায় এটা বলছিলেন যে ইউরোপে তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করো, আমরা সুইডেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হতে দেবো! বিবৃতির কয়েক ঘণ্টা পরই ঘোষিত হয় সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেছে একমাত্র বিরোধিতাকারী দেশ তুরস্ক!
সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান প্রশ্নে শুরু থেকেই এরদোয়ান সরকার বিষয়টির তুমুল বিরোধ করে আসছিল সুইডেনের ‘বাকস্বাধীনতা’ আইনকে ঘিরে। বারংবার সুইডেন তাদের দেশের নাগরিকদের পুলিশি পাহারায় জনসম্মুখে কুরআন পোড়াতে দেয়ার মতো ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল তুরস্ক, এবং এমন ঘটনাই সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে তুর্কি সরকারপ্রধানের হঠাৎ এমন বক্তব্য চমকে দেয় সকলকে।
কিন্তু কেন এমনটা করার সিদ্ধান্ত নিল তুরস্ক? ন্যাটোসহ পশ্চিমা বিশ্বের সাথে এটি কি তবে নতুনভাবে শুরুর কোনো ইঙ্গিত? নাকি অন্য কোনো বড় পরিকল্পনা রয়েছে এর পেছনে? ইউরোপকে কেন্দ্র করে তুর্কি প্রেসিডেন্ট কী পরিকল্পনা কষছেন?
ন্যাটোর গুরুত্ব
নর্থ আটলান্টিক ট্রীটি অর্গেনাইজেশন (ন্যাটো)-কে ধরা হয় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট। পশ্চিমা দেশগুলো এ সংগঠনকে গত তিন দশক যাবৎ পুরো বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাবুকের মতো ব্যবহার করে গেছে। শক্তিশালী এই সামরিক জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশীরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র একে ব্যবহার করে গেছে তাদের সবচেয়ে বড় হুমকি রাশিয়াকে দমাতে, এবং এশিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে।
কৌশলগত দিক থেকে রাশিয়াকে দমানোর জন্য ন্যাটোর শক্তি বৃদ্ধি সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতে, ন্যাটোর শক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করতে শুরু করে। সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড রাশিয়ার সাথে সরাসরি বর্ডার শেয়ার করায় ন্যাটোতে দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তিকরণ বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে বিশ্বমোড়লদের জন্য।
ন্যাটো পলিসি এবং নতুন তুর্কি বাঁক
কিন্তু ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তিকরণ নীতি অনুযায়ী ন্যাটোভুক্ত সকল দেশের অনাপত্তি না থাকলে কিছুতেই ন্যাটোতে প্রবেশ পারবে না নতুন কোনো দেশ। সুইডেনের ন্যাটোতে প্রবেশের প্রক্রিয়া ২০২২ সালে শুরু হলেও একমাত্র তুরস্কের আপত্তির ফলে কিছুতেই সংগঠনটিতে যোগদান করতে পারছিল না তারা।
কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ তুরস্ক সুইডেনবিরোধী এই নীতিতে অবস্থান করলেও ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর যেন পালে বদল এসেছে তুর্কি কূটনীতিতে। এরদোয়ান সরকার এতদিন যাবৎ কুরআন অবমাননার জন্য সুইডেনের ন্যাটো অন্তর্ভুক্তিতে বাঁধ সাধতে থাকলেও আচমকা তাদের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তিকরণে সম্মতি প্রদান করে দেশটি। এ সম্মতি এরদোয়ান এমন এক সময় দেন, যা দেশটির সমর্থকদেরকেও চমকে দিয়েছে।
সম্প্রতি ঈদুল আযহার দিন সুইডেনে পুলিশি নিরাপত্তায় আবারও কুরআন পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। এমন স্মৃতি যখন তরতাজা, তখন আন্তর্জাতিক গবেষকরা ধরেই নিয়েছিল সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের আশা এবার আরো ক্ষীণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু এমন ঘটনার কিছুদিন পরই এরদোয়ান সুইডেনের ব্যাপারে সম্মতি দেন।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং তুরস্কের সম্পর্ক
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-তুরস্ক সম্পর্ককে মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করা সম্ভব:
১) ২০০৫ পূর্ববর্তী অবস্থা;
২) ২০০৫-১৬ পর্যন্ত অবস্থা;
৩) ২০১৬ থেকে বর্তমান।
তুরস্কের ভৌগলিক অবস্থান ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশে। ইউরোপিয়ান নেইবারহুড এনলার্জমেন্ট পলিসির ভিত্তিতে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে কোনো অন্তরায় নেই। তাছাড়া তুরস্ক কাউন্সিল অব ইউরোপ, ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস, ন্যাটো ও জি২০ এর সদস্যপদ লাভ করেছে।
২০০৫ সাল-পূর্ববর্তী অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- সেই ১৯৮৭ সালে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি, যা আজকের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, তার সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে তুরস্ক। কিন্তু ইউরোপিয়ান কমিশন আবেদনটি খারিজ করে। কারণ হিসেবে তারা দায়ী করে তুরস্কের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নাজুক পরিস্থিতি, গ্রীসের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক, এবং সাইপ্রাস দ্বন্দ্বের অমীমাংসিত অবস্থাকে। এরপর বহু পদক্ষেপ নিয়েও সেসময় সফলতার মুখ দেখতে পায়নি তুরস্ক।
এমন প্রত্যাখ্যানের পর বেশ কিছুদিন ইইউ-তুরস্ক সম্পর্ক শীতলভাবে এগোলেও অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তুরস্কের সাথে আলোচনা শুরু করে। কয়েক দফা আলোচনার পর অনেকটা ইতিবাচক দিকেই এগোচ্ছিল তুরস্কের ইইউ-তে প্রবেশের পথ। ২০১৩ সালে ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীদের স্রোত নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তুরস্কের তখনকার প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতোগলুর সঙ্গে আঙ্কারায় বৈঠক করেন অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। তিনি তুরস্কের ইইউ সদস্য হওয়ার দাবিকে সমর্থন করার আশ্বাস দেন। চুক্তিটি ইইউ-এর দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই বিশেষজ্ঞরা ধরেই নিয়েছিলেন যে তুরস্কের ইইউ-এ যাত্রা এবার অনেক বেশি সহজ হয়ে উঠবে। কিন্তু অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া ব্যার্থ অভ্যুত্থানের কারণে।
তুরস্কে বিদ্রোহ এবং ইইউ-এর আবারও তুরস্ককে প্রত্যাখ্যান
একদল সেনা সদস্যের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর তুরস্কে দেড় লাখ মানুষকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ৪০ হাজার নাগরিককে জেলে ঢোকানো হয়েছে। তখন গোটা ইউরোপে তুরস্কের মানবাধিকারের জন্য নিন্দার ঝড় ওঠে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তখন সকল সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এরা সবাই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত। ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্ট তুরস্কে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের উপর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইইউ-তে প্রবেশের আলোচনা স্থগিতের জন্য সিংহভাগ সাংসদ ভোট প্রধান করেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইইউ-এর নীতিনির্ধারকদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, “৫৪ বছর ধরে আমাদের অপেক্ষায় রেখেছেন। আপনারা যদি সৎ হন, তাহলে আপনাদের বক্তব্য পরিষ্কার করুন। আমরা এটা বন্ধ করে দেব। আমাদের আর ইইউ-এর দরকার নেই।” (সূত্র: হুররিয়াতডেইলি নিউজ, ১৩ অক্টোবর ২০১৭)
এরপর থেকেই ইইউ-এর সাথে তুরস্কের সম্পর্ক অনেকটা শীতল হতে শুরু করে। কিন্তু সুইডেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে এরদোয়ান এমন এক বাজিমাত করার চেষ্টা করছেন, যার মাধ্যমে হয়তো তুরস্কের দীর্ঘ পাঁচ দশকের অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
সুইডেনকে সমর্থন জানিয়ে কী পেল তুরস্ক?
তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকছে কানাডার তুরস্কের উপর দেয়া ‘ড্রোন পার্টস রপ্তানি’ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া। তুর্কি ড্রোন শিল্প দিনকে দিন উন্নত হচ্ছে। আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধে তুর্কি ড্রোনের এককাধিপত্য বিস্মিত করেছিল সবাইকে। কিন্তু প্রযুক্তি থাকলেও ড্রোনের বিশেষ যন্ত্রাংশগুলো তুরস্ককে আমদানি করতে হতো কানাডা থেকে, যার উপর দেশটির সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল। এমন পরিস্থিতিতে তুর্কি ড্রোন শিল্প থমকে যেতে শুরু করলেও এমন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার পুনরায় তুর্কি ড্রোন শিল্পে প্রাণ সঞ্চার করবে বলেই ধারণা সামরিক বিশ্লেষকদের।
তুরস্কের প্রাপ্তির খাতায় দ্বিতীয় নাম F-16 যুদ্ধবিমানের। রাশিয়ার কাছ থেকে S-400 ডিফেন্স সিস্টেম কেনার পর পরই আমেরিকার সাথে তুরস্কের সামরিক বাণিজ্য থমকে যায়। সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগদানের অনুমতি দেয়ার বিনিময়ে তুরস্কের কাছে F-16 যুদ্ধবিমান বিক্রি করবে মার্কিনিরা- এমনটাই জানিয়েছে তারা।
সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অবশ্যই তুরস্কের ইইউ-তে সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে আলোচনা অগ্রসর হওয়া। ইইউ-এর বিশাল মার্কেট দেশটির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। সংশ্লিষ্ট সকল দেশ সুইডেন ইস্যুতে তুরস্কের ইতিবাচক ঘোষণার পর থেকেই এ নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রত্যয় জানিয়েছে। এছাড়াও তুরস্কের নাগরিকদের জন্য ভিসা অনুমোদনের মাত্রাও বাড়ানো হবে বলে আশ্বাস জানিয়েছেন ইইউ প্রধান।
তুরস্কের দূরদর্শী উদ্দেশ্য
তুরস্কের অর্থনীতি পশ্চিমা চাপে একেবারেই ভঙ্গুর অবস্থায় চলে যাচ্ছিল। মুদ্রাস্ফীতির আধিক্য, তারল্য সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা নির্বাচনের আগে ব্যাপক চাপে ফেলেছিল তুর্কি সরকারকে। বেশ কয়েকবার দেশটির অর্থমন্ত্রীদের হারাতে হয়েছে নিজেদের পদ। ড্রোন শিল্প পুনরুজ্জীবিতকরণ, ভিসা নীতি শিথিল করা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার চেষ্টার দিকেই ইঙ্গিত করে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক গবেষক গালিপ দালায় আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন, সুইডেন ইস্যুকে ব্যবহারের মাধ্যমে তুরস্ক মূলত ইইউ এবং আমেরিকার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকের চেষ্টায় আছে। এরপরও তুরস্কের ইইউ প্রবেশের পথ এখনও অনেক দূরেই ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। তুরস্কের ন্যাটো, ইউরোপ এবং আমেরিকাকে কেন্দ্র করে এমন নীতি দেশটির রাশিয়ার সাথে সম্পর্কে বেশ প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।