তেলে আর জলে যে মিশ খায় না, তা আরও একবার প্রমাণিত হলো ভারতীয় রাজনীতিতে। বছর দশেক আগে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি সাক্ষর করা নিয়ে মতানৈক্যের ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছিলেন এদেশের বামপন্থীরা। সেবারেও এই তেলে-জলে মিশ না খাওয়ার উপমাটি দেওয়া হয়েছিল তাদের ঐতিহাসিক শ্রেণী-চরিত্রগত পার্থক্যের জন্যে। যদিও তাতে সরকারের পতন হয়নি। আর গত মঙ্গলবার, ১৯ জুন, সেই উপমাটি ফের ফিরে এল ভারতের রাজনীতিতে, যখন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হাত ছেড়ে সরকার থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি।
বিজেপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির নেতৃত্বে চলা সরকারের কার্যপ্রক্রিয়া তাদের পছন্দ হয়নি আর তাতেই তারা বাধ্য হয়েছে সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিতে। এমনকি, যেই সাংবাদিক সুজাত বুখারির হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি কথাও খরচ করতে দেখা যায়নি বিজেপি নেতৃত্বকে এযাবৎ, তার পক্ষেও সওয়াল তুলে বিজেপি বলেছে- খোদ শ্রীনগরে যদি দিনের আলোয় একজন সাংবাদিককে এভাবে খুন হতে হয়, তাহলে বোঝাই যায় রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার কী অবস্থা।
আগামী লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখেই বিজেপির এই মাস্টারস্ট্রোক
আসলে বিজেপির দিক থেকে মুফতি সরকারকে ফেলে দেওয়া একটি বড় কৌশল, যার আসল লক্ষ্য হচ্ছে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচন। মুফতিকে নিয়ে বিজেপির প্রথম থেকেই অসুবিধা হচ্ছিল, কারণ আঞ্চলিক দল হিসেবে পিডিপি বিজেপির গা-জোয়ারি নীতির সমর্থন করছিল না কখনই। রাজ্যের বাস্তবিক সমস্যা সম্পর্কে অবহিত পিডিপি বরাবরই বলে এসেছে যে গায়ের জোরে কাশ্মীরকে শাসন করা ঝুঁকির কাজ। তাছাড়া, মুসলমান-কেন্দ্রিক দল হওয়াতে বিজেপির রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও তাদের অস্বস্তি ছিল।
অন্যদিকে, বিজেপির অবস্থান হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা অন্যান্য সব প্রদেশের মতো সংবেদনশীল জম্মু ও কাশ্মীরেও সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ অবস্থান নিয়ে শাসনকার্য চালানোর পক্ষে। মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জম্মু ও কাশ্মীরের পক্ষে নরম কথা কিংবা উন্নয়ন ও পর্যটনবাদ দিয়ে সন্ত্রাসবাদ দমনের কথা বললেও, বাস্তব জমিনে নয়াদিল্লির তরফ থেকে দেখা গিয়েছে লৌহনীতি অবলম্বন করতে। সেনা জিপের সামনে স্থানীয় যুবককে বেঁধে ঘোরানোর মতো বিতর্কিত পদক্ষেপও বাদ যায়নি। তা নিয়ে চারিদিকে ধিক্কার, সমালোচনা শোনা গেলেও নয়াদিল্লির কাশ্মীর নিয়ে লৌহনীতিতে কোনোরকম শিথিলতা চোখে পড়েনি।
একদিকে সরকারের দুই শরিক দলের পরস্পরবিরোধী নীতি তো ছিলই, বিজেপির উপরে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে কাশ্মীরে কিছু করে দেখানোর তাগিদও ছিল। বিজেপির রাজনীতির অন্যতম বড় তাস হচ্ছে জাতীয়তাবাদ বা অতি-জাতীয়তাবাদ। ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী তৎকালীন কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে জম্মু ও কাশ্মীরের সন্ত্রাস নিয়ে কম কটাক্ষ করেননি।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও মোদী পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে কম কসরত করেননি, কিন্তু দিনের শেষে কিছুতেই কিছু লাভ হয়নি। ২০১৬ সালে কাশ্মীরের উরিতে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট জঙ্গি হামলায় বেশ কয়েকজন ভারতীয় সেনা জওয়ান মারা পড়লে মোদী সরকার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকও চালায়; সে বছরই নভেম্বরে নোটবন্দির মতো একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় সন্ত্রাসবাদের কোমর ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যেও। কিন্তু সাময়িকভাবে জনসাধারণের বাহবা পেলেও দীর্ঘ মেয়াদে যে এই পদক্ষেপগুলো দারুণ সফল হয়েছে তা বলা যাবে না। সম্প্রতি জাতিসংঘও কাশ্মীরের অবস্থা নিয়ে সমালোচনা ব্যক্ত করে একটি রিপোর্টে।
রাজ্যে শরিক দল এবং কেন্দ্রে শাসক দল হিসেবে বিজেপির দায় কম নয়
অতএব, কাশ্মীর নিয়ে চাপ বাড়ছিল নয়াদিল্লির উপরে। বিজেপি বুঝতে পারছিল, জম্মু ও কাশ্মীরে শাসনভারের যুগ্ম দায়িত্বে মুফতির পিডিপি থাকলেও দেশের শাসকদল এবং জাতীয় দল হিসেবে তাদেরকেই বিরোধী দল এবং জনগণ সবার আগে কাশ্মীরের সার্বিক ব্যর্থতার জন্যে দায়ী করবে। আর পরবর্তী নির্বাচনের এক বছর আগে এই ধিকিধিকি আগুনকে বাড়তে দেওয়া মানে যে রীতিমতো বিপদকে আলিঙ্গন করা, তা গেরুয়া নেতৃত্বের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আর তাই চটজলদি সরকার ত্যাগের ব্যবস্থা, যাতে সাপও মরে আবার লাঠিও না ভাঙে।
মুফতিকে ত্যাগ করে বিজেপি এটাই দেখাতে চাইল যে, সন্ত্রাসবাদ ও দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা কোনো সমঝোতায় যেতে রাজি নয়; তাতে একটি রাজ্যের ক্ষমতা যদি হাতছাড়া হয় তো হোক। জনপ্রিয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেক সুবিধা থাকে। তারা তাদের জনপ্রিয়তাবাদের আফিম প্রতিনিয়ত মানুষকে খাইয়ে তাদের এমন নেশাচ্ছন্ন করে দিতে পারে যে, এক সময় তাদের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড নিয়েও মানুষের মনে হতে থাকে যে, সেসব দেশের ভালোর জন্যই সম্পাদিত হচ্ছে। আর এখানেই তাদের কেল্লাফতে। জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের অন্যতম শরিক দল হিসেবে সে রাজ্যের যাবতীয় সমস্যার দায় বিজেপি কখনোই উপেক্ষা করতে পারে না, কিন্তু সময়মতো পিঠ বাঁচিয়ে সমস্ত দোষের বোঝা পিডিপির ঘাড়ে চাপিয়ে তারা প্রমাণ করল যে, অবস্থা বেগতিক বুঝলে তারা খোদ গণতন্ত্রকেই উৎসর্গ করতে পিছপা নয়।
জম্মু ও কাশ্মীরের সরকার ত্যাগ করে বিজেপি আড়াল করল তাদের প্রধান নেতা মোদীকে
বিজেপির কাশ্মীরের সরকার ত্যাগের মধ্যে দিয়ে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদিত হলো। এক তো রাজ্যটির দোহাই দিয়ে একটি জাতীয় বার্তা দেওয়া হলো, আর অন্যদিকে, বিজেপি নিজেদের ট্রাম্প কার্ড মোদীকে একটি বড়সড় ব্যর্থতা থেকে আড়াল করল। যেকোনো ভারতীয় নেতৃত্বের কাছেই কাশ্মীর এবং পাকিস্তান নিয়ে কার্যকরী নীতি প্রণয়নই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। আর যেখানে নেতৃত্ব প্রথম থেকে আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি রাখতে পারে না, সেখানে আত্মরক্ষার জন্যে এমনতরো উপায় বের করতেই হয় বৈকি। নতুবা মুখ পোড়ে। তেমনভাবেই, মোদীর ভাবমূর্তি তাজা রাখতে বিজেপিকে এই মোক্ষম চাল দিতেই হয়।
কিন্তু শাসনতন্ত্রে চাল দেওয়াটাই মোক্ষ নয়; তাতে রাজধর্ম পালনটাই বড়। বিজেপির আরেক প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তার কাশ্মীর নীতিতে ‘কাশ্মীরিয়াত, জম্মুরিয়াত এবং ইনসানিয়াত’-এর কথা বলেছিলেন। কাশ্মীরের মতো সংবেদনশীল সমস্যার মোকাবিলা করতে পেশী প্রদর্শনের কথা বলেননি- এমনকি বিজেপির শীর্ষ নেতা হয়েও না। আজকে শাসকের ধর্মে এই নীতির কথা কেন অনুপস্থিত?
শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের সাদা-কালোয় সমস্ত বিষয়টি বিচার করে ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ নীতির অবলম্বন করে আর যা-ই হোক, কাশ্মীরকে নয়াদিল্লির কাছে আনা যাবে না। বাস্তবে তাই হচ্ছেও। অথচ নয়াদিল্লি জম্মু ও কাশ্মীরের গণতান্ত্রিক শাসনযন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ার পরেই রাজ্যটিকে কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে, যাতে লৌহনীতি আরও জোরদার করা যায়, নিজেদের অন্ধ সমর্থকদের দেখানো যায় যে দেশের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য গেরুয়া শাসকরা কতটা নিবেদিতপ্রাণ।
বিজেপি ও বুখারি
আলোচনার প্রেক্ষিতে একটি বিষয় উত্থাপন করা জরুরি। বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব গত ১৯ জুন জম্মু ও কাশ্মীরের সরকার থেকে বিজেপির সমর্থন প্রত্যাহারের সংবাদ নিশ্চিত করাকালীন সুজাত বুখারির হত্যাকাণ্ড নিয়ে দু-এক কথা ব্যক্ত করেছিলেন যা আগেই বলেছি।
ঘটনা হচ্ছে, রাম মাধব মহাশয় একদিকে যেমন নিহত বুখারিকে সমবেদনা জানিয়ে সদ্য প্রাক্তন মুফতি সরকারকে আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রশ্নে দায়ী করেছেন, তেমনই আবার তিনি বলেছেন, মুফতি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের সার্বিক উন্নয়ন হতে দেয়নি। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, প্রয়াত বুখারি সাহেব কিন্তু বরাবর বলে এসেছেন যে, শুধু উন্নয়নের বুলি আউড়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে না। যেটা দরকার তা হলো প্রথমেই কাশ্মীর সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা বুঝে এগোনো। অর্থাৎ, বুখারির মৃত্যুতে সমবেদনা জানালেও বিজেপি কিন্তু আদতেই তার মধ্যপন্থী মতামতকে গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। তবে কি বিজেপির কাছে বুখারির নির্মম মৃত্যুটিও একটি রাজনৈতিক সুযোগ মাত্র?
উত্তরটা ভালো জানবেন মোদী। কিন্তু তিনি এই মুহূর্তে ব্যস্ত, আরও নির্বাচন জেতার জন্য।
Featured Image Source: DNA India