মনে করো, তোমার স্ত্রী সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কাজ করে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া দুপরেও সে বিশ্রামের কোনো সুযোগ পায়নি। তাই এখন সে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে; এমন পরিস্থিতিতে তুমি ঘরে ফিরে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললে। এবং বললে, এখন তুমি তার সাথে সঙ্গম করতে চাও। কিন্তু সে বললো, সে এখন খুব ক্লান্ত। এখন তোমার সাথে যৌন সম্পর্ক করতে প্রস্তুত না। তুমি কি মনে করো, এ ধরনের জবাব দেওয়ার অধিকার তার আছে?
সিয়েরা লিওনের ‘হাজবেন্ড স্কুলে’ নবাগতদের নিয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন এক শিক্ষক। তার নাম পিদিয়া। ক্লাসের শুরুতে পিদিয়ার এমন প্রশ্নের জবাবে সবাই সমস্বরে অট্টহাসি দিয়ে বলে ওঠলো-
না না না, এটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না যে, সে এ সময় ঘুমানোর অধিকার চাইবে।
এই খণ্ডচিত্রটি দিয়ে মূলত সিয়েরা লিওনের পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হলো। যাদের অধিকাংশই মনে করে, যৌন সম্পর্ক একমাত্র পুরুষের অধিকার। নারীরা তাতে বাধ্য হয়ে সাড়া দেবে মাত্র। এই চিন্তাকে কেন্দ্র করে পুরো দেশটিতে ভয়ানক নারী নির্যাতন-নিষ্পেষণ ছড়িয়ে পড়েছে। বাল্যবিবাহ ও ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি সাধারণ কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। যার বর্ণনা দিতে গিয়ে দেশটির অন্যতম নারী অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘স্ট্যান্ড টু ইন্ড রেপ’এর নির্বাহী পরিচালক অ্যালোদিজি ওওসবি বলেন–
নারীর প্রতি গার্হস্থ্য সহিংসতা পুরো মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এর কারণ হচ্ছে এখানকার পুরুষরা মনে করে, নারীরা তাদের একান্ত বাধ্যগত সম্পত্তি- যা তারা যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে ব্যবহার করতে পারবে। নারীর ক্ষমতায়নকে এখানে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়।
তিনি আরও বলেন-
পুরুষদের এসব বিশ্বাস পর্যালোচনা করলে মাঝে মধ্যে তাদের মানসিক রোগী বলে মনে হবে। আপনি যদি তাদের এসব বোঝাতে যান, তাহলে তারা আপনার কথায় কোনো ভ্রূক্ষেপই করবে না। নারীর প্রতি সহিংসতা এখানে একটি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে।
যুগ যুগ ধরে সিয়েরা লিওনের নারীদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন ও যৌন সহিংসতা কী কারণে চলে আসছে তারও বর্ণনা করেছেন অ্যালোদিজি ওওসবি। তিনি বলেন-
শিশুরা তাদের পরিবারে এসব নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ড দেখেই বড় হয়ে ওঠে। ফলে তারাও মনে করে এসব পুরুষদের স্বভাবগত ‘পুরুষালি অধিকার’; এসব না করলে তার মধ্যে পৌরুষত্ব নেই। ফলে তারাও পরবর্তীকালে নিজেদের জীবনে এসব অনুশীলন করতে থাকে। এভাবেই এই সহিংসতা বংশ পরম্পরায় চলে আসছে।
তবে এর শুরুটা জানতে হলে আমাদের আরেকটু পেছনের দিকে যেতে হবে। সম্ভবত আমরা সকলেই একমত যে, নারী ও শিশুদের প্রতি সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যুদ্ধকালীন সময়ে। সিয়েরা লিওনের গল্পটাও তেমন।
১৯৬১ সালে সিয়েরা লিওন ব্রিটিশদের উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু তাদের স্বাধীনতা পরবর্তী অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর ছিল না। ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে যেমন ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছিল, সিয়েরা লিওন কিংবা সমগ্র আফ্রিকা অঞ্চলের অধিবাসীদের ভাগ্যেও তেমন নির্মম ঘটনা ঘটেছিল; বরং আরও ভয়ানকভাবে। আর এর প্রধান কারণ ছিল ব্রিটিশদের অযৌক্তিক ও স্বেচ্ছাচার মূলক মানচিত্র নির্ধারণ, অসম সম্পদ বন্টন ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন কাঠামো।
এছাড়া সমগ্র সিয়েরা লিওন ছিল ছোট-বড় অসংখ্য গোত্রের সমন্বিত একটি রাষ্ট্র। ফলে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর এসব গোত্র একে অন্যের সম্পদ দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে। পাশাপাশি দেশটির স্বাধীনতা উত্তর শাসকবর্গ ব্রিটিশদের সাথে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে একটি স্বৈরাচারমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে। ফলে গোত্রের সাথে গোত্র আবার গোত্রের সাথে সরকার – এমন ত্রিমুখী সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। অনিবার্যভাবে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তা ভয়ানক রূপ লাভ করে। শুধু এই ১১ বছরের গৃহযুদ্ধে কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ২ লাখের অধিক নারী এই সময় যৌন সহিংসতার শিকার হয়। তাদের ওপর নানা প্রকারের সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ছিল ধর্ষণের ঘটনা। এ সময় পুরুষরা নারীদের সাথে পশুর মতো আচরণ করতে থাকে; ধর্ষণ তাদের সহজাত অভ্যাসে পরিণত হয়। সেই ধারাবাহিকতা আজও চলছে। যুদ্ধ বন্ধ হলেও সিয়েরা লিওনে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয়নি।
তবে এতসব অন্ধকারের বুকে আশার আলো দেখাচ্ছে ‘দ্য হাজবেন্ড স্কুল’। ২০১২ সালে আফ্রিকার আরেক দেশ নাইজারে প্রথমবারের মতো এই স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে সিয়েরা লিওনেও তার কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়। এই স্কুলে শুধু নারী দেহ কিংবা স্বাস্থ্য সম্পর্কেই শিক্ষা দেয়া হয় না। বরং তারা কীভাবে পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে বিশেষত স্ত্রীদের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণ করতে পারে, তা শিক্ষা দেয়া হয়। নারীদের অধিকার সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তোলা হয়। যেসকল বিষয়ে উভয়ের অবদান রয়েছে সেসকল বিষয়ে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায় শিক্ষা দেয়া হয় যেমন পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে যে স্ত্রীরও মতামত দেয়ার অধিকার রয়েছে তা শিক্ষা দেওয়া হয়।
হাজবেন্ড স্কুলে সপ্তাহে একদিন করে ৬ মাস ব্যাপী কোর্স করানো হয়। তবে এতে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। এই কোর্স ইতিমধ্যেই বেশ কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। কোর্স করার পর পুরুষরা নতুন এক জগতের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাদের মানসিকতা অনেক প্রশস্ত হয়ে যায়। তারা তাদের স্ত্রীদের সাথে সমতার ভিত্তিতে আচরণ করতে সমর্থ হন। এই স্কুলের শিক্ষকরাও সবার কাছে সম্মানের পাত্রে পরিণত হন। যেমন পিদিয়া তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন–
জনগণ আমার ওপর আস্থা রাখে। কেননা আমি তাদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করি। তারা আমার পরিবারে নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি খেয়াল করে। এতে তারা অনুপ্রাণিত হয়। ফলে তাদের পরিবারে যখন কোনো সংকট দেখা দেয়, তখন পুলিশকে না ডেকে তারা আমাকেই আগে ডাকে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য।
হাজবেন্ড স্কুলের সেচ্ছাসেবকরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে পুরুষ ও তাদের পরিবারের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। শিক্ষার পাশাপাশি তারা তাদের স্বাস্থ্য সেবা ও মাতৃত্বকালীন সেবা প্রদান করেন। যৌনবাহিত রোগ ও যৌন সহিংসতায় আক্রান্ত নারীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।
‘জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)’ এর সহযোগিতায় ও স্থানীয় নাগরিক সমাজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘ফ্যামিলি ইনিশিয়েটিভ নেটওয়ার্ক ফর ইক্যুইটি সিয়েরা লিওন (ফাইন-এসএল)’ এর তত্ত্বাবধানে এই হাজবেন্ড স্কুলসমূহ পরিচালিত হয়। স্কুল সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইউএনএফপিএ এর প্রোগ্রাম সমন্বয়কারী বিট্টে আলফা বলেন-
আমরা সকলে সম্মিলিতভাবে হাজবেন্ড স্কুলের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। এতে পরিবারসমূহের মধ্যে নারী নির্যাতন অনেকটা লোপ পেয়েছে। সকলে সহিংসতা মুক্ত একটি অভিন্ন পরিবারে পরিণত হয়েছি।
দেশটির গোত্র প্রধানরাও হাজবেন্ড স্কুলের সুফলের কথা তুলে ধরছেন। দক্ষিণের জেলা বো এর অন্যতম গোত্র প্রধান মইওয়া বেলি; যার বর্তমান বয়স ৬৬ বছর, তিনি বলেন-
স্বামীরা এখন আর আগের মতো স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন করতে পারেন না; কেননা হাজবেন্ড স্কুলের নির্দেশনা রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়েও বেশি কার্যকরী। এছাড়া আমরা সকলেই এখন এই হাজবেন্ড স্কুলের অংশীদার। ফলে এখানকার শিক্ষা মান্য করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বও বটে। তারপরও যদি কেউ নারী নির্যাতন করে বসে, তবে তা সমাজে ব্যাপক ভাবে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।
হাজবেন্ড স্কুলের আরেকটি অসাধারণ উদ্যেগের নাম ‘পামামা প্রোগ্রাম’। এই প্রোগ্রামে পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের সাথে একান্ত মুহুর্তে কী ধরণের আচরণ করবে তা শিখানো হয়। এছাড়া গৃহস্থালি কাজে তারা পরস্পর পরস্পরকে কীভাবে সাহায্য করতে পারে এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কীভাবে গ্রহণ করবে তা শেখানো হয়।
হাজবেন্ড স্কুলের অন্যতম ছাত্র সাইদু ল্যমাইন; যার বর্তমান বয়স ৩৫ বছর; তিনি এই স্কুলে আসার আগে নিয়মিত তার স্ত্রী ফাতিকে প্রহার করতেন এবং তাকে খাবারদাবারের জন্য কোনো টাকা পয়সা দিতেন না। তিনি জানালেন, হাজবেন্ড স্কুল তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং তাকে একজন ‘ভালো মানুষে’ পরিণত করেছে। সাইদু ল্যমাইন যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন পাশে বসে থাকা স্ত্রী ফাতি আনন্দে চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না। ফাতি বললেন-
ওর মধ্যে আসলেই অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন ও আর আমাকে প্রহার করে না। আমাদের এখন একটি ছেলে সন্তানও রয়েছে। আমার স্বামী আমাকে সন্তান লালন পালনেও সাহায্য করে। সে এখন একজন ভালো স্বামী এবং একজন ভালো পিতা।
এত কিছুর পরও একটি প্রবাদ আছে, পুরানো অভ্যাস দূর করা কঠিন। সিয়েরা লিওনের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই প্রবাদটি বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। কেননা অনেকে আবার তার পুরনো অভ্যাসে ফিরে যাচ্ছেন; নারী নির্যাতনের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। তবুও হাজবেন্ড স্কুল সিয়েরা লিওনের জন্য এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সকল অন্যায়-অত্যাচার নির্মূলে এই স্কুল অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হোক – এটাই সবার কামনা।