[২য় পর্ব পড়ুন]
ইতিপূর্বের দুটি পর্বে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইউরোমাইদানের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলিকে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু ইউরোমাইদানকে কোনোভাবেই সম্পূর্ণরূপে ইউক্রেনের ‘অভ্যন্তরীণ ঘটনা’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, কারণ শুরু থেকেই বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে উক্ত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। ইউরোমাইদানে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা এই পর্বের আলোচ্য বিষয়বস্তু।
ইউরোমাইদান আন্দোলনের প্রকৃতি
প্রথমেই যে বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে — ইউরোমাইদান ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ বা ‘নাগরিক অধিকার রক্ষা’ সংক্রান্ত কোনো আন্দোলন ছিল না। ইউক্রেনের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা উক্ত নির্বাচনটিকে ‘স্বচ্ছ’ ও ‘মুক্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। অনুরূপভাবে, ইউক্রেনের তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দল ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’ ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত আইনসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা উক্ত নির্বাচনটিকেও ‘স্বচ্ছ’ ও ‘মুক্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তদুপরি, ইউরোমাইদান শুরুর প্রাক্কালে ইউক্রেনীয় সরকার যে ইউক্রেনীয় জনসাধারণের ওপর বা নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর ব্যাপক দমন–পীড়ন চালাচ্ছিল, এমনটিও নয়।
ইউরোমাইদানের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ইউক্রেনীয় সরকার ও পূর্ব ইউক্রেনের জনসাধারণের সিংহভাগের সঙ্গে ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী বিরোধী দলগুলো ও পশ্চিম ইউক্রেনের জনসাধারণের বৃহদাংশের দ্বন্দ্ব। ইউক্রেন ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নে’র সঙ্গে একটি ‘সম্পৃক্ততা চুক্তি’ স্বাক্ষরের বিষয়ে এবং ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ে’র (বর্তমানে ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন’) সঙ্গে একটি ‘কাস্টমস ইউনিয়ন’ স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছিল। ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী বিরোধী দলগুলো এবং পশ্চিম ইউক্রেনের জনসাধারণের বৃহদাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পক্ষপাতী ছিল, কিন্তু পূর্ব ইউক্রেনের জনসাধারণের সিংহভাগ তদানীন্তন ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাস্টমস ইউনিয়ন স্থাপন করার পক্ষপাতী ছিল।
ইউক্রেনীয় সরকার প্রাথমিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু এই বিষয়ে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেকার আলোচনা ইউক্রেনীয় সরকারের জন্য আশানুরূপ সাফল্য লাভ করেনি। ইউক্রেন সেসময় অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগছিল এবং ইউক্রেনীয় সরকার ধারণা করেছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে ব্যাপক মাত্রায় অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করবে এবং ইউক্রেনকে আইএমএফ থেকে সহজ শর্তে ঋণ লাভের ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেরকম কিছু করেনি। তদুপরি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেই যে কোনো রাষ্ট্র উক্ত জোটের সদস্যপদ লাভ করবে, এরকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। উদাহরণস্বরূপ, তুরস্ক ১৯৬৪ সালে ‘ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ে’র (ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বসূরী) সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত জোটটির সদস্যপদ লাভ করেনি।
তদুপরি, ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্র রাশিয়া ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবর্তে উক্ত জোটের সঙ্গে কাস্টমস ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। সেসময় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এবং রুশ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ শুরু করতে পারে, এরকম আশঙ্কা ইউক্রেনীয় সরকারের মধ্যে ছিল। তাছাড়া, ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাস্টমস ইউনিয়ন স্থাপনের বিনিময়ে রাশিয়া ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তা ও বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। ইউক্রেনীয় সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে, অর্থনৈতিকভাবে রুশ প্রস্তাবটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবের তুলনায় বহুগুণে লাভজনক ছিল। এই পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালের নভেম্বরে ইউক্রেনীয় সরকার ঘোষণা করে যে, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না।
এমতাবস্থায় ইউক্রেনে ‘ইউরোমাইদান’ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ইউরোমাইদান কর্মীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনীয় সরকারকে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তি স্বাক্ষর করতে এবং রাশিয়ার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করা। এই আন্দোলন যে ইউক্রেনীয় জনসাধারণের সর্বস্তরের সমর্থন লাভ করেছিল, এমন নয়। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ইউক্রেনীয় জনসাধারণ সাধারণভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উভয় পক্ষই সাধারণভাবে ইউক্রেনকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে আগ্রহী, কিন্তু এদের একাংশ (যারা প্রধানত পশ্চিম ইউক্রেনে কেন্দ্রীভূত) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পক্ষপাতী, এবং অপর অংশ (যারা প্রধানত পূর্ব ইউক্রেনে কেন্দ্রীভূত) রাশিয়া ও ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পক্ষপাতী। ইউরোমাইদানে যারা অংশগ্রহণ করেছিল ও যারা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল, তারা প্রধানত ইউক্রেনীয় জনসাধারণের পশ্চিমাপন্থী অংশের অন্তর্ভুক্ত।
অর্থাৎ, ইউরোমাইদান ছিল ইউক্রেনের পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত বিভাজনের বহিঃপ্রকাশ। ইউক্রেনীয় সরকার ও ইউরোমাইদানের বিরোধীরা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাচ্ছিল, আর ইউরোমাইদানের সমর্থকরা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাচ্ছিল। এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া ইউক্রেনীয় সরকারকে এবং পশ্চিমা বিশ্ব ইউরোমাইদানকে সমর্থন প্রদান করে। ইউক্রেনের রুশপন্থী অংশ এবং রাশিয়া ইউরোমাইদানকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে, অন্যদিকে ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী অংশ এবং পশ্চিমা বিশ্ব ইউরোমাইদানকে একটি ‘বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।
ইউরোমাইদানে পশ্চিমা বিশ্বের দৃশ্যমান ভূমিকা
ইউক্রেনের রুশপন্থী অংশ এবং রাশিয়ার বক্তব্য অনুসারে, পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনীয় সরকারকে উৎখাত করে তদস্থলে নিজেদের মনোনীত একটি সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী অংশকে ব্যবহার করে ইউরোমাইদানের আয়োজন করেছিল। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউরোমাইদান ছিল পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক পরিচালিত ‘রঙিন বিপ্লব’গুলোর (color revolutions) মধ্যে একটি। কিন্তু ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী অংশ ও পশ্চিমা বিশ্ব এই বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ইউরোমাইদান ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণবিপ্লব এবং এর পশ্চাতে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো ভূমিকা ছিল না।
কিন্তু ইউরোমাইদানের ঘটনাবলি চলাকালে ও ইউরোমাইদান–পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে যে চিত্র পাওয়া যায়, সেটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইউরোমাইদানের সূচনা থেকেই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে এর সঙ্গে জড়িত ছিল এবং এটির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করছিল।
২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর ইউরোমাইদান শুরু হয়। যে ৩টি ইউক্রেনীয় রাজনৈতিক দল ছিল ইউরোমাইদানের উদ্যোক্তা, সেগুলো হচ্ছে ‘উক্রায়নস্কি দেমোক্রাতিচনি আলিয়ান্স জা রেফর্মি’, ‘সভোবোদা’ ও ‘বাৎকিভশ্চিনা’ এবং ৩টি দলই পশ্চিমাপন্থী ও রুশবিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে আরো বহু সংখ্যক পশ্চিমাপন্থী দল ও প্রতিষ্ঠান ইউরোমাইদানের সঙ্গে যুক্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই, ইউরোমাইদান যেহেতু পশ্চিমাপন্থী সংগঠনগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল, সেহেতু প্রাথমিকভাবে এই ধারণারই সৃষ্টি হয় যে, এর পশ্চাতে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা ছিল। তদুপরি, ইউরোমাইদান চলাকালে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনে যে ধরনের কার্যক্রম চালায়, সেগুলো এই ধারণাকে আরো তীব্র করে তোলে।
ইউরোমাইদানের প্রাথমিক পর্যায়ে ২০১৩ সালের ২৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বেশকিছু পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ইউক্রেন সফর করেন এবং ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন লিথুয়ানীয় আইনসভার তদানীন্তন সভানেত্রী লরেতা গ্রুজিনিয়েনে (উল্লেখ্য, লিথুয়ানিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য)। ১ ডিসেম্বর ‘ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে’র (ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনসভা) তদানীন্তন উপ–সভাপতি ইয়াৎসেক প্রোতাসেভিচ, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রাক্তন সভাপতি ইয়েঝি বুজেক, পোল্যান্ডের ‘প্রাভো ই স্প্রাভিয়েদলিভোশ্চ’ (পোলিশ: Prawo i Sprawiedliwość) দলের সভাপতি ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইয়ারোস্লাভ কাচিনস্কি এবং বেশকিছু ইউরোপীয় কূটনীতিবিদ সরাসরি ইউরোমাইদানের বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। ইউরোমাইদানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, উক্ত আন্দোলনটি পশ্চিমা বিশ্বের পূর্ণ সমর্থনপুষ্ট ছিল।
২ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানায় যে, তারা ইউরোমাইদানকে ‘অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা’ হিসেবে বিবেচনা করে না। মার্কিন রাষ্ট্রপতির তদানীন্তন মুখপাত্র জেমস কার্নি মন্তব্য করেন যে, ইউক্রেনীয় সরকারের উচিত ইউক্রেনের নাগরিকদের মতামত ‘মুক্তভাবে প্রকাশে’র সুযোগ সৃষ্টি করা। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে নতুন একটি ‘রঙিন বিপ্লবে’ আগ্রহী কিনা, এই প্রশ্নটিকে তিনি এড়িয়ে যান। সেদিন সুইডিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুইডেনে নিযুক্ত ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং কিয়েভে ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীসমূহ কর্তৃক ইউরোমাইদানকে ছত্রভঙ্গ করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে জবাবদিহিতার দাবি করে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল ইউক্রেনীয় সরকারকে এই মর্মে সতর্কবার্তা প্রদান করেন যে, ইউক্রেনীয় সরকার ‘শান্তিপূর্ণ’ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং ইউক্রেনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেফরি পায়াট মার্কেলের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানান।
একই দিনে প্রাক্তন জর্জীয় রাষ্ট্রপতি মিখেইল সাকাশভিলি ও জর্জিয়ার আদজারা প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন সরকারপ্রধান লেভান ভার্শালোমিদজে (যারা ২০০৩ সালে একটি পশ্চিমা–সমর্থিত ‘রঙিন বিপ্লবে’র মধ্য দিয়ে জর্জিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন) ইউক্রেন সফর করেন এবং ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তদুপরি, একই দিনে ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী মিকোলা আজারভের সঙ্গে ইউক্রেনে নিযুক্ত মার্কিন, কানাডীয় ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং এই বৈঠকে আজারভ ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষ থেকে দাবি জানান যে, সরকারি কার্যক্রমকে স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হতে দেয়ার জন্য ইউরোমাইদান কর্মীদের অবশ্যই তাদের দখলকৃত সরকারি ভবনগুলো থেকে সরে যেতে হবে।
বস্তুত ১ ডিসেম্বর নাগাদ এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, পশ্চিমা বিশ্ব সরাসরি ইউরোমাইদানকে সমর্থন দিচ্ছে এবং ইউক্রেনীয় সরকারও ইউরোমাইদান কর্মীদের কাছে তাদের দাবি না জানিয়ে সরাসরি পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিনিধিদেরকে জানাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোমাইদানের ওপর বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৪ ডিসেম্বর তদানীন্তন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভেলে ইউক্রেন সফর করেন এবং ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ইউরোমাইদানের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সরাসরি মন্তব্য করেন যে, ইউক্রেনের উচিত ইউরোপে যোগদান করা এবং ইউরোপীয় হিসেবে তারা ‘ইউক্রেনের ভাগ্যের প্রতি নির্লিপ্ত থাকতে’ পারেন না।
৫ ডিসেম্বর কিয়েভে ‘অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ’–এর (ওএসসিই) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ ‘ইউক্রেনীয় সরকার কর্তৃক ইউরোমাইদানকে ছত্রভঙ্গ করার প্রচেষ্টা’র প্রতিবাদে এই বৈঠক বয়কট করেন। কিন্তু ওএসসিইর তদানীন্তন মহাসচিব লামবের্তো জান্নিয়ের, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভেস্টারভেলে, তদানীন্তন কানাডীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন বেয়ার্ড এবং আরো কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তদুপরি, ওএসসিইর বৈঠকে অংশগ্রহণকারী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা ইউরোমাইদান কর্মীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকার জন্য ইউক্রেনীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একই দিনে তদানীন্তন ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিওনিদ কোঝারা পোলিশ সংবাদপত্র ‘গাজেতা ভিবোরচা’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচনের আয়োজন করার দাবি জানানোর জন্য ইউরোমাইদান নেতাদের উৎসাহিত করছে।
৬ ডিসেম্বর ইউরোমাইদান নেতারা ইউক্রেনের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য মার্কিন আইনসভার প্রতি আহ্বান জানান। অবশ্য একই দিনে ওএসসিইর ‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয়ে’র তদানীন্তন পরিচালক ইয়ানেজ লেনার্চিচ মন্তব্য করেন যে, ইউরোমাইদান কর্মীদের দ্বারা দখলকৃত সরকারি ভবনগুলো খালি করে দেয়ার জন্য ইউক্রেনীয় সরকার তাদের কাছে যে দাবি জানাচ্ছে, সেটি সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা একটি স্বীকৃত অধিকার হলেও ‘মুক্তভাবে সহিংসতা পরিচালনা’ কোনো অধিকার নয়। ইউরোমাইদান কর্মীদেরকে উদ্দেশ্য করে লেনার্চিচ এই মন্তব্যটি করেছিলেন।
কিন্তু একই দিনে জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসিতে অনুষ্ঠিত একটি সংবাদ সম্মেলনে তদানীন্তন মার্কিন ইউরোপীয় ও ইউরেশীয় বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র সচিব (বর্তমানে রাজনৈতিক বিষয়াবলি সংক্রান্ত সহকারী সচিব) ভিক্টোরিয়া নালান্ড মন্তব্য করেন যে, ইউক্রেনীয় সরকারের উচিত ‘নিজেদের জনগণের মতামত শোনা’ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে অঙ্গীভূতকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করা। তদুপরি, তিনি ইউক্রেনীয় সরকারের কাছে দাবি জানান যে, ইউক্রেনীয় সরকারকে অবশ্যই জনসাধারণের ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ’ করার অধিকারকে সম্মান করতে হবে এবং ইউরোমাইদান কর্মীদের ওপর বলপ্রয়োগকারী নিরাপত্তারক্ষীদের শাস্তি প্রদান করতে হবে।
৭ ডিসেম্বর ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের অন্তর্ভুক্ত ‘ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি’র একটি প্রতিনিধিদল ও প্রাক্তন জর্জীয় রাষ্ট্রপতি সাকাশভিলি ইউক্রেন সফর করেন এবং ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উক্ত প্রতিনিধিদলে ছিলেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রাক্তন সভাপতি বুজেক, ইইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির তদানীন্তন সভাপতি এলমার ব্রোক, ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টির প্রাক্তন উপ–সভাপতি ইয়াৎসেক সারিউজ–ভলোস্কি এবং ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টির পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কর্মকর্তা হোসে ইগ্নাসিও সালাফ্রাঙ্কা। ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সালাফ্রাঙ্কা সরাসরি মন্তব্য করেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান ইউরোমাইদানের পক্ষে। ব্রোক জানান যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনীয় সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তাভাবনা করছে।
৯ ডিসেম্বর ইউক্রেনে অবস্থিত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর দূতাবাসসমূহের প্রতিনিধিরা এবং ইউক্রেনে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত সাইমন স্মিথ ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১০ ডিসেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের তদানীন্তন পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি সংক্রান্ত উচ্চ প্রতিনিধি ক্যাথেরিন অ্যাশটন এবং তদানীন্তন মার্কিন ইউরোপীয় ও ইউরেশীয় বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র সচিব নাল্যান্ড ইউক্রেন সফর করেন। তারা ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অ্যাশটন রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানান। ইয়ানুকোভিচ অ্যাশটনকে জানান যে, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করতে আগ্রহী, কিন্তু ইউক্রেন গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে এবং সেটির মোকাবিলা করা জরুরি।
কিন্তু ১১ ডিসেম্বর ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষী ও ইউরোমাইদান কর্মীদের মধ্যে আবার সংঘর্ষ হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানি ইউক্রেনীয় সরকারের নিন্দা জানায় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে প্রেরিত ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদলকে ব্রাসেলসে প্রবেশ করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। একই দিনে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব নাল্যান্ড ও ইউক্রেনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পায়াট ইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করেন। নাল্যান্ড আবারো ইউক্রেনীয় সরকারের নিন্দা জানান এবং মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদানীন্তন মুখপাত্র জেনিফার সাকি জানান যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার চিন্তাভাবনা করছে।
১২ ডিসেম্বর তদানীন্তন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চার্লস হেগেল তদানীন্তন ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাভলো লেবেদিয়েভকে ফোন করেন এবং ইউরোমাইদানকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীকে ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদান করেন। প্রত্যুত্তরে লেবেদিয়েভ জানান যে, ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনী ইউক্রেনে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটে কোনোভাবেই অংশগ্রহণ করছে না। ১৪ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউক্রেনীয় সরকারকে ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী’দের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়। মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন ও ক্রিস্টোফার মার্ফি ইউক্রেন সফর করেন এবং ইইউরোমাইদান কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মার্কিন সিনেটের একদল রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দলীয় সদস্য একটি খসড়া প্রস্তাব প্রণয়ন করেন। এই প্রস্তাবে মন্তব্য করা হয় যে, ইউক্রেনীয় সরকার স্বল্পমেয়াদী আর্থিক লাভের জন্য ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে ‘বিক্রি করে দিয়েছে’, এবং প্রস্তাবটিতে ইউক্রেনের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আহ্বান জানানো হয়।
১৫ ডিসেম্বর ম্যাককেইন ও মার্ফি ইউরোমাইদান কর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা প্রদান করেন। সেদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপকণ্ঠ ও সম্প্রসারণ বিষয়ক কমিশনার স্তেফান ফিউল জানান যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তি বিষয়ক আলোচনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এজন্য তিনি ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচকে দায়ী করেন। ১৭ ডিসেম্বর রাশিয়া ইউক্রেনকে ঋণ প্রদানে সম্মত হয় এবং এই বিষয়ে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতি তদানীন্তন মুখপাত্র কার্নি এই চুক্তির নিন্দা করেন এবং মন্তব্য করেন যে, এই চুক্তিতে ইউরোমাইদান কর্মীদের দাবিকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
২০১৪ সালের ১১ থেকে ১২ জানুয়ারি খারকিভে ইউরোমাইদানের সমাবেশে জবিগনিয়েভ রোমাশেভস্কি (পোলিশ হেলসিঙ্কি কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন) ও জবিগনিয়েভ বুইয়াক (কমিউনিজমবিরোধী ‘সোলিদারনোশ্চ’–এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন) অংশগ্রহণ করেন এবং বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৬ জানুয়ারি ইউক্রেনীয় আইনসভা ইউরোমাইদানের কার্যক্রমকে প্রতিহত করার জন্য বেশকিছু আইন প্রণয়ন করে, কিন্তু ২০ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিষদ ইউক্রেনীয় সরকারকে উক্ত আইনগুলো বাতিল করার আহ্বান জানায়। ২৪ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশমার ফিউল রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ এবং ইউরোমাইদান নেতা ভিতালি ক্লিচকোর সঙ্গে বৈঠক করেন।
১ ফেব্রুয়ারি ইউরোমাইদান নেতা ক্লিচকো ও আরসেনি ইয়াৎসেনিউক জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ‘মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে’ অংশগ্রহণ করেন এবং তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানায় যে, ইউক্রেনীয় সরকার ‘প্রকৃত অর্থে’ সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করবে, এই শর্তে তারা ইউক্রেনকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার জন্য একটি স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। কিন্তু ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোঝারা জানান যে, ইউক্রেন এই বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পায়নি।
৪ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব নাল্যান্ড ও ইউক্রেনে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পায়াটের মধ্যেকার একটি ফোনালাপের রেকর্ডিং ফাঁস হয়ে যায়। ২৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এই ফোনালাপে তারা ইউক্রেনের তদানীন্তন সরকারের পতনের পর যে নতুন সরকার গঠিত হবে, সেটিতে কারা কারা অংশগ্রহণ করবে সেটি ঠিক করছিলেন। এই ফোনালাপ থেকে জানা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোমাইদান নেতা ইয়াৎসেনিউককে ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করতে ইচ্ছুক ছিল এবং আরেক নেতা ক্লিচকোকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তদুপরি, এই ফোনালাপে নাল্যান্ড ইউক্রেনের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধীরগতিসম্পন্ন পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেন এবং মন্তব্য করেন যে, ‘F**k the EU!’ স্বাভাবিকভাবেই এই ফোনালাপের রেকর্ডিং ফাঁস হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
৬ ফেব্রুয়ারি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ইউক্রেনের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ করে, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া কর্তৃক ‘অত্যধিক চাপ’ প্রয়োগের নিন্দা জানায় এবং প্রস্তাব দেয় যে, ইউক্রেনে ‘সংস্কারে’র বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, ‘ইউরোপীয় পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ব্যাঙ্ক’ আর ‘ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাঙ্ক’ ইউক্রেনকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ প্রদান করবে। তদুপরি, তারা ইউক্রেনীয় সরকার ও ইউরোমাইদানের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য একটি স্থায়ী মিশন গঠনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে এবং মন্তব্য করে যে, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রস্তাবে ব্যবহৃত ভাষা তাদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এজন্য ইউক্রেনীয় সরকার তাদের স্থায়ী মিশন গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
১০ ফেব্রুয়ারি ‘কাউন্সিল অফ ইউরোপে’র মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার নিলস মুইজনিকস ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে ইউরোমাইদান কর্মীদের ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনে’র অভিযোগ আনয়ন করেন এবং জানান যে, ইউক্রেনে এই বিষয়ে যে তদন্ত চলছে, সেটির তত্ত্বাবধানের জন্য কাউন্সিল অফ ইউরোপ একটি পরামর্শদাতা কমিশন গঠন করতে আগ্রহী।
১৮ ফেব্রুয়ারি নাগাদ ইউরোমাইদান কার্যত একটি গৃহযুদ্ধে রূপ নেয় এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি জার্মানি, ফ্রান্স ও পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইউক্রেন সফর করেন। তাদের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনীয় সরকার ও ইউরোমাইদানের মধ্যে একটি ‘যুদ্ধবিরতি’ সম্পাদিত হয়। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাতপরিচয় স্নাইপাররা কিয়েভে ইউরোমাইদান কর্মী ও ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে এবং এর ফলে বহু ইউরোমাইদান কর্মী ও নিরাপত্তাকর্মী হতাহত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে।
ইউরোমাইদানে পশ্চিমা বিশ্বের অদৃশ্যমান ভূমিকা
এখন পর্যন্ত ইউরোমাইদানে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর দৃশ্যমান ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই বিবরণ থেকে এটি স্পষ্ট যে, ইউরোমাইদান আরম্ভ হওয়ার পর থেকেই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ইউরোমাইদানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে ইউরোমাইদানের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছিল। বস্তুত নাল্যান্ড ও পায়াটের মধ্যেকার ফোনালাপ থেকে অনুধাবন করা যায় যে, ইউক্রেনীয় সরকারের যে পতন ঘটবেই, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত ছিল এবং পরবর্তী ইউক্রেনীয় সরকারে কারা অংশগ্রহণ করবে, সেটিও তারা আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিল।
কিন্তু বিভিন্ন সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, পশ্চিমা বিশ্ব যে কেবল ইউরোমাইদান শুরুর পর আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিল, এমন নয়। তাদের মতে, ২০১১ সাল থেকে তারা গোপনে এরকম একটি আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। ২০১৩ সালের ১ মার্চ কিয়েভে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের অভ্যন্তরে প্রথমবারের মতো ইউক্রেনীয় উগ্র জাতীয়তাবাদীদেরকে অনলাইনে সরকারবিরোধী গণআন্দোলন সংগঠিত করার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় শুরু হওয়া ‘আরব বসন্তে’র সময় এতদঞ্চলের সরকারগুলোর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এবং মার্কিনিরা ইউক্রেনীয় উগ্র জাতীয়তাবাদীদের অনুরূপ কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
তদুপরি, কিছু কিছু সূত্রের ভাষ্যমতে, মার্কিনিরা ইউক্রেনীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘প্রাভিই সেক্তরে’র নেতা দিমিত্রো ইয়ারোশকে পোল্যান্ডে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছিল। উল্লেখ্য, ইউরোমাইদান চলাকালে ইয়ারোশের নেতৃত্বাধীন উগ্র জাতীয়তাবাদীরাই ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি সংঘর্ষ শুরু করত এবং এর ফলে ইউরোমাইদান মারাত্মক সহিংস রূপ ধারণ করে। তদুপরি, ইউরোমাইদান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনীয় নব্য অভিজাতদের (oligarchs) ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করে, যাতে তারা ইউক্রেনীয় সরকারকে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকে। উক্ত নব্য অভিজাতদের সম্পদের বৃহদাংশ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে জমা রয়েছে এবং তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এজন্য তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে হয়।
উল্লেখ্য, সেসময় ইউক্রেনের ক্ষমতাসীন ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’ দলের আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ৪০ জন নব্য অভিজাত রিনাত আখমেতভ এবং ৩৮ জন আরেক নব্য অভিজাত সের্হি তিহিপকোর নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিলেন। ইউরোমাইদানের সময় তারা ভিতর থেকে ইউক্রেনীয় সরকারকে দুর্বল করতে থাকেন। যেমন: তাদের বিরোধিতার কারণে ইউক্রেনে জরুরি অবস্থা জারির জন্য ইয়ানুকোভিচের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। সর্বোপরি, বেশকিছু প্রচারমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে যে, ২০ ফেব্রুয়ারিতে কিয়েভে যে অজ্ঞাতপরিচয় স্নাইপাররা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তাদেরকে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ভাড়া করেছিল এবং এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্য ছিল হত্যাকাণ্ডের দায় ইউক্রেনীয় সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের নৈতিক অবস্থানকে সম্পূর্ণভাবে ভঙ্গুর করে ফেলা।
স্বাভাবিকভাবেই, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব ইউরোমাইদানে তাদের অদৃশ্যমান ভূমিকা সম্পর্কে এই বক্তব্যগুলোকে অস্বীকার করেছে। কিন্তু ইউরোমাইদানের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে একটি প্যাটার্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেটি ২০০৪ সালে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত ‘কমলা বিপ্লবে‘র সময় পরিলক্ষিত হয়েছিল। অনলাইন প্রচারণার মাধ্যমে ইউরোমাইদানের বিস্তৃতি, ইউক্রেনীয় সরকারের নিকট বিভিন্ন কঠোর দাবি জানানো, ইউক্রেনীয় সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ছাড়সমূহের সুযোগে আন্দোনলকে আরো জোরদার করা, ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে সংঘাতে লিপ্ত হতে বাধ্য করা, পশ্চিম ইউক্রেনের প্রদেশগুলোর ক্ষমতা বলপূর্বক দখল করে নেয়া — এসবের মধ্য দিয়ে ইউরোমাইদান কর্মীরা ইউক্রেনীয় সরকারের ওপর ভিতর থেকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করছিল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি ও ইউরোমাইদানের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে ইউক্রেনীয় সরকারকে বাইরে থেকে চাপের মধ্যে রাখছিল, এবং একই সঙ্গে ‘নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ সঙ্কটের সমাধানের প্রস্তাব দিয়ে ইউক্রেনীয় সরকারকে বিভ্রান্ত করছিল।
এভাবে ভেতর ও বাইরে থেকে ব্যাপক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তারা ইউক্রেনীয় সরকারকে দুর্বল করে ফেলে এবং ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নাগাদ ইউক্রেনীয় সরকার কার্যত ইউক্রেনের বড় একটি অংশের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। বস্তুত ইউরোমাইদান ছিল ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত আরেকটি ‘রাজনৈতিক–মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’, যার ফলে ইউক্রেনীয় সরকার ২০০৪ সালের মতো ২০১৪ সালেও ধরাশায়ী হয়ে পড়ে।