২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আরম্ভ হওয়া আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে সাম্প্রতিক যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এর মধ্য দিয়ে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলে আসা আর্মেনীয়–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। নাগর্নো–কারাবাখ সংযোগরেখা, আজারবাইজানি–আর্মেনীয় সীমান্ত এবং আজারবাইজানি–ইরানি সীমান্ত বরাবর এই সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। আজারবাইজানি–আর্মেনীয় দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আলোচনার আগে আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় জাতিদ্বয় এবং আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া রাষ্ট্রদ্বয় সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক।
আজারবাইজানি জাতি ‘বৃহত্তর তুর্কি’ জাতির অংশ, এবং তারা আজারবাইজানি ভাষায় কথা বলে, যেটি ‘তুর্কি’ ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত ‘ওঘুজ তুর্কি’ শাখার অন্তর্ভুক্ত। আজারবাইজানিদের সিংহভাগ ধর্মগতভাবে শিয়া মুসলিম, কিন্তু আজারবাইজানিদের মধ্যে কিছু সুন্নি মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীও রয়েছে। আজারবাইজানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯১.৬% জাতিগতভাবে আজারবাইজানি, এবং প্রায় ৯২ লক্ষ আজারবাইজানি রাষ্ট্রটিতে বসবাস করে। কিন্তু আজারবাইজানের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরানে দেড় কোটি থেকে ১ কোটি ৮৫ লক্ষ আজারবাইজানি বসবাস করে, এবং ১৯১৮ সালের পূর্বে ‘ইরানি আজারবাইজান’ নামে পরিচিত উত্তর ইরানের ৪টি প্রদেশকে মূল আজারবাইজান হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আজারবাইজান ও ইরানের বাইরে রাশিয়ায় ১৫ থেকে ৩০ লক্ষ, তুরস্কে ৮ থেকে ৩০ লক্ষ এবং জর্জিয়ায় আড়াই থেকে ৩ লক্ষ জাতিগত আজারবাইজানি বসবাস করে। এছাড়া কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, জার্মানি, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাতিগত আজারবাইজানি বসবাস করে।
‘আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র’ দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র, যার আয়তন ৮৬,৬০০ বর্গ কি.মি. এবং বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১ লক্ষ। রাষ্ট্রটির জনসংখ্যার প্রায় ৯৬.৯% ধর্মগতভাবে মুসলিম, এবং এদের সিংহভাগই শিয়া। রাষ্ট্রটি উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে ইরান, পশ্চিমে আর্মেনিয়া এবং উত্তর–পশ্চিমে জর্জিয়া দ্বারা পরিবেষ্টিত। আজারবাইজানের অন্তর্গত ‘নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র’ আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং ৫,৫০০ বর্গ কি.মি. আয়তন ও প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষের কিছু বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই অঞ্চলটি উত্তর ও পূর্বে আর্মেনিয়া, দক্ষিণ ও পশ্চিমে ইরান এবং উত্তর–পশ্চিমে তুরস্ক দ্বারা পরিবেষ্টিত।
১৮০৪–১৮১৩ এবং ১৮২৬–১৮২৮ সালের রুশ–ইরানি যুদ্ধদ্বয়ে রুশ সাম্রাজ্য ইরানকে পরাজিত করে এবং ইরানের কাছ থেকে বর্তমান আজারবাইজানের ভূমি দখল করে নেয়। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, এবং আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদীরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সহযোগিতায় ১৯১৮ সালের ২৮ মে ‘আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ১৯২০ সালের এপ্রিলে বলশেভিক লাল ফৌজ আজারবাইজানি বলশেভিকদের সহায়তায় প্রজাতন্ত্রটির সরকারকে উৎখাত করে এবং ২৮ এপ্রিল আজারবাইজানি বলশেভিকরা ‘আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি স্বাধীন, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত, একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে, এবং পরবর্তী প্রায় সাত দশক রাষ্ট্রটি কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে ছিল। ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
অন্যদিকে, আর্মেনীয় জাতি একটি স্বতন্ত্র জাতি, এবং তারা আর্মেনীয় ভাষায় কথা বলে, যেটি ইন্দো–ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত একটি ভাষা। আর্মেনীয়দের প্রায় সকলেই ধর্মগতভাবে খ্রিস্টান, এবং তাদের সিংহভাগ ‘আর্মেনীয় অ্যাপোস্টলিক/অর্থোডক্স চার্চে’র অনুসারী। আর্মেনিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৮.১% জাতিগতভাবে আর্মেনীয়, এবং প্রায় ২৯ লক্ষ আর্মেনীয় রাষ্ট্রটিতে বসবাস করে। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ জাতিগত আর্মেনীয় বসবাস করে আর্মেনিয়ার বাইরে। রাশিয়ায় ২০ থেকে ২৫ লক্ষ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮ থেকে ১৫ লক্ষ এবং ফ্রান্সে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ জাতিগত আর্মেনীয় বসবাস করে। এছাড়া জর্জিয়া, ইরান, সিরিয়া, লেবানন, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, গ্রিস, জার্মানি, কানাডা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাতিগত আর্মেনীয় বসবাস করে।
‘আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্র’ দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র, যার আয়তন ২৯,৭৪৩ বর্গ কি.মি. এবং বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ২৯ লক্ষ ৫৬ হাজার। রাষ্ট্রটির জনসংখ্যার প্রায় ৯৪.৮% ধর্মগতভাবে খ্রিস্টান, এবং এদের সিংহভাগই ‘আর্মেনীয় অ্যাপোস্টলিক/অর্থোডক্স চার্চে’র অনুসারী। রাষ্ট্রটি উত্তরে জর্জিয়া, পূর্বে আজারবাইজান ও আর্তসাখ, দক্ষিণে ইরান ও আজারবাইজানের নাখচিভান এবং পশ্চিমে তুরস্ক দ্বারা পরিবেষ্টিত। আর্মেনিয়া একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঐতিহাসিক আর্মেনীয় ভূমির পূর্বাংশ রুশ সাম্রাজ্যের এবং পশ্চিমাংশ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, এবং আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা ১৯১৮ সালের ২৮ মে পূর্ব আর্মেনিয়ায় ‘আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর মিত্রশক্তি পশ্চিম আর্মেনিয়াকে আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছিল, কিন্তু ১৯২০ সালে তুর্কি–আর্মেনীয় যুদ্ধে আর্মেনিয়া পরাজিত হয় এবং তুর্কিরা পশ্চিম আর্মেনিয়া পুনর্দখল করে নেয়। ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে বলশেভিক লাল ফৌজ আর্মেনীয় বলশেভিকদের সহায়তায় পূর্ব আর্মেনিয়া অধিকার করে নেয় এবং সেখানে ‘আর্মেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে, এবং পরবর্তী প্রায় সাত দশক অঞ্চলটি কমিউনিস্ট শাসনের অধীন ছিল। ১৯৯১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে বর্তমান আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উল্লেখ্য, এ সময় জাতিগত আজারবাইজানিরা রুশদের নিকট ‘ককেশীয় তাতার’ নামে পরিচিত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রুশ সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে আর্মেনীয় ও ককেশীয় তাতারদের মধ্যে জাতিগত সংঘাত ছিল বিরল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে রুশ সাম্রাজ্যের অন্যান্য জাতির মতো ককেশীয় তাতার ও আর্মেনীয়দের মধ্যেও জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটে এবং এর ফলশ্রুতিতে জাতি দুইটির মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়। সেসময় আর্মেনীয় বা ককেশীয় তাতারদের জন্য স্বতন্ত্র কোনো ‘জাতিগত অঞ্চল’ ছিল না, ফলে দক্ষিণ ককেশাস জুড়ে জাতি দুইটি মিশ্রভাবে ছড়িয়ে ছিল।
১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে ককেশীয় তাতার ও আর্মেনীয়দের মধ্যে প্রথম গুরুতর দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাকু, মে মাসে নাখচিভান, আগস্টে শুশা এবং নভেম্বরে এলিজাবেথপোলে আর্মেনীয় ও ককেশীয় তাতারদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয় এবং এই দাঙ্গা ক্রমশ পুরো অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৭ সাল পর্যন্ত এই জাতিগত সংঘাত অব্যাহত থাকে, এবং অবশেষে রুশ সেনাবাহিনীর কসাক সৈন্যদের হস্তক্ষেপে এই দাঙ্গার অবসান ঘটে। এই দাঙ্গার ফলে ৩,০০০ থেকে ১০,০০০ আর্মেনীয় ও ককেশীয় তাতার নিহত হয়, এবং ১২৮টি আর্মেনীয় ও ১৫৮টি ককেশীয় তাতার গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দাঙ্গায় তুলনামূলকভাবে ককেশীয় তাতাররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কারণ ককেশীয় তাতারদের তুলনায় আর্মেনীয়রা ছিল অধিকতর সুসংগঠিত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং এর ফলে রুশরা দক্ষিণ ককেশাসের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ১৯১৮–১৯২০ সময়টা ছিল দক্ষিণ ককেশাসের জন্য অত্যন্ত বিশৃঙ্খলাপূর্ণ সময়। এসময় স্থানীয় বিভিন্ন জাতি ও দল ক্ষমতার জন্য পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লিপ্ত ছিল, এবং বিভিন্ন বহিঃশক্তি (যেমন: ওসমানীয় সাম্রাজ্য, জার্মানি, ব্রিটেন, তুর্কি জাতীয়তাবাদী ও রুশ বলশেভিকরা) এই অঞ্চলে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের জন্য হস্তক্ষেপ করছিল। ফলে অঞ্চলটির বিভিন্ন অংশে রাজনৈতিক নেতৃত্বে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল।
এ সময় থেকেই ককেশীয় তাতাররা ‘আজারবাইজানি’ হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করে। ১৯১৮ সালের মার্চে বাকু ও এর আশেপাশের অঞ্চলে বলশেভিক ও আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা প্রায় ১২,০০০ বেসামরিক আজারবাইজানিকে খুন করে। ১৯১৮ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানি, আর্মেনীয় ও জর্জীয় বলশেভিকবিরোধী নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে একটি ‘ট্রান্সককেশীয় ফেডারেশন’ গঠন করে, কিন্তু পারস্পরিক বিরোধের কারণে এটি টিকতে পারেনি। ফলে ১৯১৮ সালের মে মাসেই আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এ সময় থেকেই রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে ভূখণ্ড নিয়ে সংঘাত আরম্ভ হয়। বিশেষত কারাবাখ, নাখচিভান, জাঙ্গেজুর ও কাজাখ অঞ্চলগুলোর অধিকার নিয়ে রাষ্ট্র দুইটি তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। এটি ছিল প্রথম আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধ।
১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ওসমানীয় ও আজারবাইজানি সৈন্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ইসলামি সৈন্যবাহিনী’ বাকু দখল করে নেয় এবং গণহত্যা চালিয়ে ১০,০০০ থেকে ৩০,০০০ বেসামরিক আর্মেনীয়কে খুন করে। একই বছরে আর্মেনীয়রা জাঙ্গেজুরে গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ১০,০০০ বেসামরিক আজারবাইজানিকে খুন করে। ১৯১৯ সালের জুনে কারাবাখ অঞ্চলে আজারবাইজানিরা প্রায় ৭০০ জন বেসামরিক আর্মেনীয়কে খুন করে। ১৯২০ সালের মার্চে শুশা অঞ্চলে আজারবাইজানিরা আরেকটি গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ২০,০০০ বেসামরিক আর্মেনীয়কে খুন করে। কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয়নি। এ সময় আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিরা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও রাজনৈতিক সংঘাতে লিপ্ত ছিল। আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় বলশেভিকরা উভয় রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। অবশেষে সোভিয়েত রুশ সৈন্যদের সহায়তায় ১৯২০ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানি বলশেভিকরা এবং ডিসেম্বরে আর্মেনীয় বলশেভিকরা নিজ নিজ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়।
মস্কো আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। মস্কোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিরোধপূর্ণ নাখচিভান, কাজাখ ও কারাবাখ অঞ্চল আজারবাইজানের হস্তগত হয়, আর জাঙ্গেজুর অঞ্চল আর্মেনিয়ার অধীনস্থ হয়। নাখচিভান ও কাজাখ অঞ্চলে আজারবাইজানিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং জাঙ্গেজুরে আর্মেনীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তাই এই অঞ্চলগুলোর হস্তান্তর বড় ধরনের কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেনি। কিন্তু কারাবাখ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়, কারণ কারাবাখের সিংহভাগ অধিবাসী আর্মেনীয় হলেও এটিকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারাবাখ অঞ্চলটি উচ্চ কারাবাখ ও নিম্ন কারাবাখ নামক দুইটি অঞ্চলে ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত। মস্কো আর্মেনীয়–অধ্যুষিত উচ্চ কারবাখকে সোভিয়েত আজারবাইজানের অন্তর্গত একটি ‘স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে’ পরিণত করে, আর নিম্ন কারাবাখ আজারবাইজানের সঙ্গে পুরোপুরি অঙ্গীভূত হয়ে যায়।
সোভিয়েত সরকার আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যেকার জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে জাতিগত সম্প্রীতি স্থাপনের প্রচেষ্টা চালায়, এবং অন্তত প্রাথমিকভাবে এই বিষয়ে সাফল্য অর্জন করে। ১৯৬০–এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে মোটামুটিভাবে জাতিগত সৌহার্দ্য বজায় ছিল, এবং এসময় বহুসংখ্যক আর্মেনীয় আজারবাইজানে ও বহুসংখ্যক আজারবাইজানি আর্মেনিয়ায় বসতি স্থাপন করে। কিন্তু ১৯৭০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিতে শুরু করে, সেই প্রেক্ষাপটে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং উভয় প্রজাতন্ত্রে তীব্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সৃষ্টি হয়।
নাগর্নো–কারাবাখে বসবাসকারী আর্মেনীয়রা আজারবাইজানি সরকারের বিরুদ্ধে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও কারাবাখের ‘আজারবাইজানিকরণ’ করার অভিযোগ উত্থাপন করতে শুরু করে। ১৯৮৭ সালের আগস্টে তারা আর্মেনিয়ার সঙ্গে যোগদানের জন্য মস্কোর অনুমতি প্রার্থনা করে এবং এই দাবিতে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাগর্নো–কারাবাখ ও আর্মেনিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয়। আজারবাইজানিরা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে এবং আর্মেনীয়দের সঙ্গে তাদের সংঘাত শুরু হয়। আজারবাইজানে বসবাসকারী আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে আজারবাইজানিরা গণহত্যা শুরু করে, এবং আর্মেনিয়ায় বসবাসকারী আজারবাইজানিদের বিরুদ্ধে আর্মেনীয়রা অনুরূপ আক্রমণ চালাতে থাকে।
১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুমগাইতে আজারবাইজানিরা ৩২ থেকে ২০০ জন আর্মেনীয়কে খুন করে এবং আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে লুটতরাজ ও ধর্ষণ চালায়। একই বছরের নভেম্বরে কিরোভাবাদে (বর্তমান গাঞ্জা) আজারবাইজানিদের আক্রমণে ১৩০ জনের বেশি আর্মেনীয় নিহত হয়। ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে বাকু শহরে আজারবাইজানিদের আক্রমণে ৪৮ থেকে ৯০ জন আর্মেনীয় নিহত ও প্রায় ৭০০ জন আহত হয়, এবং প্রায় ২ লক্ষ আর্মেনীয় বাকু ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে আজারবাইজানি সরকার দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকে এবং মস্কোকে সৈন্য প্রেরণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। অনুরূপভাবে, ১৯৮৮ সালে আর্মেনীয়দের সহিংসতার মুখে প্রায় ১ লক্ষ ৬৭ হাজার আজারবাইজানি ও কুর্দি আর্মেনিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
১৯৯১ সালে উভয় প্রজাতন্ত্রই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং নাগর্নো–কারাবাখ নিয়ে তাদের মধ্যে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আর্মেনীয়রা পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হলেও পরবর্তীতে যুদ্ধের চাকা ঘুরে যায় এবং আর্মেনীয়রা সাফল্য অর্জন করতে থাকে। যুদ্ধ চলাকালে আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় সৈন্যরা বেসামরিক জনসাধারণের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি গণহত্যা চালায়। যেমন: ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্মেনীয় সৈন্যরা খোজালিতে ১৬১ থেকে ৬১৩ জন বেসামরিক আজারবাইজানিকে খুন করে। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানি সৈন্যরা মারাগায় ৪৩ থেকে ১০০ জন বেসামরিক আর্মেনীয়কে খুন করে। এই যুদ্ধে কমপক্ষে ১,২৬৪ জন বেসামরিক আর্মেনীয় এবং অনুরূপ সংখ্যক বেসামরিক আজারবাইজানি নিহত হয়।
১৯৯৪ সালে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই যুদ্ধে ৫,৮৫৬ থেকে ৬,০০০ আর্মেনীয় সৈন্য নিহত ও প্রায় ২০,০০০ সৈন্য আহত এবং ১৯৬ জন সৈন্য নিখোঁজ হয়। অন্যদিকে, এই যুদ্ধে ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ আজারবাইজানি সৈন্য নিহত, প্রায় ৫০,০০০ সৈন্য আহত হয় এবং ৪,২১০ জন সৈন্য নিখোঁজ হয়। ৩ থেকে ৫ লক্ষ আর্মেনীয় এবং ৭ লক্ষ ২৪ হাজার আজারবাইজানি এই যুদ্ধের ফলে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। যুদ্ধের ফলাফল ছিল সম্পূর্ণভাবে আর্মেনীয়দের অনুকূলে, কারণ তারা নাগর্নো–কারাবাখের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ এবং এর আশেপাশের ৭টি আজারবাইজানি জেলা দখল করে নিতে সক্ষম হয়। দখলকৃত অঞ্চলে ‘আর্তসাখ প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি কার্যত স্বাধীন, কিন্তু আর্মেনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।
আর্তসাখের আয়তন ১১,৪৫৮ বর্গ কি.মি. এবং বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। রাষ্ট্রটিকে আর্মেনিয়া বা জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্র স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি, কিন্তু আর্মেনিয়া, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লেবানন ও অস্ট্রেলিয়ায় আর্তসাখের ‘প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যালয়’ রয়েছে, যেগুলো কার্যত দূতাবাসের কাজ করে থাকে। অবশ্য প্রিদনেস্ত্রোভিয়া, দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া আর্তসাখকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, কিন্তু প্রিদনেস্ত্রোভিয়া নিজেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিবিহীন এবং দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া মাত্র অল্প কয়েকটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে। অন্যদিকে, আজারবাইজান আর্তসাখের ভূমিকে আজারবাইজানের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসেবে বিবেচনা করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই ব্যাপারে একমত।
১৯৮৮–১৯৯৪ সালের যুদ্ধে আজারবাইজান পরাজিত হলেও বস্তুত নাগর্নো–কারাবাখ দ্বন্দ্বের স্থায়ী অবসান হয়নি। নাগর্নো–কারাবাখ সংযোগ রেখা বরাবর উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে এবং কিছুদিন পরপরই এই সংঘাত নতুন করে শুরু হয়। ২০০৮ সালের মার্চে এবং ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি, জুন ও সেপ্টেম্বরে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, এবং ২০১৬ সালের এপ্রিলে ৪ দিনব্যাপী একটি যুদ্ধে আজারবাইজান আর্তসাখের কাছ থেকে ৮ থেকে ২০ বর্গ কি.মি. ভূমি দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ২০২০ সালের জুলাইয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আবারও সংঘর্ষ দেখা দেয়, এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যেটি এখনো চলমান।
এই সংঘাত আজারবাইজানি–আর্মেনীয় জাতিগত দ্বন্দ্বকে আরো তীব্রতর করে তুলবে, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাধীন আজারবাইজানের জনসাধারণের মধ্যে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ভয় অত্যন্ত তীব্র, এবং ‘আর্মেনীয়ভীতি’ (Armenophobia) আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আজারবাইজানে বর্তমান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গণতান্ত্রিক হলেও কার্যত স্বৈরতান্ত্রিক এবং ‘আলিয়েভ পরিবার’ ১৯৭০–এর দশক থেকে আজারবাইজানকে শাসন করে আসছে। আজারবাইজানি সরকার জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে তীব্র আর্মেনীয়বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে, এবং আজারবাইজানে অবস্থিত সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ পর্যন্ত আজারবাইজানে ৮৯টি আর্মেনীয় গির্জা, ৫,৮৪০টি ক্রুশ এবং প্রায় ২২,০০০ সমাধিস্তম্ভ ধ্বংস করা হয়েছে।
আর্মেনীয়দের প্রতি আজারবাইজানিদের ঘৃণা কতটা তীব্র সেটি একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়। ২০০৪ সালে হাঙ্গেরিতে ন্যাটোর একটি স্কুলে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য একদল আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় সামরিক কর্মকর্তাকে প্রেরণ করা হয়েছিল। সেখানে লেফটেন্যান্ট রামিল সাফারভ নামক একজন আজারবাইজানি কর্মকর্তা আর্মেনীয় লেফটেন্যান্ট গুর্গেন মার্কারিয়ানকে ঘুমন্ত অবস্থায় খুন করে। হাঙ্গেরিতে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়, কিন্তু ২০১২ সালে তাকে আজারবাইজানের নিকট হস্তান্তর করা হয়। আজারবাইজানি সরকার তাকে শাস্তি দেবে বলে হাঙ্গেরিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে সাফারভকে পুরস্কৃত করা হয়। সাফারভ আজারবাইজানে মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করে, ৮ বছরের বকেয়া সমস্ত বেতন লাভ করে এবং আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ তাকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে অভিহিত করেন।
অন্যদিকে, আর্মেনীয়দের মধ্যেও আজারবাইজানিদের প্রতি ঘৃণা ও ভয় তীব্র, এবং আজারবাইজানিভীতি (Azerophobia) আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্মেনিয়া তুলনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এবং এজন্য আর্মেনিয়ার প্রতিটি সরকারই জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তীব্র আজারবাইজানিবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। আর্মেনিয়ায় অবস্থিত কয়েকটি আজারবাইজানি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে, আর্মেনিয়ার ইতিহাস থেকে আজারবাইজানিদের মুছে ফেলা হয়েছে এবং আর্মেনিয়ায় অবস্থিত আজারবাইজানি–নির্মিত স্থাপত্যগুলোকে ইরানি–নির্মিত হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আজারবাইজানিরা মুসলিম এবং আর্মেনীয়রা খ্রিস্টান হলেও এদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে ঠিক ‘ধর্মীয় দ্বন্দ্ব’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। কারণ, জাতি দুইটির দ্বন্দ্ব মূলত ভূখণ্ডকেন্দ্রিক, এবং এক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা নগণ্য। আনুষ্ঠানিকভাবে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া (এবং আর্তসাখ) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এবং এদের কোনোটিকেই ‘মুসলিমবিরোধী’ বা ‘খ্রিস্টানবিরোধী’ বক্তব্য দিতে দেখা যায় না। বরং পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর ক্ষেত্রে তারা জাতিগত পরিচয়কেই মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করে।
সামগ্রিকভাবে, সাম্প্রতিক আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধ আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যেকার শতাব্দীপ্রাচীন জাতিগত ও ভৌগোলিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। এই যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক, এর ফলে জাতি দুইটির মধ্যেকার পারস্পরিক শত্রুতা যে আরো তীব্র হয়ে দাঁড়াবে, সেটি নিঃসন্দেহ।