(পর্ব ১-এর পর থেকে)
২.
ওহাইয়োর সাদা দোতালা বাড়িতে অটো এক রিপাবলিকান পার্টি সমর্থক পরিবারে বড় হন। তিনি ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। তিনি ছিলেন বিশেষ শ্রেণির তরুণদের একজন, যাদের আমরা বলে থাকি ‘অল-আমেরিকান’। ওহাইয়ো হাই স্কুলের মেধাবীদের একজন ছিলেন তিনি। তার গ্রেড ছিল স্কুলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তিনি গণিতে ছিলেন দুর্দান্ত। সকার খেলা আর সাঁতারেও ছিলেন প্রতিভাবান।
তার সম্পর্কে এক সহপাঠী স্থানীয় এক পত্রিকায় লিখেন, তার জনপ্রিয়তা, সুদর্শন চেহারা আর ক্যারিশমা থাকার পরও তাকে সবার আপন মনে হতো। তার পরিবার সচ্ছল হলেও তিনি বৈষয়িক জিনিসের চেয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রতিই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তার পরনে দেখা যেত সাশ্রয়ী কাপড়-চোপড়। তবে স্কুলজীবনের পরেও তার সামনে আরো কিছুদিন সুসময় ছিল।
তিনি ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন। তার ইচ্ছা ছিল ব্যাংকার হওয়ার। ভবিষ্যৎ নিয়ে তার পরিকল্পনা ছিল খুবই গোছানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মের রুমের দেওয়ালে হাতের লেখা তার বিভিন্ন কর্মসূচি লেখা থাকত। এগুলোর মধ্যে তার অ্যাসাইনমেন্টের তারিখ থেকে শুরু করে বাস্কেটবল খেলার সময়ের ব্যাপারেও উল্লেখ থাকত। বন্ধুদের কাছ থেকে জানা যায়, পরিবার আর পড়াশোনাকে তিনি সব কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। সেটা পার্টি করা হোক কিংবা ফুটবল খেলা। যখন তিনি ফাইন্যান্সে ইন্টার্নশিপ জিতে নিলেন, লক্ষ্য অর্জনে তার অটুট থাকা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না।
এক শীতের ছুটিতে তিনি ঠিক করলেন রোমাঞ্চের স্বাদ নেবেন। তিনি অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন। ইতোমধ্যে তার কিউবা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। সামনে হংকংয়ে পড়তে যাবেন। এ সময় তিনি ঠিক করেন, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দমন-নিপীড়ন চালানো দেশ উত্তর কোরিয়ায় ভ্রমণ করবেন। দেশটির সাধারণ নাগরিক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দেশ ত্যাগ করার চেষ্টা করলেও প্রতি বছর হাজার হাজার বিদেশি নাগরিককে সেখানে ভ্রমণ করার অনুমতি দেওয়া হয়। অবরোধের ভারে ভারাক্রান্ত দেশটির অর্থনীতি এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটা গতি করতে পারে।
উত্তর কোরিয়ায় ভ্রমণ করতে হয় চীন থেকে বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে। অটোও পাঁচ দিন চার রাতের ‘নিউ ইয়ার’স পার্টি ট্যুর’-এর জন্য একটা কোম্পানিকে ১,২০০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করেন। তিনি এক ইমেইলের মাধ্যমে জানতে পারলেন- কোম্পানির পক্ষ থেকে তার ভিসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। ট্যুর গ্রুপের সাথে বেইজিং বিমানবন্দরে কখন দেখা করবেন, সেটাও জানিয়ে দেওয়া হলো। আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উত্তর কোরিয়ায় ভ্রমণে যাওয়ার ব্যাপারের নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ, সেখানে আমেরিকান সরকারের সরাসরি সাহায্য করার ক্ষমতা থাকবে না। অটোর পরিবারও তার এই ভ্রমণ নিয়ে উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু তার মা এ প্রসঙ্গে বলেন, “আপনি কেন এরকম একটা ছেলেকে ভ্রমণে যেতে মানা করবেন?”
২০১৫ এর বড়দিনের পর পরই অটো চীনে তার সফরসঙ্গীদের সাথে মিলিত হন। তারা একটা সোভিয়েত আমলের বিমান দিয়ে পিয়ংইয়ংয়ের উদ্দেশ্যে গমন করলেন। উত্তর কোরিয়ার রাজধানীতে সীমান্তরক্ষী পুলিশবাহিনী সবার কাছ থেকে ক্যামেরা জমা রাখে। প্রত্যেকের স্মার্টফোনের প্রতিটি ফাইল খুটে খুটে দেখে নিশ্চিত হয় দেশটির নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো উপাদান আছে কিনা। অটো পাসপোর্ট কন্ট্রোলের দিকে পা বাড়ালেন। এভাবেই তিনি উন্মুক্ত বিশ্ব ত্যাগ করলেন।
৩.
পিয়ংইয়ংয়ে তাদের ভ্রমণের শুরুতে নিয়ে যাওয়া হয় ১৯৬৮ সালে জব্দ করা আমেরিকান নেভির স্পাই শিপ ইউএসএস পুয়েবলো পরিদর্শনে। অদ্ভুত হলেও সত্য- বর্তমানে এটা পর্যটনের নিদর্শন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিদেশি পর্যটকদের সাথে থাকা এক উত্তর কোরীয় গাইড বলেন, এই জাহাজটি সাম্রাজ্যবাদী শত্রু বা ‘ইমপেরিয়াল এনিমি’র কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। পুয়েবলোতে থাকা ৮২ জন আমেরিকান নাবিকদের ১১ মাস ধরে নির্যাতন আর অনাহারের মধ্যে রেখে অবশেষে মুক্তি দেওয়া হয়।
অটো ইতিহাসের এ গল্প শুনে উপলব্ধি করতে পারলেন- তিনি আসলে শত্রু দেশের ভূখণ্ডে আছেন। সম্ভবত এভাবে তিনি এর আগে ভাবেননি। কোরীয় যুদ্ধ ১৯৫৩ সাল থেকে যুদ্ধবিরতিতে থাকলেও এখনো কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি। ফলে উত্তর কোরিয়া কার্যত এখনো দক্ষিণ কোরিয়া ও এর মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধাবস্থায় আছে। ড্যানি গ্রেটন নামে এক চল্লিশোর্ধ্ব ব্রিটিশ ব্যক্তি জানান, অটো এসব তথ্য শুনে বিস্মিত ও ভীত হয়ে যান। গ্রেটন ওই সফরে অটোর রুমমেট ছিলেন।
কিন্তু গ্রেটন ও সফরে থাকা কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, ইউরোপিয়ান ও অন্তত একজন আমেরিকান সঙ্গী অটোকে হাস্যরসের মাধ্যমে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করেন। তারা মজা করে অটোকে ‘ইমপেরিয়াল এনিমি’ ছদ্মনামে ডাকা শুরু করেন। দ্রুতই অটো আবার হাসিখুশি স্বভাবে ফিরে যান, যদিও প্রোপাগান্ডা বিলবোর্ডগুলোতে দেখা যাচ্ছিল উত্তর কোরিয়ার মিসাইল হোয়াইট হাউজ ধ্বংস করে দিচ্ছে।
তারা এরপর দেশটির প্রথম দুই প্রজন্মের স্বৈরশাসক কিম ইল সাং ও কিম জং ইলের ৭০ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলো দেখতে যান। তারা দেখলেন- উত্তর কোরীয় নাগরিকরা এসে তাদের মহান নেতাদের মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। তারা নিজে থেকেই এসেছে, নাকি বিদেশি পর্যটকদের দেখানোর জন্য আনা হয়েছিল, এটা অবশ্য নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে রাজধানী শহরে এমন মঞ্চস্থ নাটকের বাইরেই যে গ্রামগুলোতে মানুষজন অনাহারে ভুগছে, আর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সে ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। সবকিছুই একটা প্রহসনের মতো মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। অটো অবশ্য সাংস্কৃতিক ব্যবধান কিছুটা কমানোর চেষ্টা করেন। উত্তর কোরীয় শিশুদের সাথে তুষারের গোলক নিক্ষেপের খেলায় মেতে ওঠেন।
নতুন বছরের প্রাক্কালে তারা সবাই একটি বারে পানাহার করতে যান। গ্রেটন বলেন, পানাহার শেষে তারা নতুন বছর আগমনের সময়টা হাজার হাজার উত্তর কোরীয়র সাথে উদযাপন করতে পিয়ংইয়ং এর মূল চত্বরে যান। সেই পর্ব শেষে তারা হোটেলে ফিরে আসেন। হোটেলের নাম ছিল ‘আলকাত্রাজ অব ফান’। এমনটা বলা হয় এর অবস্থান দ্বীপের মধ্যে হওয়ায়। বিদেশিদের বিনোদন দেওয়ার জন্য ৪৭ তলা ভবনটিতে পাঁচটি রেস্টুরেন্ট, একটি বার, একটি ম্যাসাজ পার্লার, এবং এর নিজস্ব বোলিং খেলার জায়গা আছে। হোটেলে পৌঁছার পর তরুণ পর্যটকরা বারের দিকে চলে যান। গ্রেটন তখন বোলিং খেলতে চলে যান। তখনই তিনি অটোকে হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে দুই ঘণ্টা ধরে কেউ অটোকে আর খুঁজে পাননি।
উত্তর কোরিয়া পরবর্তীতে একটা ঘোলা সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যায় এক ব্যক্তি হোটেলের নিষিদ্ধ এলাকার এক দেওয়াল থেকে প্রোপাগান্ডা পোস্টার সরিয়ে নিচ্ছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে লোকটা কে বোঝা না গেলেও উত্তর কোরিয়া দাবি করে- এটা অটো। টেলিভিশনে প্রচার করা সেই সংবাদ সম্মেলনে অটো হাতে লেখা একটা স্ক্রিপ্ট দেখে বলছিলেন, তিনি এক স্থানীয় চার্চ, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গোপন সংঘ আর আমেরিকার প্রশাসনের মদদে কোরীয় জনগণের কঠোর পরিশ্রমের নীতি ও অনুপ্রেরণা ধ্বংস করতে, আর বাড়িতে একটা ‘ট্রফি’ নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ‘চুরি’ করেছিলেন।
অটোর স্বীকারোক্তির অনেক কিছুর সাথেই তথ্যের অমিল পাওয়া যায়। যেমন, অটো ছিলেন ইহুদি। তিনি কোনো চার্চের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ করেন, বক্তব্যগুলো প্রকৃতপক্ষে অটোর নিজের ছিল না।
ওই সময়টায় যা-ই হয়ে থাকুক, গ্রেটন ১ জানুয়ারি ভোর ৪টা ৩০ মিনিটে তার ও অটোর কক্ষে পৌঁছেন। অটো ততক্ষণে বিছানায় ঝিমুচ্ছিলেন।
পরদিন সকালে বিমানবন্দরে একটা ডেস্কে সফরকারীদের মধ্যে সবার শেষে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার পালা ছিল দুই ক্লান্ত বন্ধুর। অস্বস্তিকরভাবে দীর্ঘ সময় কাটানোর পর গ্রেটন খেয়াল করলেন- সেখানকার কর্মকর্তারা নিবিড়ভাবে তাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করছেন। তারপর দুজন সেনাসদস্য চলে আসেন সেখানে। একজন এসে অটোর কাঁধে টোকা দেন। গ্রেটন মনে করেছিলেন কর্তৃপক্ষ হয়তো তাদের ‘ইমপেরিয়াল এনিমি’কে শেষবারের মতো বিরক্ত করতে চাচ্ছে। তিনি ঠাট্টা করে অটোকে বলেন, “যাও, এটাই শেষবারের মতো তোমার সাথে দেখা।”
অটো একটা হাসি দিয়ে গ্রেটনের কাছ থেকে সরে চেক-ইন অঞ্চলের পাশে একটা কাঠের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন। অটোর হাত থেকে তখনই তার খুব সাজানো-গোছানো জীবনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায়।