রুশ ‘প্রতিশোধ’
২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর রুশ নৌবাহিনীর ল্যান্ডিং শিপ ‘সিজার কুনিকভ’ বসফরাস প্রণালী দিয়ে যাতায়াতকালে ইস্তাম্বুলের সন্নিকটে এলে জাহাজটির একজন নাবিক তুর্কি জনসাধারণকে ‘৯কে৩৮ ইগ্লা’ সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল প্রদর্শন করেন এবং ঘটনার ভিডিও প্রচারমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোলু এই ঘটনাকে ‘উস্কানি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তুর্কি সরকার তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কারলভকে এই ঘটনার জবাবদিহিতার জন্য তলব করে। রুশ সরকার তুর্কিদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে এবং রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মন্তব্য করেন যে, উক্ত রুশ নাবিক কোনো আইন ভঙ্গ করেননি।
২০১৬ সালের ১৩ মে পিকেকে মিলিট্যান্টরা তুর্কি–ইরাকি সীমান্তের নিকটবর্তী তুর্কি প্রদেশ হাক্কারিতে একটি রুশ–নির্মিত ‘৯কে৩৮ ইগ্লা’ সারফেস–টু–এয়ার মিসাইলের সাহায্যে তুর্কি সেনাবাহিনীর ‘ল্যান্ড ফোর্সেস এয়ার কমান্ডে’র একটি ‘এএইচ–১ডব্লিউ সুপারকোবরা’ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করে এবং এর ফলে ২ জন তুর্কি বৈমানিক (ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট বুরাক বিকেবাহশি এবং ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট মুজদাৎ কেরেম শাহান) নিহত হন। তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান এই ঘটনার জন্য ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’কে দায়ী করেন, কিন্তু এটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে, তার ইঙ্গিত মস্কোর দিকে। তুর্কি রাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমগুলোর কোনো কোনোটি হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ক্ষেপনাস্ত্রটি যে রাশিয়ায় তৈরি সেটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, আবার কোনো কোনোটি সরাসরি রাশিয়াকে দোষারোপ করে। বস্তুত তুর্কিরা এই ঘটনাকে বিগত বছর রুশ বিমান ভূপাতিত করার জন্য রুশদের ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে বিবেচনা করছিল।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালে আঙ্কারার একটি আদালতে তুর্কি সেনাবাহিনীর ল্যান্ড ফোর্সেস এয়ার কমান্ডের স্টাফ কর্নেল মেহমেত শাহিন এই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, তাদের তদন্তের ফলাফল অনুযায়ী, রুশরাই এই হেলিকপ্টার ভূপাতিত করানোর পিছনে দায়ী ছিল। শুধু তাই নয়, কর্নেল শাহিন দাবি করেন যে, ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘সিজার কুনিকভ’ জাহাজ থেকে রুশ নাবিক ইস্তাম্বুলের অধিবাসীদের যে ‘ইগ্লা’ ক্ষেপনাস্ত্রটি দেখিয়েছিল, খুব সম্ভবত সেটিই তুর্কি ‘সুপারকোবরা’ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হওয়ার কিছুদিন আগেই তুর্কি পুলিশ এই মর্মে প্রতিবেদন পেশ করেছিল যে, অনুরূপ ৫০টি রুশ–নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্র পিকেকের হস্তগত হয়েছে।
সুপারকোবরা হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হওয়ার পর তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান পরোক্ষভাবে এবং তুর্কি প্রচারমাধ্যম প্রত্যক্ষভাবে এর জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেন। রুশ সরকারের কাছ থেকে এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি এবং তুর্কি সরকারও আর এই বিষয় নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। সেসময় তুর্কি সরকারের এই ‘নমনীয়তা’র কারণ বোঝা না গেলেও মাসখানেকের মধ্যেই কারণটি স্পষ্ট হয়ে যায়।
রুশ–তুর্কি সঙ্কট ও গোপন কূটনীতি
বস্তুত তুর্কি বিমানবাহিনী রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করার পর তুর্কি সরকার বাহ্যিকভাবে আক্রমণাত্মক ও অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে, কিন্তু কার্যত রাশিয়ার সঙ্গে শত্রুতার পরিণতি সম্পর্কে তারা সতর্ক ছিল। বিশেষত তুরস্কের প্রতি রুশদের প্রতিশোধপরায়ণ আচরণের প্রেক্ষাপটে ন্যাটোর নিষ্ক্রিয়তা এবং ইনজিরলিক বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন যুদ্ধবিমান প্রত্যাহার তুর্কি নেতৃবৃন্দকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। কিন্তু এরদোয়ান ‘সু–২৪এম’ বিমানটি ভূপাতিত করার জন্য রাশিয়ার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। এক্ষেত্রে এরদোয়ানের অনমনীয়তার পশ্চাতে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থের ভূমিকা ছিল। ২০০৩ সালে তুরস্কের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এরদোয়ান নিজেকে তুর্কি জনসাধারণের নিকট একজন ‘নীতিবান’ ও ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছেন এবং তুরস্ককে একটি বৃহৎ শক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন।
তদুপরি, তুর্কি সরকার প্রচার করেছিল যে, রুশ বিমানটি তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করার কারণে সেটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে এবং তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা তুর্কি জনসাধারণের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী অংশের নিকট তুর্কি সরকারের (ও এরদোয়ানের) জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিল। এই পরিস্থিতিতে এরদোয়ান যদি রুশ বিমান ভূপাতিত করার জন্য রাশিয়ার কাছে ক্ষমা চাইতেন, সেক্ষেত্রে এটি প্রতীয়মান হতো যে, রাশিয়া নয়, তিনিই ‘অন্যায়’ করেছেন (যেহেতু ক্ষমা চাওয়ার অর্থ দাঁড়ায় নিজের অন্যায় বা ভুল স্বীকার করে নেয়া)। এরদোয়ান ক্ষমা চাইলে তুর্কি জনসাধারণ, যারা বিশ্বাস করে যে রুশ বিমানটি তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করে অন্যায় করেছে এবং তুরস্ক কর্তৃক বিমানটি ভূপাতিত করাই ছিল ‘ন্যায়’, তাদের প্রতিক্রিয়া হতো নেতিবাচক। তদুপরি, এর মধ্য দিয়ে তুর্কি জনসাধারণের কাছে প্রমাণিত হতো যে, তুরস্ক রাশিয়ার সমকক্ষ নয় এবং রুশ হুমকির সামনে ‘অসহায়’।
সুতরাং রাশিয়ার কাছে ক্ষমা চাওয়া থেকে এরদোয়ান বিরত থাকেন এবং সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এরকম একটি ধারণার ভিত্তিতে তুর্কি সরকার অগ্রসর হতে থাকে। এজন্য তুর্কি সরকার একদিকে রুশদের বিরুদ্ধে বাহ্যিকভাবে কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করতে থাকে, অন্যদিকে আবার রুশদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্যও প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। বস্তুত বিমানটি ভূপাতিত করার কয়েক দিনের মধ্যেই একটি সাক্ষাৎকারে এরদোয়ান মন্তব্য করেন যে, বিমানটি যে রুশদের, সেটি তাদের জানা ছিল না এবং ব্যাপারটি জানা থাকলে বিমানটি কর্তৃক তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘনের বিষয়টি তারা অন্যভাবে মোকাবিলা করতেন। একই সময়ে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোলু রুশদেরকে বিমান ভূপাতিতকরণ ও বৈমানিকের মৃত্যুর জন্য ‘সান্ত্বনা’ প্রদান করেন। বলাই বাহুল্য, রুশদের জন্য এটুকু যথেষ্ট ছিল না।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিক নাগাদ তুর্কি উপ–প্রধানমন্ত্রী মেহমেত শিমশেক জানান যে, তুরস্কের ওপর আরোপিত রুশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে তুর্কি অর্থনীতি অন্তত ৯০০ কোটি (বা ৯ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিসংখ্যান তুর্কি সরকারকে উদ্বিগ্ন করে। ‘একেপি’ দলের একের পর এক নির্বাচন জয়ের মূল কারণ ছিল তাদের অধীনে তুরস্কের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। সুতরাং অর্থনীতিতে এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে তারা পূর্ণরূপে সচেতন ছিল।
এজন্য তুর্কি সরকার রুশ–তুর্কি সঙ্কট নিরসনের জন্য একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করে। রুশ বিমানটি ভূপাতিত করার দায় নিজেদের ওপর থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে তারা তুর্কি বিমানবাহিনীর তদানীন্তন অধিনায়ক জেনারেল আবিদিন উনালের ওপর এর দায়ভার চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। টুইটারে ক্ষমতাসীন দল ‘একেপি’র কিছু সমর্থক দাবি করে যে, জেনারেল উনাল রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের অনুমতি না নিয়েই রুশ বিমানটি ভূপাতিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবং এজন্য তারা জেনারেল উনালের তাৎক্ষণিক পদত্যাগ দাবি করে। কিন্তু তুর্কি সরকারবিরোধী ও জার্মান প্রচারমাধ্যম দাবি করে যে, তুর্কি সরকার রুশ–তুর্কি সঙ্কট নিরসনের জন্য জেনারেল উনালকে ‘বলির পাঁঠা’ (scapegoat) বানাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই রুশরা তুর্কি সরকারের এই ইঙ্গিত উপেক্ষা করে এবং তুর্কি কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
২০১৬ সালের মার্চে তুর্কি পুলিশ ইজমির থেকে রুশ বৈমানিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওলেগ পেশকভের খুনের সঙ্গে জড়িত তুর্কি মিলিট্যান্ট আল্পআরসলান চেলিককে গ্রেপ্তার করে। চেলিককে পেশকভের খুনের দায়ে নয়, বরং অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু এটি স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, রুশদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্যই চেলিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে চেলিক একটি তুর্কি সংবাদপত্রকে সাক্ষাৎকার প্রদানের পর রুশ সরকার চেলিককে পেশকভের খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেপ্তার করার জন্য তুর্কি সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু চেলিকের গ্রেপ্তারের পরেও রুশ–তুর্কি সঙ্কটের অবসান ঘটেনি, কারণ চেলিকের গ্রেপ্তার রুশদের মূল দাবি ছিল না এবং রুশরা ভালোভাবেই জানতো যে, চেলিককে যেকোনো সময় ছেড়ে দেয়া হতে পারে।
এপ্রিলের শেষদিকে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর তদানীন্তন জেনারেল স্টাফের প্রধান (বর্তমান জাতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী) জেনারেল হুলুসি আকার এরদোয়ানকে জানান যে, জাভিৎ চালার নামক একজন তুর্কি ব্যবসায়ীর (ও প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী) মাধ্যমে রুশ সরকারের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। রাশিয়ার দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রে চালারের বাণিজ্যিক স্বার্থ ছিল এবং দাগেস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি রামাজান আব্দুলাতিপভের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। জেনারেল আকার এরদোয়ানকে জানান, আব্দুলাতিপভের মাধ্যমে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উশাকভের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। ৩০ এপ্রিল এরদোয়ান জেনারেল আকার ও চালারের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং তাদেরকে রুশদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। সেই মোতাবেক চালার আব্দুলাতিপভের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তার মাধ্যমে উশাকভের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
এর ফলে চালার ও আব্দুলাতিপভের মাধ্যমে আঙ্কারা ও মস্কোর মধ্যে ‘শাটল ডিপ্লোম্যাসি’ আরম্ভ হয়। উভয় পক্ষ এই ব্যাপারে একমত হয় যে, এরদোয়ান পুতিনের কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করবেন এবং রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য আহ্বান জানাবেন। কিন্তু চিঠিটির ভাষা কেমন হবে, সেটি নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। রুশরা তাদের আগের অবস্থান অনুসারে তুর্কি সরকার কর্তৃক ক্ষমা চাওয়ার ওপর জোর দিচ্ছিল, কিন্তু তুর্কি সরকার এজন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে মে মাস জুড়ে ও জুন মাসের প্রথমদিকে বেশ কয়েকবার প্রস্তাবিত চিঠিটির নতুন খসড়া করতে হয়। চিঠিটি রচনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তুর্কি রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র ও বিশেষ উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিনের ওপর। তদানীন্তন কাজাখস্তানি রাষ্ট্রপতি নুরসুলতান নাজারবায়েভ এই প্রক্রিয়ায় যোগ দেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে শুরু করেন।
এই সময়ের মধ্যেই পিকেকে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তুর্কি সুপারকোবরা হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করে এবং দুজন তুর্কি বৈমানিককে খুন করে। তুর্কি সরকার এজন্য পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে দায়ী করে, কিন্তু তারা জানত যে, আগে হোক আর পরে হোক, রুশরা ‘সু–২৪এম’ ভূপাতিত করার প্রতিশোধ নেবেই। সুতরাং এই বিষয়ে তারা বিশেষ উচ্চবাচ্য করা থেকে বিরত থাকে। তদুপরি, এরদোয়ান এই বিষয় নিয়ে বেশি মাতামাতি করে রুশদের সঙ্গে তার গোপন কূটনীতি বন্ধ করে দিতে আগ্রহী ছিলেন না।
এই পর্যায়ে এসে তুরস্কের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে শত্রুতা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছিল। রুশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে তুর্কি অর্থনীতি প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল, রুশদের সঙ্গে তুর্কি ও সিরীয় কুর্দিদের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক আঙ্কারাকে উদ্বিগ্ন করে তুলছিল, রুশদের কার্যকর তুর্কিবিরোধী প্রচারণা যুদ্ধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুরস্কের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল এবং পিকেকে কর্তৃক রুশ–নির্মিত ক্ষেপনাস্ত্রের মাধ্যমে তুর্কি সুপারকোবরা হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার পর তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী এরকম আরো আক্রমণের আশঙ্কা করছিল। এই পরিস্থিতিতে এরদোয়ানকে মেনে নিতে হয় যে, রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য তুর্কি সরকারের রাশিয়াকে অন্তত আংশিক ছাড় দিতেই হবে।
এদিকে ২২ মে তদানীন্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোলু পদত্যাগ করেন। এরদোয়ানের সঙ্গে ক্ষমতা সংক্রান্ত ও নীতিগত দ্বন্দ্ব ছিল তার পদত্যাগের প্রধান কারণ। দাভুতোলুকে বিশ্লেষকরা ‘নব্য ওসমানীয়বাদী’, ‘প্যান–ইসলামিস্ট’ ও ‘ইখওয়ান–প্রভাবিত আন্তর্জাতিকতাবাদী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। দাভুতোলু ছিলেন সিরিয়ায় তুর্কিদের তখন পর্যন্ত অনুসৃত নীতির মূল প্রণয়নকারী এবং তার পররাষ্ট্রনীতি ছিল কঠোরভাবে রুশবিরোধী। সুতরাং তার রাজনৈতিক পতন রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথকে বহুলাংশে প্রশস্ত করে।
৩১ মে এরদোয়ান রাশিয়ার কাছে নতি স্বীকার না করে রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালান। তিনি একটি বক্তব্যে মন্তব্য করেন, পুতিন একজন বৈমানিকের ভুলের জন্য তুরস্ককে ‘বিসর্জন’ দিয়েছেন এবং তুরস্কের উচিত রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। এই বক্তব্যে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পেশকভের কোন ভুলের কথা বলছেন, সেটি স্পষ্ট করে বলেননি। কিন্তু বিশ্লেষকরা ধারণা করেন যে, পেশকভ ভুলক্রমে তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছিলেন, এরদোয়ান এরকম একটি ধারণা প্রদানের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রুশরা তুর্কি সরকারের এই ইঙ্গিতের প্রতিও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
১২ জুন এরদোয়ান ‘রাশিয়া দিবস’ উপলক্ষে পুতিনের কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করেন এবং তাকে উক্ত দিবসের শুভেচ্ছা জানান। অনুরূপভাবে, নবনিযুক্ত তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমও তদানীন্তন রুশ প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভকে ‘রাশিয়া দিবসে’র শুভেচ্ছা জানিয়ে অনুরূপ একটি চিঠি প্রেরণ করেন। কিন্তু রুশ রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কভ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, তুরস্ক সরাসরি রাশিয়ার কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগপর্যন্ত রুশ–তুর্কি সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ সম্ভব নয়।
২২ জুন তুরস্কে নিযুক্ত কাজাখস্তানি রাষ্ট্রদূত ঝানসেইত তুইমেবায়েভ তুর্কি রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র কালিনকে একটি জরুরি বার্তা প্রদান করেন। এই বার্তার মাধ্যমে তিনি জানান যে, নাজারবায়েভ সেইন্ট পিটার্সবার্গে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং পুতিন জানিয়েছেন, এরদোয়ান যদি ‘সমঝোতাসূচক’ চিঠি প্রেরণ করেন, পুতিন সেটি গ্রহণ করবেন, কিন্তু এরদোয়ানকে ক্ষমা চাইতে হবে। এরদোয়ান রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারে রাজি ছিলেন না।
পুতিনের কাছে এরদোয়ানের চিঠি এবং সঙ্কটের অবসান
২৩ জুন একটি সংবাদ সম্মেলনে কালিন জানান যে, তুরস্ক রাশিয়ার কাছে ক্ষমা চাইবে না। সেদিন সন্ধ্যায় তুইমেবায়েভ আবার কালিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং জানান যে, নাজারবায়েভ ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’র সামিটে যোগদানের জন্য উজবেকিস্তানের তাসখন্দে পৌঁছেছেন এবং পরের দিন তিনি সেখানে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এর মধ্যে যদি এরদোয়ান উক্ত চিঠিটি প্রেরণ করতে পারেন, তাহলে শেষরক্ষা হতে পারে। কালিন তৎক্ষণাৎ এরদোয়ানকে এই ব্যাপারে অবহিত করেন এবং নতুন একটি চিঠির খসড়া প্রস্তুত করেন। এই পর্যায়ে এসে এরদোয়ান নমনীয় হন এবং ‘ক্ষমা চাওয়া’র ব্যাপারে রাজি হন। তিনি চিঠিতে স্বাক্ষর করেন এবং কালিনকে তখনই তাসখন্দের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। কালিন ও চালার ২৪ জুন তাসখন্দে পৌঁছান এবং এরপর নাজারবায়েভ চিঠিটি উশাকভের মাধ্যমে পুতিনের কাছে প্রেরণ করেন।
চিঠিতে রুশ বিমান ভূপাতিতকরণ ও রুশ বৈমানিকের মৃত্যুর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় এবং নিহত বৈমানিকের পরিবারকে তুর্কি সরকারের শোক জানানো হয়। উক্ত চিঠিতে রাশিয়াকে তুরস্কের ‘বন্ধু’ ও ‘কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীরণের আহ্বান জানানো হয়। পুতিন চিঠিটি গ্রহণ করেন এবং উশাকভ কালিনকে জানান যে, ২৭ জুন রুশ সরকার এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য প্রদান করবে। রুশরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং ২৭ জুন ঘোষণা করে যে, তুর্কি সরকার রুশ সরকারের কাছে প্রেরিত একটি চিঠিতে রুশ বিমান ভূপাতিত করার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। একই দিন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ইলদিরিম ও তুর্কি রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র কালিন জানান যে, তুরস্ক এই ঘটনার জন্য নিহত রুশ বৈমানিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত। তদুপরি, তুরস্কের রিসোর্ট নগরী কেমেরের নগর কর্তৃপক্ষ রুশ বৈমানিকের পরিবারকে একটি বাড়ি উপহার দেয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু লেফটেন্যান্ট কর্নেল পেশকভের পরিবার তুর্কি সরকারের ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রস্তাব এবং কেমের কর্তৃপক্ষের উপহার প্রদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
উল্লেখ্য, রুশ সরকার তুরস্ককে রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য তিনটি শর্ত দিয়েছিল: ‘সু–২৪এম’ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটা, তুর্কি সরকারের ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান। তুর্কিরা সু–২৪এম ভূপাতিত করার পর ২০১৬ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে রুশ বিমান অন্তত দুবার তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করে, কিন্তু তুর্কি সরকার কেবল রুশ সরকারের কাছে এর প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে তাদের জবাব সীমাবদ্ধ রাখে। এর মধ্য দিয়ে তুর্কি সরকার কার্যত মৌনভাবে রুশদের প্রথম শর্ত মেনে নেয়। এরপর তুর্কি সরকার পুতিনের কাছে প্রেরিত চিঠিতে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ২৭ জুন ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রস্তাব দেয়। এর মধ্য দিয়ে তুরস্ক রাশিয়ার তিনটি শর্তই মেনে নেয় এবং প্রায় সাত মাসব্যাপী রুশ–তুর্কি স্নায়ুযুদ্ধে নিজেদের পরাজয় পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে রুশ–তুর্কি সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়।
অবশ্য এটি উল্লেখ্য যে, তুর্কি সরকারের এই ‘ক্ষমাপ্রার্থনা’ মোটেই আন্তরিক ছিল না এবং কেবল রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের লক্ষ্যে তারা এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিল। রুশদের কাছে তুর্কি সরকারের নতি স্বীকারের ফলে তুর্কি জনমতের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, সে সম্পর্কে তুর্কি সরকার পূর্ণভাবে অবগত ছিল। এজন্য তুরস্ক রাশিয়ার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রস্তাব প্রদান করার পরপরই তুর্কি সরকার ও সরকার–নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম তাদের এই পদক্ষেপের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রোধ করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে।
তুর্কি সরকার–নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমগুলো দাবি করে যে, এরদোয়ান পুতিনের কাছে ‘ক্ষমা’ (apology) চাননি এবং পুতিনের কাছে প্রেরিত চিঠির কোথাও ‘ক্ষমা চাওয়া’র কথা উল্লেখ নেই। তাদের ভাষ্যমতে, এরদোয়ান কেবল রুশ বৈমানিকের মৃত্যুর জন্য ‘অনুশোচনা’ (regret) প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোনো কাজের জন্য ‘অনুশোচনা’ প্রকাশের অর্থই হচ্ছে সেই কাজটি যে ভুল ছিল সেটিকে স্বীকার করে নেয়া। তদুপরি, এরদোয়ানের চিঠিতে ‘অনুশোচনা’ প্রকাশের জন্য চিঠিতে যে রুশ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি হচ্ছে ‘Извините’ (ইজভিনিতে), যেটির ইংরেজি অর্থ দাঁড়ায় ‘Excuse me!’ অথবা ‘I beg your pardon!’ সুতরাং তুর্কি প্রচারমাধ্যম যাই দাবি করুক না কেন, মস্কো এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পুতিনের কাছে প্রেরিত এরদোয়ানের চিঠিকে তুরস্কের ‘ক্ষমা চাওয়া’ হিসেবেই বিবেচনা করেছিল।
ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যাপারেও তুর্কি সরকার আন্তরিক ছিল না। প্রথমে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ইলদিরিম জানান, তুর্কি সরকার নিহত রুশ বৈমানিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে রাজি। কিন্তু রুশ বৈমানিকের পরিবার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরই তিনি তার আগের বক্তব্য থেকে সরে আসেন এবং মন্তব্য করেন যে, তুর্কি সরকার কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি নয়। অবশ্য এরদোয়ানের মুখপাত্র কালিন মন্তব্য করেন যে, রুশ বৈমানিকের পরিবার চাইলে তুর্কি সরকার তাদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে, এবং কালিন তার বক্তব্য থেকে সরে যাননি। কিন্তু লেফটেন্যান্ট কর্নেল পেশকভের পরিবার এমনিতেও তুর্কি সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিতে রাজি ছিল না এবং এজন্য ক্ষতিপূরণের বিষয়টি কার্যত ধামাচাপা পড়ে যায়।
শুধু তা-ই নয়, তুর্কি সরকার রুশদের কাছে নতি স্বীকার করেনি, তুর্কি জনসাধারণের কাছে এই বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য যেদিন এরদোয়ান পুতিনের কাছে চিঠি প্রেরণ করেন, সেদিনই গ্রেপ্তারকৃত আল্পআরসলান চেলিককে সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি প্রদান করা হয়। অবশ্য ২০১৭ সালে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রায় তিন বছর পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে আবার মুক্তি প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, চেলিককে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পেশকভের খুনের জন্য আইনত কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। তাকে অন্যান্য অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং এটি করা হয়েছিল মূলত মস্কোকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য।
তুর্কি সরকারের প্রকৃত মনোভাব সম্পর্কে অবগত থাকার পরেও মস্কো তাদের এই ‘ক্ষমাপ্রার্থনা’ গ্রহণ করে, কারণ তুরস্ককে ঘিরে রুশদের নিজস্ব ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনা রয়েছে। রুশ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সর্ববৃহৎ হুমকি হচ্ছে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো এবং এই জোটকে দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় করা রুশ পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম সশস্ত্রবাহিনী এবং ন্যাটোর সামরিক সক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু ২০১০–এর দশকের প্রথম দিকে সিরিয়া ও অন্যান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং ‘সু–২৪এম’ সঙ্কট শুরুর পর তুরস্কের প্রতি ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের অভাব এই বিরোধকে আরো প্রকট করে তোলে। রুশরা এই বিরোধকে কাজে লাগিয়ে ন্যাটোর অভ্যন্তরে বিভেদ সৃষ্টি করতে আগ্রহী এবং এজন্য দীর্ঘদিন তুরস্কের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে লিপ্ত থাকা তাদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে লাভজনক ছিল না। এজন্য রুশরা তুরস্কের ‘ক্ষমা প্রার্থনা’/’অনুশোচনা’ গ্রহণ করে এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা শুরু করে।