(পর্ব ২-এর পর থেকে)
২৩ মার্চ সকালে এভার গিভেনের অবস্থান থেকে ৫০ মাইল উত্তরে ইসলামিয়াতে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের হেডকোয়ার্টারের কন্ট্রোল টাওয়ারে তার শিফট কেবল শুরু করছিলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ এলসাইদ হোসেইন। পাইলটরা রেডিওর মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দিয়েছিল উত্তরমুখী জাহাজের বহরগুলোর মধ্যে ১৩ নম্বর জাহাজটি খালে আটকে গেছে। তিনি তার সামনে থাকা মনিটরে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে সেখানকার অবস্থা দেখতে পাচ্ছিলেন। কন্ট্রোল টাওয়ারের কেউ কখনো এরকম কিছু দেখেনি। জাহাজটি খালের পথে আড়াআড়িভাবে আটকে গেছে। ক্যামেরা জুম করে এলসাইদ দেখতে পেলেন এভার গিভেনের ব্রিজে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন কান্থাভেল।
সাবেক নেভি ক্যাপ্টেন এল সাইদ একজন কঠোর ব্যক্তিত্ব। তিনি চিফ পাইলট হিসেবে তার দায়িত্ব খুব গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকেন। প্রায় ৪০ বছরের সমুদ্রে অভিজ্ঞতা ও সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষে এক দশক কাজ করার পর তিনি ২ বছর আগে এই পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
এল সাইদ প্রতিদিন চারটি বহর তদারকি করেন। দুটি দক্ষিণ দিক থেকে ও দুটি উত্তর দিক থেকে। তার দায়িত্বগুলোর একটি হচ্ছে নটিক্যাল কোরিওগ্রাফি। খালের অর্ধেকেরও বেশি অংশ বড় জাহাজগুলো একে অন্যকে অতিক্রম করার জন্য খুবই সরু। এ কারণে জাহাজগুলো বহরের মাধ্যমে খাল পাড়ি দিয়ে থাকে। এক গ্রুপ পার হয়ে আসা পর্যন্ত অন্য গ্রুপ অপেক্ষা করে।
এল সাইদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এটা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছিল যে এভার গিভেন সবচেয়ে বাজে জায়গাগুলোর একটিতে আটকে পড়েছে। এটা ছিল খালের একমুখী রাস্তাগুলোর একটি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজের চোখে অবস্থাটা দেখে আসবেন। গাড়িতে সংক্ষিপ্ত এক ভ্রমণ শেষে কার্গো জাহাজে আসেন। তিনি বড় বড় বাণিজ্যিক জাহাজ দেখে অভ্যস্ত থাকলেও এভার গিভেনের পর্যায় তার কাছে আলাদা ছিল। এটা দেখে তার কাছে কোনো ধাতব পর্বতের মতো মনে হয়েছিল।
পানির নিচে জাহাজের সামনের মোটা অংশ যেন পাথর আর অমসৃণ বালিতে খঞ্জরের মতো নিয়ে আসা হয়েছিল। কোনোভাবে জাহাজের পেছনের অংশও খালে আটকা পড়ে যায়, যা বিপরীত তীরের দিকে ছিল। এতে তীরের সাথে জাহাজের ৪৫ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি হয়। এতে কোনো জাহাজ বা নৌকার অতিক্রম করার কোনো পথ থাকে না। কন্টেইনারবাহী জাহাজ কৌণিকভাবে রাখার জন্য নকশা করা হয় না। এভার গিভেনের ভর তখন সমভাবে বণ্টিত থাকে না। জাহাজের মাঝখানের অংশের ভর কেবল কয়েক মিটার পানি বহন করছিল। এলসাইদ চিন্তা করছিলেন জাহাজটি হয়তো মাঝখানে ভেঙে অর্ধেক হয়ে যাবে।
ঘটনাস্থলে ততক্ষণে খাল কর্তৃপক্ষের দুটি টাগবোট পৌঁছে যায়। ডুবুরিরা পানির নিচে গিয়ে দেখেন জাহাজ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা। তিনি একটা মই দিয়ে জাহাজের ব্রিজে উঠেন কান্থাভেলের সাথে দেখা করার জন্য। ক্যাপ্টেন তখন কাঁপছিলেন। এলসাইদ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, “সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”
তিনি কান্থাভেলের কাছ থেকে তথ্য নেন কার্গোর ভর ও ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কে থাকা পানির পরিমাণ সম্পর্কে। তারা যদি জাহাজ থেকে কিছু ভর কমাতে পারেন, তাহলে হয়তো অতিরিক্ত প্লবতা তীর থেকে জাহাজকে সরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে। এলসাইদ দ্রুত কিছু মানসিক অঙ্ক মেলানো শুরু করেন। জাহাজের প্রতি সেন্টিমিটারে ভাসমান মাল বহন করার ক্ষমতা আছে ২০১ টন। জাহাজকে ১ মিটার পানি থেকে সরাতে ২০ হাজার টনের বেশি কার্গো সরানোর প্রয়োজন। খাল কর্তৃপক্ষ যদি ভূমি থেকে ৫০ মিটার উঁচুতে থাকা কন্টেইনারগুলো সরানোর মতো ক্রেন খুঁজেও পায়, সেটার জন্য অনেক শ্রম দিতে হবে।
এভার গিভেনের সাথে ক্যাবল দিয়ে লাগানো দুই টাগ বোট তখন একে টেনে মুক্ত করার চেষ্টা করল। বোটগুলোর ইঞ্জিন সর্পিল আকারে পানি ছড়িয়ে দিতে লাগল। জাহাজ এক চুলও নড়ল না। এল সাইদ ও তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ওসামা রাবি একটা পরিকল্পনা তৈরি করলেন। তারা ১২ ঘণ্টা শিফটে পর্যায়ক্রমে খননকারী যন্ত্র দিয়ে জাহাজের সামনের অংশ ও লেজের দিকের পাথুরে মাটি খনন করবেন। অন্যদিকে টাগবোটগুলো তাদের সর্বোচ্চ অশ্বক্ষমতা দিয়ে জাহাজকে টানতে থাকবে।
খননকারী যন্ত্রগুলো ভাটার সময় গর্ত তৈরি করবে এবং এতে জোয়ারের সময় তৈরি হওয়া অতিরিক্ত প্লবতাকে কাজে লাগাবে টাগ বোটগুলো। খননকারী যন্ত্রগুলোর কাজে সাহায্য করার জন্য তিনি খাল কর্তৃপক্ষের দুটি ড্রেজার ও ভাসমান বার্জ জাহাজ ঘটনাস্থলে নিয়ে যেতে বলেন। দিনের পরবর্তী সময়ে সেগুলো চলে আসে।
শুরুতে ঘটনাস্থলে দেখা যায় একটা হলুদ খননকারী যন্ত্র, যা নিকটবর্তী অঞ্চলে কাজ করা এক কন্ট্রাক্টরের কাছ থেকে পাঠানো হয়েছিল। এর চালক অস্বস্তির সাথে জাহাজের দিকে এগিয়ে যান এবং যন্ত্রটির ধারণক্ষমতা অনুযায়ী জাহাজের সামনের অংশের চারপাশের শক্ত মাটি টেনে আনতে থাকেন। পরবর্তীতে ইনসাইডারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি সে সময় খুব ভীত ছিলেন। তার সামনে থাকা বিশাল ধাতব দানবটির পতন হয়ে তাকে চেপ্টা করে দিতে পারত।
সেখানে খাল কর্তৃপক্ষের কমুনিকেশন টিম এক ফটোগ্রাফার রেখেছিল বহির্বিশ্বকে দেখানোর জন্য খাল পুনরায় চালু করার জন্য তারা কী কাজ করছে। সেই ফটোগ্রাফারের ছবিতে দেখা যায় বিশাল আকারের জাহাজকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে ক্ষুদ্র এক খননকারী যন্ত্র। এভার গিভেনের পাশে থাকা নিঃসঙ্গ এই যন্ত্রের ছবি অনলাইন দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। ইতিহাসের প্রথমবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুটের পাশাপাশি মিমে পরিণত হয় সুয়েজ।
কিথ জভেন্ডসেনের মোবাইল ফোন যখন বেজে উঠল, তিনি তখন অফিসের দিকে ড্রাইভ করে যাচ্ছিলেন। ফোনে তাকে খবরটি দেন নেদারল্যান্ড ভিত্তিক কন্টেইনার পোর্ট এপিএম টার্মিনালসের তার এক সহকর্মী। বিস্তারিত তথ্য ছিল অপ্রতুল, কিন্তু সুয়েজে তখন একটা ঝামেলা চলছিল এটা বোঝা যাচ্ছিল। এপিএমটির প্যারেন্ট কোম্পানি মায়েরসকের কর্মকর্তারা আরো তথ্য জানার জন্য অস্থির হয়ে পড়ছিলেন।
এভারগ্রিন গ্রুপের মতো শিপিং কংলোমারেট কোম্পানিগুলো যদি সামুদ্রিক বাণিজ্য সচল রাখে, এপিএমটি সেখানে সমুদ্র ও স্থল বন্দরের সাথে সংযোগকারী হিসেবে কাজ করে। তারা প্রতি বছর লস এঞ্জেলেস, মুম্বাই, গথেনবার্গসহ ৭০টি স্থানে দিন-রাত ৩২,০০০ জাহাজে মাল বোঝাই ও খালি করে থাকে। মালয়েশিয়ান বন্দর তানজুং পেলেপাসেও তাদের মালিকানা আছে, যেখানে সুয়েজের আগে এভার গিভেন শেষবারের মতো থেমেছিল।
ডেনিশ কর্মী জভেন্ডসেন এপিএমটির চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি যখন দ্য হেগে তার অফিসে পৌঁছান, তখন এই পরিস্থিতি নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন না। সুয়েজে দুর্ঘটনা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না এবং এগুলোর সমস্যা সধারণত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সমাধান হয়ে যেত। তিন দশক ধরে সমুদ্রের নাবিক ও শিপিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করার সময় তিনি অনেক বারই এমন ফোন পেয়েছেন, যার কিছু ছিল সমুদ্রপথেই। এসব ক্ষেত্রে তারা সাধারণত নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পেরেছিল। (পরবর্তী অংশ পর্ব ৪-এ)