[১ম পর্ব পড়ুন]
২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয়রা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ফুটেজ আপলোড করে, এবং সেটিতে বেশ কয়েকটি বিধ্বস্ত রুশ সামরিক সরঞ্জাম দেখতে পাওয়া যায়। ইউক্রেনীয়দের ভাষ্য অনুসারে, একটি রুশ সামরিক বহর ইউক্রেনের (বর্তমানে রুশ–নিয়ন্ত্রিত) খেরসন প্রদেশের রাজধানী খেরসন শহর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সময় ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীর বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন উক্ত বহরটির ওপর আক্রমণ চালায়, এবং এর ফলে বেশ কিছু রুশ সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস হয়। কিন্তু ইউক্রেনীয়রা ঘটনাটির যে ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে, সেটিতে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের কোনো চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়নি। সেটিতে কেবল কিছু বিধ্বস্ত রুশ সামরিক সরঞ্জাম দেখতে পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের সঙ্গে উন্নতমানের ক্যামেরা সংযুক্ত থাকে, এবং যখনই উক্ত ড্রোন ব্যবহার করে কোনো আক্রমণ পরিচালনা করা হয়, সেটির দৃশ্য উক্ত ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে যায়। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারির ভিডিও ফুটেজটি ড্রোন থেকে নেয়া হয়নি, বরং ভূমি থেকে নেয়া হয়েছিল। ইউক্রেনীয়রা উক্ত ঘটনার ড্রোন ফুটেজ সরবরাহ করতে পারেনি। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের আক্রমণে নয়, বরং অন্য কোনো ধরনের লড়াইয়ে উক্ত রুশ সামরিক সরঞ্জামাদি ধ্বংস হয়েছিল। বস্তুত, ২৪ ফেব্রুয়ারিতে রুশরা ইউক্রেনের বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহরের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ধ্বংস করে দেয়ায় ইউক্রেনীয় জনসাধারণের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল। ধারণা করা যায়, ২৫ ফেব্রুয়ারির ‘কথিত’ বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের দাবি ছিল সেই হতাশা দূরীভূত করা এবং জনসাধারণকে উজ্জীবিত করতে ইউক্রেনীয়দের একটি কৌশল।
২৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নিকটে অবস্থিত গস্তোমেল/হস্তোমেল শহরে রুশ প্যারাট্রুপারদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ প্যারাট্রুপাররা গস্তোমেলে/হস্তোমেলে অবস্থিত আন্তোনভ বিমানবন্দরে অবতরণ করে এবং বিমানবন্দরটি অধিকার করে নেয়। ইউক্রেনীয় সৈন্যরা পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং বিমানবন্দরটির নিয়ন্ত্রণের জন্য উভয়পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি নাগাদ রুশ প্যারাট্রুপাররা বিমানবন্দরটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু গস্তোমেল/হস্তোমেল শহরে রুশ ও ইউক্রেনীয়দের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলতে থাকে।
ইউক্রেনীয়রা দাবি করে, তাদের বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের আক্রমণে রুশ প্যারাট্রুপারদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারা এই আক্রমণেরও কোনো ড্রোন ফুটেজ প্রকাশ করেনি, কিংবা রুশ প্যারাট্রুপারদের ক্ষয়ক্ষতির কোনো চিত্রও প্রকাশ করেনি। এর থেকে প্রতীয়মান হয়, আন্তোনভ বিমানবন্দর দখলের লড়াইয়েও কার্যত বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহৃত হয়নি।
২৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনী জানায়, তারা বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করে একটি রুশ জ্বালানিবাহী ট্রেন ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু তারা এই ঘটনারও কোনো ড্রোন ফুটেজ বা অন্য কোনোভাবে গৃহীত ভিডিও ফুটেজ দেখাতে পারেনি। পরবর্তীতে এরকম কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত রুশ জ্বালানিবাহী ট্রেনের ধ্বংসাবশেষও পাওয়া যায়নি। সুতরাং, বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন সম্পর্কিত ইউক্রেনীয়দের এই দাবিটির সত্যতাও ‘প্রশ্নবিদ্ধ’।
অবশ্য, বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন সংক্রান্ত ইউক্রেনের সবগুলো দাবিই যে ভিত্তিহীন ছিল, এমনটি মোটেই নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইউক্রেনীয়রা বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে, যেগুলোতে রুশ বাহিনীর ওপর ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের আক্রমণের দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ‘রিয়েলনায়া ভয়না | উক্রায়না’ নামক একটি ইউক্রেনীয় টেলিগ্রাম চ্যানেলে ১ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়, যেটিতে দেখা যায় যে, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ সামরিক বহরের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। জিওলোকেশন নির্ধারণের মাধ্যমে জানা যায়, খেরসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টারমাকে একটি রুশ সামরিক বহরের ওপর ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন উক্ত আক্রমণটি পরিচালনা করে। পরবর্তীতে উক্ত আক্রমণের আরো নানা আঙ্গিকের ভিডিও প্রচারিত হয়।
ইউক্রেনীয়রা দাবি করে, উক্ত আক্রমণে রুশদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এবং তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত রুশ সামরিক সরঞ্জামের নানা তালিকাও প্রকাশ করে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক তুর্কিঘেঁষা ওসিন্ট প্ল্যাটফর্ম ‘ওরিক্স’ দাবি করে , উক্ত ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে ৮টি রুশ রসদবাহী ট্রাক ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উক্ত ড্রোন স্ট্রাইকের যেসব ভিডিও রয়েছে, এবং উক্ত দাবি প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ওরিক্স যে চিত্র সরবরাহ করেছে, সেগুলোর কোনোটি থেকেই এটি নিশ্চিতভাবে বোঝার উপায় নেই যে, উক্ত আক্রমণে ৮টি রুশ ট্রাক ধ্বংস হয়েছিল। উল্লেখিত ভিডিও ও চিত্রগুলোতে কেবল এটাই দেখতে পাওয়া যায় যে, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ ট্রাকবহরের ওপর বোমাবর্ষণ করছে।
২৭ ফেব্রুয়ারিতে পরিচালিত উক্ত ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের একটি প্রতীকী তাৎপর্য ছিল। ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের বালিউন শহরে রুশ ও সিরীয় বিমান আক্রমণের ফলে ৫০–১০০ জন তুর্কি সৈন্য নিহত হয়। তুরস্ক এই ঘটনার জন্য সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেয়নি। ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে খেরসনে রুশ ট্রাকবহরের ওপর ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের পর তুর্কিরা ও তুরস্ক সমর্থকরা এই মর্মে উল্লাস করে যে, এটি ছিল বালিউনের ঘটনার জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্কের প্রতিশোধ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুসারে, ২৪-২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইউক্রেনের বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহরের সিংহভাগ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনীয়রা কীভাবে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করে রুশদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করল? এই প্রশ্নের দুটি সম্ভাব্য উত্তর রয়েছে। প্রথম সম্ভাব্য উত্তরটি হচ্ছে, ২৪-২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রুশরা ইউক্রেনের সবগুলো বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ধ্বংস করতে পারেনি, এবং অন্তত কয়েকটি বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন রুশ আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়েছিল। দ্বিতীয় সম্ভাব্য উত্তরটি হচ্ছে, ২৪-২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তুরস্ক ইউক্রেনকে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের নতুন একটি চালান সরবরাহ করেছিল।
উল্লেখ্য, ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই তুর্কি বিমানবাহিনীর দুটি ‘এয়ারবাস এ৪০০এম অ্যাটলাস’ সামরিক পরিবহন বিমান কিয়েভে অবতরণ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে, যুদ্ধকবলিত ইউক্রেন থেকে তুর্কি নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য উক্ত তুর্কি বিমান দুটিকে প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু এটি সম্ভব যে, তুর্কি বিমান দুটি বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের একটি নতুন চালান নিয়ে ইউক্রেনে অবতরণ করেছিল। সেক্ষেত্রে এই নতুন ড্রোনবহরের অবস্থান রুশদের জানা থাকার কথা নয়, এবং এই কারণেই ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীর ইতিপূর্বে ক্রয়কৃত বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরেও ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয়রা বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ব্যবহার করে রুশদের ওপর আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়। আরো উল্লেখ্য, উক্ত বিমান দুটি এখন পর্যন্ত ইউক্রেন ত্যাগ করেনি। যদি তুর্কি বিমানদ্বয় প্রেরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য ইউক্রেন থেকে তুর্কি নাগরিকদের উদ্ধার করাই হতো, সেক্ষেত্রে বিমান দুটি এতদিন ইউক্রেনে থাকত না।
খেরসনে রুশ ট্রাকবহরের ওপর বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইউক্রেনীয়রা ও ইউক্রেন সমর্থকরা রুশদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের অবিশ্বাস্য সব সাফল্যের গল্প প্রচার করতে শুরু করে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দাবিটি ছিল- ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে ইউক্রেনে মোতায়েনকৃত রুশ ন্যাশনাল গার্ডের অন্তর্ভুক্ত ৭০ জন চেচেন সৈন্য নিহত হয়েছে। অনলাইনভিত্তিক ইউক্রেনপন্থী প্রচারমাধ্যম ‘ভিসেগ্রাদ ২৪’ উল্লাসের সঙ্গে তাদের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে দাবি করে যে, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের ফলে রমজান কাদিরভের (রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত চেচেন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান) ৭০ জন চেচেন ‘গুণ্ডা’ জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে ‘কয়লা’ হয়ে গেছে। কিন্তু যথারীতি এই ঘটনার কোনো প্রমাণ (আক্রমণের ড্রোন ফুটেজ, নিহত চেচেন সৈন্যদের মৃতদেহের চিত্র প্রভৃতি) তারা উপস্থাপন করতে পারেনি। পরবর্তীতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাস্তবে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেইনি, এবং ইউক্রেনীয়রা ও ইউক্রেন সমর্থকরা উক্ত ঘটনার প্রচারণা বন্ধ করে দেয়।
একই দিনে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ইউক্রেনের চের্নিগভ/চের্নিহিভ প্রদেশে যুদ্ধ চলাকালে রুশ সৈন্যরা তিনটি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করেছে। রুশরা ভূপাতিত ড্রোনগুলোর কোনো চিত্র সরবরাহ করেনি। এজন্য ইউক্রেনীয়রা ও ইউক্রেন সমর্থকরা দাবি করে, রুশরা মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, চলমান রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধে রুশ প্রচারণা যুদ্ধের মান ইউক্রেনীয় প্রচারণা যুদ্ধের তুলনায় বহুলাংশে নিম্ন। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিদিন ইউক্রেনীয়দের হারানো সামরিক সরঞ্জামের একটি তালিকা প্রকাশ করে, এবং তাদের প্রচারণা যুদ্ধ কার্যত এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তারা ইউক্রেনীয়দের ধ্বংসপ্রাপ্ত সামরিক সরঞ্জামের চিত্র প্রকাশ করে না বললেই চলে। এর ফলে যুদ্ধে রুশদের পারফর্মেন্স সম্পর্কে নানাবিধ সংশয় দেখা দিয়েছে, এবং রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যাদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
কিন্তু রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যাদিকে ঢালাওভাবে ‘মিথ্যা’ বা ‘ভুয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করার কোনো সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৮ জুনের বিবৃতি অনুসারে, ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ জুনের মধ্যে ইউক্রেনীয়রা ৩,৬১৩টি ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সশস্ত্র যুদ্ধযান হারিয়েছে। কিন্তু রুশরা খুব অল্প সংখ্যক ধ্বংসপ্রাপ্ত বা দখলকৃত ইউক্রেনীয় ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সশস্ত্র যুদ্ধযানের চিত্র প্রকাশ করেছে, এবং এর ভিত্তিতে ইউক্রেনীয় ও ইউক্রেন সমর্থকরা শুরু থেকেই রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই তথ্যকে ‘মিথ্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এসেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৮ জুন ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ জুনের মধ্যে ইউক্রেনীয়রা অন্তত ৪০০টি ট্যাঙ্ক ও অন্তত ১,৩০০টি ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকল (আইএফভি) হারিয়েছে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেনীয়রা বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র যুদ্ধযান ব্যবহার করে, এবং এগুলোর মধ্যে ট্যাঙ্ক ও আইএফভি কেবল দুই ধরনের সশস্ত্র যুদ্ধযান। এর বাইরে ইউক্রেনীয়রা এই যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি), ইনফ্যান্ট্রি মোবিলিটি ভেহিকল, রিকনিস্যান্স ভেহিকল প্রভৃতি সশস্ত্র যুদ্ধযান হারিয়েছে, যেগুলোর ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও প্রকাশ করেনি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বহরের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যেসব তথ্য প্রদান করেছে, সেগুলো পুরোপুরি সঠিক না হলেও ‘সঠিকের কাছাকাছি’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এজন্য রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যাদিকে ঢালাওভাবে ‘মিথ্যা’ হিসেবে আখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই।
২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের জন্য একটি ‘গৌরবময়’ দিন। এই দিন রুশদের ওপর ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের আক্রমণের বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ ‘বুক–এম২ ৯এ৩১৬’ ট্রান্সপোর্টার ইরেক্টর লঞ্চারের (টিইএল) ওপর বোমাবর্ষণ করছে, এবং সেটির পাশে ছিল একটি ৯এ৩১৭ ট্রান্সপোর্টার ইরেক্টর লঞ্চার অ্যান্ড রাডার (টিইএলএআর/টেলার)। আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ ‘কামাজ’ ট্রাকের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ রসদবাহী ট্রাকবহরের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। ‘ওরিক্সে’র বক্তব্য অনুসারে, উক্ত আক্রমণে রুশদের ১টি ‘কামাজ’ ও ২টি ‘উরাল–৪৩২০’ রসদবাহী ট্রাক ধ্বংস হয়।
একই দিনে প্রকাশিত আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনের ঝিতোমির প্রদেশে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ ‘বুক–এম১–২’ ৯এ৩১০এম১–২ টিইএলএআর/টেলারের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। অন্য একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ যোগাযোগ স্টেশনের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ জ্বালানিবাহী ট্রেনের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। সর্বশেষ আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ আর্মার্ড ফাইটিং ভেহিকলের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। অর্থাৎ, ২৮ ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন রুশদের উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয়।
২ মার্চ ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ জানান, ইউক্রেন তুরস্কের কাছ থেকে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের একটি নতুন চালান পেয়েছে। একই দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয় এবং দাবি করা হয় যে, উক্ত ফুটেজে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের আক্রমণে ১টি রুশ সেল্ফ–প্রোপেল্ড হাউইটজার ধ্বংস হওয়ার ঘটনা দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই দাবিটি মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়, কারণ এটি ড্রোন থেকে ধারণকৃত ফুটেজ ছিল না, এবং ফুটেজটি কার্যত এতটাই অস্পষ্ট ছিল যে, এটি দেখে কোনোকিছুই বোঝার উপায় নেই। এদিকে ৫ মার্চ রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রুশ সৈন্যরা একটি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
৫ মার্চ একটি ইউক্রেনীয় ‘আন্তোনভ আন–১২৪–১০০’ ভারী পরিবহন বিমান তুরস্কের তেকিরদা শহর থেকে উড্ডয়ন করে, এবং পোল্যান্ডের জেশভ শহরে অবতরণ করে। উল্লেখ্য, তেকিরদায় তুরস্কের বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন নির্মাণ কারখানা অবস্থিত, এবং ধারণা করা হয়, উক্ত ইউক্রেনীয় পরিবহন বিমানটি বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের নতুন একটি চালান সংগ্রহের জন্য সেখানে এসেছিল। পোল্যান্ড থেকে উক্ত নতুন ড্রোনবহরকে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে প্রেরণ করা হয়।
কার্যত, ১-৬ মার্চের মধ্যে রুশদের ওপর ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের কোনো ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু ৭ মার্চ থেকে আবার ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হতে থাকে। বস্তুত প্রতীয়মান হয় যে, ৭-১৪ মার্চ পর্যন্ত রুশ সশস্ত্রবাহিনী ও ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনবহরের মধ্যে তীব্র লড়াই সংঘটিত হয়েছে। ৭ মার্চে প্রকাশিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ ‘বুক–এম২’ ৯এ৩১৭ টিইএলএআর/টেলারের ওপর বোমাবর্ষণ করছে।
১০ মার্চ ইউক্রেনীয় নৌবাহিনী একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে, এবং সেটিতে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় নৌবাহিনীর বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ ‘বিএমডি–২’ এয়ারবোর্ন ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকলের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। সেদিন প্রকাশিত আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ ‘বুক–এম২’ ৯এ৩১৭ টিইএলএআর/টেলারের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। একই দিনে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রুশ সৈন্যরা ৩টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
১১ মার্চে প্রকাশিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন কিয়েভের কাছে অবস্থানরত রুশ সামরিক বহরের অন্তর্ভুক্ত একটি ‘উরাল–৪৩২০’ ট্রাক এবং একটি ‘কামাজ’ ট্রাকের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। একই দিনে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রুশ সৈন্যরা ৫টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
১২ মার্চে বিভিন্ন রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়। এরকম একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ ‘পান্তসির–এস১’ সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল সিস্টেমের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ সামরিক যানের ওপর বোমাবর্ষণ করছে, কিন্তু উক্ত রুশ যানের সঠিক পরিচিতি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন কিয়েভের কাছে একটি রুশ ‘উরাল’ ট্রাকের ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার বা সি২ সংস্করণের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ রসদবাহী ট্রাকের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। একই দিনে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রুশ সৈন্যরা ২টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
১৩ মার্চ ইউক্রেনীয় স্থলবাহিনী তাদের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে এবং সেটিতে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ ‘বিএম–২৭ উরাগান’ মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেমের ‘৯পি১৪০’ লঞ্চারের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। একই দিনে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফ তাদের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে এবং সেটিতে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ সামরিক যানের ওপর বোমাবর্ষণ করছে, কিন্তু উক্ত রুশ সামরিক যানটির সঠিক পরিচিতি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। একই দিনে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রুশ সৈন্যরা ২টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
১৪ মার্চে প্রকাশিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন একটি রুশ আর্টিলারি কমান্ড পোস্টের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। সেদিনের আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন খেরসনের একটি সেতুর কাছে একটি রুশ ‘তর’ সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল সিস্টেমের ওপর বোমাবর্ষণ করছে। একই দিনে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রুশ সৈন্যরা একটি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
১৫ মার্চ থেকে এপ্রিলের শেষভাগ পর্যন্ত ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন স্ট্রাইকের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়নি। অর্থাৎ, এই সময়ের মধ্যে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর সাফল্যজনক কোনো আক্রমণ পরিচালনা করতে পারেনি। কিন্তু রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের আকাশ থেকে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করতে থাকে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যানুসারে, ১৫-৩১ মার্চের মধ্যে রুশ সৈন্যরা ১৮টি ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ভূপাতিত করে।
সামগ্রিকভাবে, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চের মধ্যে তুরস্ক ইউক্রেন অন্তত দুই বা তিন ধাপে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের চালান সরবরাহ করে। ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং ৭-১৪ মার্চের মধ্যে ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনগুলো বেশ কিছু রুশ সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংসে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৪ মার্চের পর বেশ কিছু দিনের জন্য ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোনের কার্যকারিতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। তদুপরি, ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চের মধ্যে রুশ সৈন্যরা বহুসংখ্যক ইউক্রেনীয় বায়রাক্তার টিবি–২ ড্রোন ধ্বংসে সক্ষম হয়।