বর্তমান যুগ গণতন্ত্রের জয়জয়কারের যুগ। আবার কারো মতে গণতন্ত্রের পিছু হটার বা ভাটার সময়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেমন প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের শাসন, তেমনই ভঙ্গুর গণতন্ত্র সুযোগ তৈরি করে দেয় জনবিদ্বেষী কর্তৃত্ববাদ বিকাশের। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকৃতি ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একক কর্তৃত্ববাদী নেতার শাসন, আবার কোথাও গণতন্ত্রের ছত্রছায়ায় চলছে কর্তৃত্ববাদী শাসন।
লিভস্তকি ও জিবলাটের ভাষায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বর্তমানে হয়ে উঠেছে কর্তৃত্ববাদের সুফলা ভূমি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুঁজি করে জনতুষ্টিবাদী নেতা (পপুলিস্ট) বা জননায়ক (ডেমাগগ) ক্ষমতায় আরোহন করে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে গণতান্ত্রিক নিয়ম, আদর্শ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এর চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্থান ঘটে কর্তৃত্ববাদী সরকারের, ঘটে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু। এই লেখায় ভঙ্গুর গণতন্ত্রে কীভাবে ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী একক শাসনের সূচনা হয় তা তুলে ধরা হচ্ছে।
গণতন্ত্রের মৃত্যু হঠাৎ করে ঘটে না, কোনো নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়েও ঘটে না। এটি মূলত অনেকগুলো অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফল।
এই প্রক্রিয়ায় প্রথমেই আসে বিরোধী দলকে শব্দের দ্বারা আঘাত করা। একজন জননায়ক বিরোধী দলকে বিভিন্ন কটু ও আপত্তিকর মন্তব্য করেন যা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বাইরে। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়- জননায়ক বিরোধী দলকে দেশের শত্রু, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি বলে অভিহিত করেন। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা, যিনি বিরোধী দলকে দেশদ্রোহী বলেছিলেন। এই রকম শব্দ দ্বারা আঘাত আসতে পারে মিডিয়া ও সাংবাদিকদের উপরও। তুরষ্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সাংবাদিকদের সন্ত্রাসবাদের প্রোপাগাণ্ডা মেশিন বলে অভিহিত করেন, যার জন্য তাকে অনেকে সম্ভাবনাময় একনায়ক হিসেবে দেখেন। জননায়করা শুধু এখানে থামে না। তারা বিভিন্নভাবে বিরোধী দলকে আক্রমণ করে। কোণঠাসা করে রাখে রাষ্ট্রের মিডিয়াকে।
কর্তৃত্ববাদী নেতারা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের দলের ও পছন্দমতো লোক বসায়। সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে এভাবে নিজেদের আধিপত্যে নিয়ে আসে। প্রাথমিক অবস্থায় নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, বিরোধী দলকে সংসদে স্থান দেয়া হয়। তারপর শুরু হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আক্রমণ করা। এসব আক্রমণ পরিচালিত হয় কোনো আইনি প্রতিষ্ঠানের বৈধ কার্যক্রমের আড়ালে। যেমন- দুর্নীতি নিরোধ, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান, গণতন্ত্রের মানোন্নয়ন অথবা জাতীয় নিরাপত্তার আড়ালে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
লিভস্তকি ও জিবলাট তাদের বইয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসাকে ফুটবল খেলার সাথে তুলনা করেছেন, এবং তিনটি ধাপ বর্ণনা করেছেন: ১) রেফারিকে হাত করা, ২) সরকারের প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা, এবং ৩) খেলার নিয়ম পরিবর্তন করা।
রেফারিকে হাত করার উদ্দেশ্য হলো একটি শক্ত আবরণ তৈরি করে ফেলা যাতে নির্বাচিত জননায়কের উপর কোনো আঘাত না আসে। এর মাধ্যমে জননায়ক নিজেদের পছন্দের মানুষের পক্ষে ও বিরোধী পক্ষের বিপক্ষে রাষ্ট্রীয় আইন ব্যবহার করে। এই ধাপে রেফারিকে হাত করা হয় মূলত রাষ্ট্রের যত সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা আছেন সেখানে নিজেদের প্রতি আনুগত্যশীল মানুষ বসানোর মাধ্যমে। এক্ষেত্রে জননায়ক তাদের ঘুষ দিয়ে বা ব্ল্যাকমেইল করে নিজেদের প্রতি আনুগত্যশীল বানিয়ে নেন। এক্ষেত্রে বিচারকদের নিজের পছন্দমত বানিয়ে নেয়া হয়। যেসব বিচারক জননায়কের পক্ষে না থাকেন, বেশিরভাগ সময় সেসব বিচারকদের ইমপিচমেন্ট (অভিশংসন) বা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেন।
১৯৪৬ সালে আর্জেন্টিনায় পেরন যখন রাষ্ট্রপতি হন, তখন তাকে যেসকল বিচারপতি ফ্যাসিস্ট বলেছিলেন, এমন তিনজন বিচারককে তিনি ক্ষমতাহারা করে নিজের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে এমন বিচারককে বসান। রেফারিকে হাত করার সবচেয়ে চরম উপায় হলো আদালতকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে নতুন করে আদালত তৈরি করা। এভাবে জননায়ক রেফারিকে হাত করে নিজের ক্ষমতার একটি শক্ত আবরণ তৈরি করেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক হচ্ছে বিরোধী দল। বিরোধী দলের অস্তিত্ব ছাড়া গণতন্ত্র মূল্যহীন। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে পারলে নিজ দলীয় তথা একনায়কের জন্য সুবিধাজনক হয়। রেফারিকে নিজের দলে নিয়ে আসার পর নির্বাচিত একনায়ক বা নির্বাচিত জননায়ক বিরোধী দলের দিকে মনযোগ দেন। তারা বিরোধী দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব যিনি বিরোধী দলের অর্থের বড় উৎস, বিরোধী দলের মিডিয়া, ধর্মীর ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিজের দলে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।
এজন্য তারা বিনিময় মূল্য দিয়ে কেনার চেষ্টা করেন। মিডিয়াকে কিনে নেন। বিরোধী দলের যেসব ব্যক্তিকে কেনা যায় না, তাদের অন্য উপায়ে দুর্বল করে রাখার ব্যবস্থা করেন জননায়করা, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জেল, নির্বাসন, গুম, হত্যা ইত্যাদি। মিডিয়াকে কেনা না গেলে রাষ্ট্রের আইন, প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে বন্ধ করে দেয়া হয়, অথবা প্রচার সীমিত করে দেয়া হয়। রাষ্ট্রের প্রভাবশালী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের নিজেদের দলে আনার ব্যবস্থাও করা হয় এই ধাপে। বিভিন্ন উপায়ে বিরোধী মতাদর্শী বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞদের চুপ করিয়ে দেয়া হয়। এভাবে নির্বাচিত একনায়ক গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে নিজেদের করে নেয় বা নেয়ার চেষ্টা করে।
তৃতীয় ধাপে আছে খেলার নিয়ম পরিবর্তন করা অর্থাৎ একটি রাষ্ট্র চলে যে নিয়ম অনুযায়ী সেগুলো পরিবর্তন করা। এক্ষেত্রে জননায়করা রাষ্ট্রের সংবিধান পরিবর্তন, নির্বাচন কমিশন ও অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দুর্বল করে থাকে। রাষ্ট্রের সংবিধান পরিবর্তন, আইন পরিবর্তন, নতুন আইনের সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে জননায়ক নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। এসব পরিবর্তনকে জননায়করা বোঝাতে চেষ্টা করেন জনকল্যাণকামী হিসেবে। রাষ্ট্রীয় নীতি পরিবর্তন করে তারা বিরোধী দলের প্রভাবশালী ও ক্ষতিকর ব্যক্তিকে থামিয়ে রাখে যাতে তাদের দ্বারা হুমকি সৃষ্টি না হয়।
এভাবে রেফারিকে হাত করে, বিরোধী দলকে কিনে বা অন্য উপায়ে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এবং খেলার নিয়ম পরিবর্তন করে নির্বাচিত জননায়ক নিজেদের বিরোধী দলের উপর প্রতিষ্ঠিত ও শক্ত প্রভাব তৈরি করে। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের নাগরিকরা ব্যর্থ হয় এটা বুঝতে যে তাদের গণতন্ত্র ধীরে ধীরে জীবনাবসানের দিকে যাচ্ছে।
লিভস্তকি ও জিবলাটের বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জননায়করা তাদের অগণতান্ত্রিক আচরণের বৈধতা পাওয়ার জন্য জনসম্মুখে অর্থনৈতিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা, যেমন- যুদ্ধ, সন্ত্রাসী হামলা এগুলোর দোহাই দিয়ে থাকে। মূলত জননায়করা এগুলোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন, কীভাবে তাদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায়, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বহির্ভূত আচরণকে বৈধতা দেয়া যায়।
সাধারণ যুদ্ধ বা সংকটকালীন শাসকদের অবতারবাদী রূপ ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে এবং নিজেদের জনপ্রিয়তা আদায় করে নেন। রাষ্ট্রের নাগরিকদেরও সেই পরিস্থিতিতে জননায়কদের কর্তৃত্ববাদী আচরণ সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না। পৃথিবীর বেশিরভাগ সংবিধান সংকটকালে শাসককে নির্বাহী বিভাগের উপর প্রভাব বেশি বিস্তার করতে সুযোগ দেয়। তাই তখনই সেই সুযোগ গ্রহণ করতে জননায়করা ভুল করে না। ক্ষমতাকে এককেন্দ্রিক করে ফেলে এবং কুক্ষিগত করে ফেলে।
সবশেষে জননায়করা একটি সর্বোচ্চ ও শেষ সুযোগ খুঁজতে থাকে, যাকে কেন্দ্র করে তারা নিজেদের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন করতে পারে। যেমনটা ঘটেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে, ধীরে ধীরে। আর্ক ডিউক ফার্দিনান্দের হত্যা কেন্দ্র করে ইউরোপজুড়ে বেজে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। একটি গণতান্ত্রিক, বলা যায় ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, এভাবে জনমনের আড়ালে ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে কর্তৃত্ববাদ, যা সংঘটিত হয় একজন নির্বাচিত জননায়ক বা সম্ভাবনাময় একনায়কের হাত ধরে।
এভাবে বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রই হয়ে উঠেছে কর্তৃত্ববাদ বিকাশের উত্তম ক্ষেত্র, যা শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি দুর্যোগ বয়ে আনবে।