(পর্ব ৪-এর পর থেকে)
ইসরায়েলের কাছে পেগাসাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হচ্ছে আরব প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন হওয়া। ইসরায়েল প্রথমে এই অস্ত্র বিক্রি করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে। ২০১০ সালে দুবাইয়ের এক হোটেল রুমে এক জ্যেষ্ঠ হামাস নেতাকে মোসাদের এজেন্টরা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করে। তখনকার ডিফেক্টো নেতা ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ এটা নিয়ে ইসরায়েলের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তার কাছে হত্যাকাণ্ড হওয়াটা মূল বিষয় ছিল না। ইসরায়েলিরা আমিরাতের মাটিতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, এটা নিয়েই তিনি নাখোশ ছিলেন। ইসরায়েল ২০১৩ সালে শান্তিচুক্তি হিসেবে পেগাসাস ক্রয় করার প্রস্তাব দেয়। মোহাম্মদ বিন জায়েদ রাজি হন।
আমিরাত তার আভ্যন্তরীণ ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পেগাসাস ব্যবহার করতে কোনো প্রকার দ্বিধা বোধ করেনি। সিটিজেন ল্যাবের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আহমেদ মনসুর নামে সরকারের এক কট্টর সমালোচকের ফোন হ্যাক করার জন্য পেগাসাস ব্যবহার করা হয়েছিল। এ সংবাদ প্রকাশ্যে চলে আসলে অ্যাপল দ্রুতই এক হালনাগাদের মাধ্যমে তাদের ফোনের দুর্বলতা দূর করে। কিন্তু মনসুরের জন্য যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়। তার গাড়ি চুরি হয়ে যায়, ইমেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে যায়, তার অবস্থান সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হয়, তার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়, তার ব্যাংক একাউন্ট থেকে ১,৪০,০০০ মার্কিন ডলার চুরি করা হয়, তার চাকরি চলে যায় এবং রাস্তায় কয়েকবার অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আক্রমণের শিকার হন। তিনি টাইমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
এ রকম পরিস্থিতিতে আপনার মনে হবে প্রতিটা পদক্ষেপই নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। আপনার পরিবার আতঙ্ক অনুভব করবে। আপনাকে এসব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
২০১৮ সালে মনসুরকে তার ফেসবুক ও টুইটারে বিভিন্ন পোস্টের জন্য ১০ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
দুবাই হত্যাকাণ্ড এক দিকে সরিয়ে রাখলেও ইসরায়েল ও আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই ঘনিষ্ট হচ্ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসরায়েল ও পারস্য উপসাগরের সুন্নী রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রধান শত্রু শিয়া রাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে জোট গঠন করেছে। কয়েক দশক আগে এমন জোটের কথা চিন্তাও করা যেত না। তখন আরব বাদশারা নিজেদের ফিলিস্তিনের রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখতেন। তারা ইসরায়েলের কাছ থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের আরব নেতাদের কাছে ফিলিস্তিন ইস্যু গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সুন্নী-শিয়া বিদ্বেষ বেশি গুরুত্ব পায়। এক্ষেত্রে তাদের শত্রুর শত্রু ইসরায়েলকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করছে।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রগামী নেতা সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। বর্তমান বাদশাহ অসুস্থ থাকায় তার পুত্রই এখন দেশটির কার্যত শাসক। ২০১৭ সালে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় প্রিন্স মোহাম্মদের তদারকিতে থাকা সৌদি আরবের এক সিকিউরিটি এজেন্সির কাছে পেগাসাস বিক্রির ব্যাপারে অনুমোদন দেওয়ার। তখন থেকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অল্প কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরাসরি নেতানিয়াহুর কাছে রিপোর্ট করতেন। তারা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে কাজ করতেন। এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা জানান, তাদের আশা ছিল প্রিন্স মোহাম্মদের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা ও প্রতিশ্রুতি আদায় করা। ২০১৭ সালে প্রাথমিকভাবে ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়।
এর কয়েক বছর আগে এনএসও এক ইথিকস কমিটি গঠন করে। এতে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিদলীয় সাবেক পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক কর্মকর্তারা, যারা সম্ভাব্য ক্রেতাদের নিয়ে পরামর্শ দিতেন। ২০১৮ সালে খাশোগজির হত্যাকাণ্ডের পর এনএসওর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে মিডিয়াতে সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কমিটির সদস্যরা জরুরি বৈঠক ডাকেন। হুলিও স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেন ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখকের বিরুদ্ধে পেগাসাস ব্যবহারের ব্যাপারে।
পেগাসাস সিস্টেম প্রতিটি আক্রমণের ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগের প্রেক্ষিতে সেগুলো যাচাই করে দেখতে পারে। ক্রেতার অনুমতি সাপেক্ষে তারা ফরেনসিক বিশ্লেষণ করেও দেখতে পারে। হুলিও বলেন, তাদের কর্মীরা সৌদিদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে খাশোগজির বিরুদ্ধে এনএসওর প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাননি। কমিটি তারপরও পরামর্শ দেয় সৌদি আরবে পেগাসাসের কার্যক্রম গুঁটিয়ে নেওয়ার। তারা সেটা করেও। কমিটির পক্ষ থেকে এও বলা হয় ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে সৌদি আরবে পুনরায় এনএসওর কার্যক্রম চালু করার অনুরোধ আসলেও যেন রক্ষা না করা হয়। এনএসও সৌদি আরবে কার্যক্রম চালানো থেকে বিরত থাকে।
পরের বছর কোম্পানিটি আবার বিপরীত অবস্থান নেয়। হুলিওর সহায়তায় থাকা আরেক ব্রিটিশ বিনিয়োগকারী কোম্পানি নোভালপিনা এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে ফ্রান্সিসকো পার্টনারসের এনএসও শেয়ার কিনে নেয়, যা আমেরিকান ফান্ড ২০১৪ সালে যে দামে কিনেছিল, তার চেয়ে পাঁচ গুণেরও বেশি। ২০১৯ সালের শুরুতে এনএসও আবার সৌদি আরবে কার্যক্রম শুরু করার ব্যাপারে একমত হয়।
নেতানিয়াহুর জন্য রাষ্ট্র পরিচালক হিসেবে তার ভিত্তি শক্ত করার জন্য সৌদি আরবকে খুশি রাখা জরুরি ছিল। ইসরায়েলের সাথে কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সম্প্রীতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি গোপনে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নেতানিয়াহু, ডনাল্ড ট্রাম্প এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আব্রাহাম অ্যাকর্ড শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তারা প্রত্যেকেই এই অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনার অঙ্গীকার করেন।
কিন্তু শান্তি চুক্তির আড়ালে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের অস্ত্র বাজার। ট্রাম্প প্রশাসন নীরবে আমেরিকার অতীতের পররাষ্ট্র নীতি উপেক্ষা করে আরব আমিরাতের কাছে এফ-৩৫ জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার্স ও আর্মড রিপার ড্রোন বিক্রি করে। আমেরিকার সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আরব দেশগুলোর সাথে ঐতিহাসিক চুক্তির ব্যাপারে মোহাম্মদ বিন জায়েদের সম্মতি পাওয়ার জন্য এয়ারক্রাফট বিক্রির চুক্তিটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আব্রাহাম অ্যাকর্ড শান্তি চুক্তির ঘোষণার সময় ইসরায়েল ইতোমধ্যে প্রায় স্বাক্ষরকারী দেশে পেগাসাস বিক্রির অনুমোদন দিয়ে দেয়।
কিন্তু এর এক মাস পর ঘটনার অপ্রত্যাশিত মোড় নেয়। তখন সৌদি আরবে পেগাসাসের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তখন লাইসেন্স নবায়ন করা বা না করার ভার এসে পড়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর। সৌদি আরবে পেগাসাসের অপব্যবহারের কথা বিবেচনা করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় লাইসেন্স আর নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। লাইসেন্স না থাকায় এনএসও সফটওয়্যারের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ সেবা দিতে পারছিল না। ফলে সিস্টেমগুলো অকেজো হয়ে পড়ছিল। প্রিন্স মোহাম্মদের সৌদি কর্মকর্তারা এনএসও নির্বাহীদের কাছে, মোসাদ ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। তখন ক্রাউন প্রিন্স এক জরুরি টেলিফোন কলে নেতানিয়াহুর সাথে কথা বলেন। তিনি পেগাসাসের সৌদি লাইসেন্স নবায়নের কথা বলেন।
প্রিন্স মোহাম্মদ এক দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। তার অসুস্থ বাবা বাদশাহ সালমান আনুষ্ঠানিকভাবে আব্রাহাম অ্যাকর্ড শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি। কিন্তু তিনি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর প্রতি মৌন সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি ওই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ইসরায়েলি বিমানগুলোকে প্রথমবারের মতো সৌদির আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন। সৌদি আরব যদি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে, আব্রাহাম অ্যাকর্ড শান্তি চুক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুখ থুবড়ে পড়বে।
নেতানিয়াহু সম্ভবত এই সংকট সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। কিন্তু প্রিন্স মোহাম্মদের সাথে তার ফোনালাপের পর তার কার্যালয় থেকে তখনই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয় দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে। সে রাতে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এনএসওর অপারেশন রুমে ফোন করে জানান, সৌদি সিস্টেমগুলো পুনরায় কার্যকর করতে। কিন্তু এনএসও কর্মকর্তা তাকে তিরস্কার করে বলেন, কোনো স্বাক্ষর করা লাইসেন্স ছাড়া তারা কার্যক্রম শুরু করবেন না। তখন তাকে জানানো হয় এই নির্দেশটা এসেছে সরাসরি নেতানিয়াহুর কাছ থেকে। এনএসও কর্মকর্তা তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইমেইল পাওয়ার পর কার্যক্রম শুরু করতে একমত হন। খুব দ্রতই সৌদি আরবে পেগাসাস পুনরায় কার্যক্রম শুরু করে।
পরের দিন সকালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এনএসও সদর দপ্তরে একটা কুরিয়ার আসে। এতে করে স্ট্যাম্প লাগানো ও সিল দেওয়া পারমিট চলে আসে।
(পরবর্তী অংশ শেষ পর্বে)