হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট। দানিউব নদীর পাড়। ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি। বিটকয়েনের লোগো।
প্রথম দেখায় মনে হবে প্রতিটি শব্দের মধ্যে কোন যোগসূত্র নেই। তবে সবগুলো শব্দকে একসূত্রে গেঁথে ফেললে বোধহয় এই ভুল ভেঙে যাবে। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত দানিউব নদীর তীরে ব্রোঞ্জের একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে, যে মূর্তিটি মূলত একজন হুডি পরিহিত ব্যক্তির, যার হুডির একপাশে বিটকয়েনের একটি লোগো রয়েছে। বেশ আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, আবক্ষ মূর্তিটির মুখমন্ডলে কান কিংবা চোখ বলতে কিছুই নেই। আপনি সেটি দেখলে বুঝতে পারবেন- এটি অবশ্যই একজন মানুষের মুখাবয়ব, কিন্তু কার প্রতিনিধিত্ব করছে এই মূর্তি, তা সম্ভবত কখনোই বের করতে পারবেন না। তবে মূর্তির মুখমণ্ডল এত চমৎকারভাবে পালিশ করা যে চাইলে আপনি আয়না হিসেবে মুখমন্ডলকে ব্যবহার করতে পারবেন!
বিটকয়েন জগতের রহস্যময় প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিকে সঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্য এর চেয়ে ভালো মাধ্যম বোধহয় আর পাওয়া যেত না। একজন মানুষের তৈরি একটি ভার্চুয়াল লেনদেন ব্যবস্থা এক যুগের মধ্যেই শক্ত ভিত্তি পেয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে কিংবা এক দেশ থেকে আরেক দেশে অর্থ লেনদেন করা সম্ভব হয়েছে যার কল্যাণে, বিশ্বব্যপী প্রচলিত গতানুগতিক মুদ্রাব্যবস্থাকে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছেন যিনি, তাকে কেউ চেনে না, কেউ তার পরিচয় জানে না। বিষয়টা বেশ অদ্ভুত, তা-ই নয় কি? যে মানুষটি এত বড় পরিবর্তন নিয়ে আসল, অথচ তার পরিচয় কেউ বের করতে পারল না? বর্তমানে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আমরা যতটাই গুটিয়ে থাকি না কেন, নানা কারণে আমাদের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া হয়। এরকম একটা সময়েও যে একজন ব্যক্তি নিজের সম্পূর্ণ পরিচয় লুকিয়ে রেখে আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে চলেছেন, বিশ্বব্যাপী এক উদ্ভাবনী মুদ্রাব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা হয়েও সফলভাবে নিজেকে আড়ালে রাখতে পেরেছেন– তা সত্যিই বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে।
যাদের ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, তাদেরকে বিষয়টি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া যাক। সাধারণত আমরা যে মুদ্রাব্যবস্থার সাথে পরিচিত, সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে বহুজাতিক লেনদেনগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক উল্টো। কোনো ব্যাংক, সরকার কিংবা কোনো কর্তৃপক্ষের নজরদারি এড়িয়ে একেবারে স্বাধীনভাবে, রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন করা যায়। এ ক্ষেত্রে আপনি যে লেনদেন করছেন, তার একটি রেকর্ড থাকে অনলাইন সার্ভারে। পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে একজন ব্যক্তি একটি পার্সোনাল কম্পিউটারের মাধ্যমেই বিটকয়েনের সার্ভারের সাথে যুক্ত হতে পারেন। প্রতি দশ মিনিট পর পর মাইনারদের মাধ্যমে বিটকয়েন লেনদেনের রেকর্ড ‘ব্লক’ নামের গ্রুপে সংযুক্ত করা হয় এবং অসংখ্য ব্লককে একত্রে ব্লকচেইন বলা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, চাইলে ক্রিপ্টোকারেন্সির কোনো ইউনিটকে নগদ অর্থে রূপান্তরিত করা যায়। বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে যত বিটকয়েন রয়েছে, তার অর্থমূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
বিটকয়েন তৈরির পেছনে যে ক্রিপ্টোগ্রাফিক কোডিং পদ্ধতি রয়েছে, তার রহস্যভেদ করা প্রায় অসম্ভব। মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির মাধ্যমে প্রণয়নকৃত এসএইচএ-২৫৬ অ্যালগরিদমের মাধ্যমে বিটকয়েনের ডিজাইন করা হয়েছে, নিরাপত্তার দিক থেকে যা অনন্য। তবে বেশ কয়েকবার বিটকয়েন কমিউনিটিতে হ্যাকিংয়ের ঘটনা সামনে আসলেও পরবর্তীতে দেখা গিয়েছে- সেগুলো আসলে বিটকয়েন নেটওয়ার্ক নয়, বরং ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের ঘটনা ছিল। বিটকয়েন ব্যবহারের একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে- যেহেতু এর মাধ্যমে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই, তাই লেনদেনে একবার কোনোভাবে ভুল হয়ে গেলে সেটি সংশোধনের কোনো উপায় নেই। ধরুন, আপনি যদি কখনও ভুল ব্যক্তির সাথে বিটকয়েনের মাধ্যমে লেনদেন করে থাকেন, তাহলে সেই ভুল শোধরানোর কোনো উপায় নেই আপনার কাছে। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশে ইতোমধ্যে বিটকয়েনের ব্যবহার বৈধতা পেয়ে গিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী উদ্যোক্তাদের একজন, মার্কিন ধনকুবের এলন মাস্কের টেসলা কোম্পানি তাদের প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে বিটকয়েন ব্যবহার করছে।
সাতোশি নাকামোতোর প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসা যাক। ২০০৮ সালে যখন পুরো পৃথিবীতে অর্থনৈতিক মন্দা আঘাত হানছে, তখন ইন্টারনেটের প্রোগ্রামিং কমিউনিটিতে পিডিএফ আকারে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন ‘সাতোশি নাকামোতাে’ ছদ্মনামের এক ব্যক্তি। সেই শ্বেতপত্রের শিরোনাম ছিল “বিটকয়েন: এ পিয়ার-টু-পিয়ার ইলেকট্রনিক ক্যাশ সিস্টেম” (Bitcoin: A Peer-to-Peer Electronic Cash System)। সেই শ্বেতপত্রে বিটকয়েনের প্রকৃতি বা চরিত্র কেমন হবে, তা চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। তিনি দাবি করেছিলেন, গতানুগতিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর ভরসা রেখে যে নগদ অর্থের লেনদেন হয়, তাকে প্রতিস্থাপিত করতে বিটকয়েন হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এখানে লেনদেনের দুই পক্ষকে তৃতীয় কোনো পক্ষ (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) নিয়ে ভাবতে হবে না। এছাড়া এই ব্যবস্থায় যেহেতু ডিজিটাল মুদ্রাগুলো সাংকেতিক ভাষার মাধ্যমে তৈরি করা হবে, তাই নিরাপত্তা নিয়ে ব্যবহারকারীদের কোনো বাড়তি চিন্তার প্রয়োজন পড়বে না। এই পদ্ধতিতে লেনদেনের স্বচ্ছতা আনার জন্য বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠাতারা প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড যেসব সার্ভারে থাকে, সেসব সার্ভার একেবারে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালের শুরুর দিকে ইতিহাসের প্রথম বিটকয়েন ব্লক, যাকে ‘জেনেসিস ব্লক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সেটি ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করা হয়।
শ্বেতপত্রে যে ব্যক্তির নাম ছিল, অর্থাৎ সাতোশি নাকামোতো, তিনি কি একজন ব্যক্তি নাকি একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে তৈরি একটি গ্রুপ তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে এটা সবাই ধরে নিয়েছিল যে, ‘সাতোশি নাকামোতো’ একটি ছদ্মনাম, খোঁজ করলে এই নামে কাউকে পাওয়া যাবে না। ২০০৯ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে পরবর্তী দুই বছর বিভিন্ন অনলাইন ব্লগে সাতোশি নাকামোতো সক্রিয় ছিলেন, এবং বিটকয়েনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে এসে তিনি বিটকয়েন কমিউনিটিতে ঘোষণা দেন, এখান থেকে সরে গিয়ে তিনি অন্য কোনো ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করবেন। তার প্রস্থানের পরও বিটকয়েনের গ্রহণযোগ্যতা কমেনি, বরং সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে বর্তমানে যত বিটকয়েন রয়েছে, তার পাঁচ শতাংশের মালিকানা এখনও সাতোশি নাকামোতোর হাতে, যার অর্থমূল্য প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার!
বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু ব্যক্তি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের ‘সাতোশি নাকামোতো’ ছদ্মনামের পেছনে কলকাঠি নাড়তে থাকা ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তাদের দাবিগুলো পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে ধোপে টেকেনি। গণমাধ্যমগুলো প্রায় সময়ই সাতোশি নাকামোতোকে নিয়ে জনগণের বিপুল আগ্রহের ফায়দা তোলার জন্য বেশ কিছু ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে, তবে সব চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
বিখ্যাত গণমাধ্যম নিউজউইক জাপানি-বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক দোরিয়ান নাকামোতোকে বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবি করেছিল। পরবর্তীতে তিনি সেই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। ‘হ্যাল ফিনলে’ নামের এক প্রোগ্রামার ও বিটকয়েনের প্রথমদিকের একজন ব্যবহারকারীকে ‘সাতোশি নাকামোতো’ হিসেবে দাবি করা হয়েছিল। দোরিয়ানের মতো তিনিও এই দাবিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। কম্পিউটার বিজ্ঞানী নিক জ্যাবোকেও একসময় দাবি করা হয়েছিল সাতােশি নাকামোতো হিসেবে, কিন্তু তিনিও দিনশেষে বাকিদের মতো সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে একজন ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ক্রেইগ রাইট নামের এক অস্ট্রেলিয়ান উদ্যোক্তা নিজেকে সাতোশি নাকামোতো হিসেবে দাবি তো করেছেনই, এর পাশাপাশি মার্কিন কপিরাইট অফিসে রীতিমতো ২০০৮ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত শ্বেতপত্র নিয়েও হাজির হন কপিরাইট নিজের নামে করে নেয়ার জন্য। তবে তিনি সত্যিকারের সাতোশি নাকামোতো কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে বিটকয়েন কমিউনিটিতে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সাতোশি নাকামোতো নামের পেছনে যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন, তারা কেন নিজেদের আড়ালে রেখে চলেছেন বছরের পর বছর ধরে? এর একটা সম্ভাব্য উত্তর হাতের কাছেই রয়েছে। সাধারণত যেসব ব্যক্তি এমন কোনো মুদ্রা তৈরির প্রয়াস চালিয়েছেন, যেটি মার্কিন ডলারের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বরাবরই আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একেই সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। ইতোমধ্যেই এর আঁচ পাওয়া গিয়েছে। মার্কিন অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ‘ফেডারেল আইনের বিরোধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে চার হাজার দিন। এর মধ্যে অসংখ্য পরিবর্তন এসেছে, বিটকয়েন একেবারে অপরিচিত একটি বিষয় থেকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, এমনকি এটা নিয়ে ইন্টারনেট জগতে তো বটেই, মার্কিন আদালতেও বেশ তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামের পেছনে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সন্ধান না পাওয়াটা একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট জগতের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর একটি হয়েই থাকবে।