জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য এবং জার্মানির সাথে করা ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফাভাবে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণার পর থেকেই ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ইরানের উপর স্মরণকালের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অবরোধও আরোপ করেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশটি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের করা অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ এবং ইরানও বরাবরের মতোই সকল অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু তাতে অবরোধের পরিসরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পরমাণু চুক্তিটি রক্ষার্থে কাজ করে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে অন্য পাঁচ দেশ। সে লক্ষ্যে নিষেধাজ্ঞার পরেও এখন পর্যন্ত ইরানের সাথে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া ও চীন।
এরই মধ্যে অবরোধের প্রভাব টের পেতে শুরু করেছে ইরানের অর্থনীতি। দ্রুত কমছে ইরানিয়ান রিয়ালের দাম; তেলের ব্যবসায়ও নেমেছে ধ্বস। একদিকে চাকরির সুযোগ কমে আসছে, অপরদিকে বেড়ে চলেছে জীবনযাত্রার ব্যয়। নিজের অর্থনীতি বাঁচাতে ইরানও একে একে বিভিন্ন পদক্ষেপ ঘোষণা করছে। কিন্তু অর্থনীতি রক্ষার ইরানী নীতি নতুন করে অভিবাসী সংকট সৃষ্টি করবে না তো?
সারা বিশ্বেই বর্তমানে অভিবাসী সমস্যা সভ্যতার এক নতুন সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অভিবাসীদের আশ্রয় দিয়ে, আবার কেউ সীমান্ত বন্ধ করে হচ্ছে আলোচিত-সমালোচিত। কিন্তু ইউরোপ নিয়ে আলোচনার ভিড়ে অনেকে হয়তো ভুলেই গেছেন ইরান আশ্রিত কয়েক মিলিয়ন আফগান অভিবাসীর কথা!
মূলত আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় থেকেই লাখ লাখ আফগান পার্শ্ববর্তী দেশ ইরানে আশ্রয় নিতে শুরু করে। তৎকালীন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ্ রুহুলুল্লাহ্ খামেনিও তাদেরকে ‘মুসলিম ভাই’ উল্লেখ করেন এবং ‘ধর্মীয় শরণার্থী’ হিসেবে গ্রহণ করে নেন। ইরান তখন আফগান শরণার্থীদের তথ্যচিত্র সংগ্রহের কাজ বৃদ্ধি করে এবং তাদেরকে সেই দেশে কাজ করারও অনুমতি প্রদান করে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের (UNHCR) মতে যা সংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি এবং নিরাপদ শহুরে শরণার্থী। ইরান নিজ নাগরিকদের ন্যায় সরকারি খরচে আফগান শরণার্থীদেরও স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। এমনকি ২০১৫ সালে তারা সকল শ্রেণী-পেশার আফগান শিশুদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার অনুমতি প্রদান করে, যা UNHCR এর ভাষায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু এসব কার্যক্রমের জন্য বৃহৎ অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের রাজনীতি বিষয়ক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এসব খরচ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। আরাঘচির মতে, ইরানের শ্রমবাজারে বর্তমানে ২০ লাখ আফগান অভিবাসী কাজ করছে। এই শ্রমিকরা প্রতি বছর তিন থেকে পাঁচ বিলিয়ন ইউরো (৩.৩৫-৫.৫৮ বিলিয়ন ডলার) বিদেশে অবস্থান করা তাদের পরিবারের নিকট প্রেরণ করছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ইরানে বিনিয়োগ করা হলে তাদের ভঙ্গুর অর্থনীতি শক্ত ভীত পেত বলেই মনে করেন ইরান সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
এছাড়া বর্তমানে প্রায় ৫ লক্ষ আফগান শিশু সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ইরানের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে যাদের প্রত্যেকের পেছনে বছরে ৬৭০ ডলার করে খরচ হচ্ছে দেশটির। এবং আরও ২৩ হাজার আফগান তরুণ ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে, যাদের প্রত্যেকের জন্য বার্ষিক ১৬,৭৪৩ ডলার করে খরচ গুনতে হচ্ছে কড়া অর্থনৈতিক অবরোধে থাকা দেশটিকে। নিজের অর্থনীতি বাঁচাতে হিমশিম খাওয়া ইরানের কাছে যা এখন বড্ড বিলাসিতাই বটে।
গত মাসের শুরুতে দেয়া ঐ সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস প্রশাসনের প্রভাবশালী এই মন্ত্রী উল্লেখ করেন, যেহেতু আমেরিকার অবরোধ তার দেশে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে আর ইরানেরও অর্থনৈতিক সম্পদও সীমিত, আবার তেলের রপ্তানিও শূন্যের কোটায় নেমে আসেছে, তাই বাধ্যতামূলকভাবেই ইরানের অর্থনীতিকে বাঁচাতে তাদের বিশেষ নীতি গ্রহণ করতে হবে। অর্থনীতির সুরক্ষায় তারা এই বৃহৎ সংখ্যক অভিবাসীর বোঝা আর বইতে পারবেন না এবং এসব অভিবাসীদের ইরান থেকে হয়তো বের করে দিতে হবে বলেও আশংকা করেন তিনি। এছাড়াও ইরানি জনগণের সুরক্ষা দেয়াকেই প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব মনে করে তার সরকার। যদিও পরে তিনি তার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ করেন। সেই সাথে আফগান অভিবাসীদের ইরান থেকে যদি করে বের করে দেয়া হয় তবে ইউরোপ যেন তাদের স্বাগত জানায়, ইউরোপীয় নেতাদের প্রতি এ আহবানও জানান। অন্যথায় এসব অভিবাসীর খরচ জোগাতে ইউরোপীয়ানদের অভিবাসী ইস্যুতে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তেহরানের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন।
অবশ্য আব্বাস আরাঘচির এ মন্তব্যের পর খোদ ইরানসহ বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ‘এন্টি-ইমিগ্রেন্ট’ বলে তার সমালোচনা করেছেন। তাদের দেশের সমস্যা আফগান অভিবাসীরা চলে গেলেই যে সমাধান হবে না তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন অনেক ইরানি। তারা মনে করেন, আফগান অভিবাসীরা উল্টো তাদের দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথেই এগিয়ে নিচ্ছেন। যুগ যুগ ধরে এসব অভিবাসীদের ব্যবহার করে এখন কলমের এক খোঁচায় তাদের জীবনে জাহান্নাম নামিয়ে আনার অধিকার ইরান সরকারের নেই বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
আবার অনেকে সম্ভাব্য এই সিদ্ধান্তকে অসহায় ইরানের নিরুপায় পদক্ষেপ বলেও মনে করছেন। তাদের মতে, ইরানের সাথে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে ইউরোপের প্রতি চাপ সৃষ্টির জন্য হলেও ইরানের এই নীতি গ্রহণ করা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে যেসব ইউরোপীয় দেশ ইরানের তেল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে বা এ সংক্রান্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা এতে নড়েচড়ে বসবে এবং ইরানের সাথে ব্যবসা বন্ধের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে মনে করেন তারা।
মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবেলায় ইরানকে অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে বলেই মনে করেন অনেক ইরানি। যেহেতু ইরানে থাকা অনেক অভিবাসী ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে, তাই কেউ কেউ আবার এই প্রবণতাকে ইরান কাজে লাগাতে পারে বলেও মত দিয়েছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে ফার্সি ভাষায় #OpentheBorders হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সরকারকে ইরানের পশ্চিম সীমান্ত খুলে দেওয়ার অহবানও জানান।
এমনিতেই ইউরোপ বর্তমানে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের অধিকমাত্রায় শরণার্থী-ঢেউয়ে প্লাবিত। ঠিক এই সময়ে ইরান যদি দেশটির তুরস্কের সাথে থাকা পশ্চিম সীমান্ত খুলে দেয় তবে অল্পদিনেই তুরস্ক হয়ে ইউরোপ অভিমুখে যে শরণার্থীর ঢল নামতে পারে তা ইউরোপীয় নেতাদেরও অজানা নয়। নিজ অর্থনীতিকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে ইরান এমন সিদ্ধান্ত নিলেও তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলেই মনে করেন অনেক আন্তর্জাতিক-সম্পর্ক বিশ্লেষক।
ইরানে অস্থিতিশীলতা যে ইউরোপের সমস্যার কারণ হতে পারে তা প্রমাণ করতে পারলে ইরানের ঘুরে দাঁড়ানো অনেক সহজ হবে এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যে নিজের শক্তি ধরে রাখতে এবং তেলের ব্যবসা ও অর্থনীতির পতন রোধেও কাজ করবে। বৃহৎ সংখ্যক মানুষের ভাগ্য নিয়ে এই খেলা ইরান খেলবে কি না সেটাই এখন প্রশ্ন!