ইশ, যদি কখনও পাখির মতো আকাশে উড়তে পারতাম, ঐ নীলাভ আকাশের শুভ্র মেঘে ভেসে বেড়াতে পারতাম; ঐ বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে কখনো কি এমনটা ভেবেছেন? হয়তো সকলে এই কথাটি একবার হলেও ভেবেছেন; তাহলে এই ইচ্ছা পূরণ কীভাবে সম্ভব? আপাতদৃষ্টিতে নিজে আকাশে মেঘের রাজ্যে বিচরণ অসম্ভব বলে মনে হলেও পৃথিবীতে এমনও স্থান আছে যেখান থেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও আকাশের শুভ্র মেঘের রাজ্যে চড়ে বেড়ানোর অনুভূতি প্রাপ্তি সম্ভব। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। বলছিলাম বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক আয়না ভূমি বলিভিয়ার সালার দি ইউনি সম্পর্কে।
বলিভিয়ায় অবস্থিত আলতিপ্লানো মালভূমির একটি অংশ সালার দি ইউনি নামে পরিচিত। সালার শব্দটি স্প্যানিশ, যার অর্থ লবণের সমতল। আর ইউনি আমরার ভাষা থেকে উদ্ভূত একটি শব্দ। এর অর্থ ঘের বা পরিবেষ্টন করা। তাহলে একত্রে এর অর্থ দাঁড়ায় আবদ্ধভাবে পরিবেষ্টিত লবণের সমতল।
সালার দি ইউনি অঞ্চলটি আলতিপ্লানো নামের যে মালভূমিতে অবস্থিত সেটি পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মালভূমি। এটি দক্ষিণ-পশ্চিম বলিভিয়ার ড্যানিয়েল ক্যাম্পোস প্রদেশের চিলি সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত। সালার দি ইউনি অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এটি ১০, ৫৮২ বর্গ কিলোমিটার বা ৪,০৮৬ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত একটি মালভূমি অঞ্চল। এই বিস্তৃত অঞ্চলে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি জমে সৃষ্টি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রকৃতিক আয়না।
প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী
সালার দি ইউনির লবণের সমতল সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে একটি পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। স্থানীয় আয়মারা সম্প্রদায় (আন্দিজের আদিবাসীরা) বিশ্বাস করে, পার্শ্ববর্তী আগ্নেয়গিরি তনূপা, কুসকু এবং কুসিনা অতীতে তিন দৈত্যাকৃতির মানুষ ছিল।
কুসকু তনূপাকে বিয়ে করেছিল, কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর কুসকু কুসিনাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এই খবর যখন তনূপার কানে গেল, তখন সে তার ছেলেকে দুধ পান করাচ্ছিল। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে তনূপার অজান্তেই তার চোখ থেকে জল ঝরতে লাগল। তার চোখের জল দুধের সাথে মিশ্রিত হয়ে সৃষ্টি হলো সালার। যার অর্থ লবণের সমতল। স্থানীয় আয়মারা সম্প্রদায়ের কাছে তনূপা গুরুত্বপূর্ণ দেবী হিসাবে বিবেচিত। তাই স্থানীয় লোকের নিকট সালার দি ইউনি ‘সালার দি তনূপা’ নামে অধিক পরিচিত।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
এই লবণ ভূমি সম্পর্কে লোকমুখে প্রচলিত তথ্য যা-ই থাকুক না কেন, এর সৃষ্টি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক মতবাদ ভিন্ন। অতীতে এই অঞ্চলটির অবস্থান ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে, তবে অন্দিজ পর্বতমালা সৃষ্টিকালে এই অঞ্চলের ভূমি সমুদ্রপৃষ্ট থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে উঠে যায়।
এরপর প্রায় ৩০,০০০-৪২,০০০ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে লেক মিনচি নামের একটি বিশালাকার হ্রদের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে হাজার হাজার বছর ধরে ধারাবাহিক পরিবর্তনের বা বিবর্তনের ফলে সেই ঐতিহাসিক লেকের পানি শুকিয়ে যায়। লেকের পানি শুকিয়ে গেলেও তলানিতে জমে থাকা লবণ ও লিথিয়ামসহ বহু খনিজ পদার্থ এখানে পড়ে থাকে।
সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক আয়না
ডিসেম্বরের থেকে মার্চ পর্যন্ত বর্ষাকালীন বৃষ্টি ও আশেপাশের হ্রদগুলো থেকে প্রবাহিত হওয়া জল, শুভ্র সালার দি ইউনিকে এক জলাশয়ে পরিণত করে। আর তখন মাইলের পর মাইল জুড়ে সৃষ্টি হাওয়া এই বিশাল প্রকৃতিক আয়নায় আমাদের ব্যবহৃত প্রচলিত দর্পণের ন্যায় চমৎকার সব প্রতিবিম্ব দৃশ্যমান হয়।
বর্ষাকালে সালারের স্বচ্ছ পানিতে ফুটে ওঠে প্রকৃতির সব রূপ, রঙ। বিশাল আকৃতির এই প্রাকৃতিক আয়না যেকোনো সময়ে দর্শনীয়, তবে আয়নার প্রভাবটি বিশেষত ভোর ও সন্ধ্যাবেলায় নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। কেউ চাইলে সরাসরি নেমে পড়তে পারেন এই অগভীর জলে। আপনি দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত রং-বেরঙের একটি অখণ্ড শীট ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না। প্রায় ২০ ইঞ্চি পরিমাণ জলের একটি পাতলা স্তর বলিভিয়ার সালার দি ইউনিকে চমৎকার প্রতিফলক ক্যানভাসে রূপান্তরিত করে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে আকাশ বুঝি মাটির সাথে এসে মিশে গেছে!
শুষ্ক মৌসুমে সালার থাকে ধবধবে সাদা। পানি শুকিয়ে এখনকার ভূমি যেন এক নিখুঁত টলুইন আকৃতির বিশাল লবণের মরুভূমিতে পরিণত হয়। বর্ষার সেই আয়না শুষ্ক মৌসুমে ফেটে ষড়ভুজ আকারের একেকটি লবণ খন্ডে শ্রেণীবদ্ধ হয়। এই মৌসুমে (মে-নভেম্বর) সালারের সমতল ভূমির ওপর দিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে করে চড়ে বেড়ানো যায়, যা বর্ষায় সম্ভব হয় না।
বলিভিয়ার এই লবণ ভূমি চারদিক থেকে ছোট ছোট পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। আর বিস্ময়কর এই প্রকৃতিক আয়নাভূমির মাঝে বেশ কিছু ছোট আকৃতির দ্বীপ রয়েছে। কেউ চাইলেই এসব দ্বীপের উপর থেকে মন ভরে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। আর এজন্য এই ছোট আকারের দ্বীপগুলোতে রয়েছে সুব্যবস্থা।
দ্বীপগুলোতে রয়েছে শত শত বছরের পুরনো ক্যাকটাস, যেগুলো দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩৩ ফুট লম্বা। এগুলোর মাঝে মাঝে দেখা যায় হাজার বছরের পুরনো প্রবালের জীবাশ্ম, যেগুলো বার বার স্মরণ করিয়ে দেয় সালার দি ইউনি একসময় একটি বিশাল হ্রদ ছিল।
সালার দি ইউনি সল্ট ফ্ল্যাটের চারদিক ঘিরে ছোট-বড় মিলিয়ে বেশ কিছু হ্রদ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে লেগুনা কলোরাডা (Laguna Colorada) এবং লেগুনা ভার্দে (Laguna Verde) নামের হ্রদ দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
লেগুনা কলোরাডা একটি অগভীর জলাশয়। লেকটিতে জলের গভীরতা মাত্র এক মিটার। লেকটির জল গাঢ় নীল এবং রক্তবর্ণ লাল দুই রঙে বিভক্ত। তবে স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই হ্রদের লাল রঙ তাদের দেবতার রক্ত। প্রকৃতপক্ষে হ্রদের পানিতে থাকা লাল পলল এবং শেওলার কারণে জলাশয়ের পানি এমন আজব বর্ণ ধারণ করেছে। লেকটি গোলাপি ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির প্রজননের জন্য অন্যতম আদর্শ স্থান।
সালার দি ইউনির জীববৈচিত্র্য অসাধারণ এবং মনোমুগ্ধকর। এই লবণ ফ্ল্যাটগুলো প্রায় ৮০ প্রজাতির পাখির আবাসস্থল। এছাড়াও এটি কাল্পেও, বলিভিয়ান ভিজকাচা, আন্দীয় হাঁস, আন্দীয় হিলস্টার, ভিকুয়াসসহ আরো বহু বিচিত্র প্রাণীর আবাসস্থল।
লেগুনা ভার্দে (Laguna Verde) অর্থ সবুজ লেক। লোকটির পান্নার ন্যায় নিখুঁত সবুজ বর্ণের জলের কারণে লোকটির এমন হয়েছে। এর জলে থাকা খনিজ পদার্থ যেমন, আর্সেনিক, ম্যাগনেসিয়াম, কার্বোনেট এবং ক্যালসিয়াম হ্রদটিকে এমন অপূর্ব সুন্দর রূপ দিয়েছে। হ্রদটির তলদেশের পললগুলো বাতাসের দ্বারা কতটুকু প্রভাবিত হয় তার উপর নির্ভর করে হ্রদের রঙ ফিরোজা থেকে শুরু করে পান্নার ন্যায় নিখুঁত সবুজ বর্ণের হয়। এই হ্রদটিতে লেগুনা কলোরাডার ন্যায় ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি দেখা যায় না। কারণ এর জল আর্সেনিক দিয়ে ভরা।
লেগুনা ভার্দে হ্রদটির ঠিক পাশে লেগুনা ব্লাঙ্কা (Laguna Blanca) নামের আরেকটি হ্রদ রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ৫.৬ কিলোমিটার এবং এটি ৪,৩৫০ মিটার গভীর। হ্রদটির পানিতে বিপুল পরিমাণে খনিজ পদার্থ মিশ্রিত রয়েছে।
কখন যাবেন সালার দি ইউনিতে
সালার ডি ইউনিতে ভ্রমণের জন্য দুটি ভিন্ন মৌসুম রয়েছে। এর একটি বর্ষা মৌসুম (ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল)। সেসময় দেশ-বিদেশ থেকে ভ্রমণপিপাসু মানুষ এখানে তৈরি হাওয়া প্রাকৃতিক আয়না দেখতে ছুটে আসেন।
অপরটি শুষ্ক মৌসুম (মে থেকে নভেম্বর)। তখন এই স্থানের তাপমাত্রা শীতল থাকে এবং স্থল শক্ত হয়ে যায়। ভ্রমণকারীরা এক শুভ্র অপার্থিব প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের মনোবাসনা নিয়ে এখানে আসেন। তবে ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে পর্যটকদের পদচারণা খুব কমই দেখা যায়। কারণ তখন সালারের অংশগুলো দুর্গম হয়ে ওঠে। আর তাই কর্তৃপক্ষ এসময় এখানে প্রবেশের সকল মাধ্যম প্রায়ই বন্ধ করে দেয়। এখনকার ট্যুর অপারেটররা জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়কে তাদের পর্যটন মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করেন।
পর্যটন মৌসুমে যে কেউ চাইলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি ঘুরে দেখতে পারে। সেক্ষেত্রে নিকটবর্তী শহর থেকে পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত গাড়ি ভাড়া নিয়ে এখানে আসতে হয়। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় দুই শতাধিক গাড়ি ভর্তি পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয় সালার দি ইউনি।
বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকদের জন্য এখানে রয়েছে আবাসিক সুব্যবস্থা। সেই নিমিত্তে এখানে গড়ে উঠেছে বহু হোটেল। এই হোটেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আবাসিক হোটেল প্যিলিসিও দি সাল। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় লবণের প্রাসাদ।
শুধু নামেই সীমাবদ্ধ নয়, ২০০৭ সালে নির্মিত ভিন্নধর্মী এই হোটেলটি আক্ষরিক অর্থেই একটি লবণের প্রাসাদ। কারণ হোটেলটির মেঝে থেকে শুরু করে প্রাচীর পর্যন্ত সব কিছুতে রয়েছে লবণের সৃজনশীল ব্যবহার। ভবনটি নির্মাণ করতে প্রচলিত কংক্রিটের ইটের পরিবর্তে ১৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের প্রায় ১,০০,০০০ লবণের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি এর সকল আসবাবপত্র, যেমন- খাট থেকে শুরু করে টেবিল পর্যন্ত সবই লবণের খণ্ড দিয়ে নির্মিত।
এই আয়নাভূমি শুধুমাত্র ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের লীলাভূমি নয়, বরং অক্ষরিক অর্থেই একটি উন্মুক্ত প্রাকৃতিক সম্পদের খনি। এখানকার স্থানীয় আইমারা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা লবণ সংগ্রহ ও বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ পর্যটন কেন্দ্র সালার দি ইউনির অর্থনৈতিক গুরুত্বও ব্যাপক। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, এই লবণ ভূমিতে প্রায় ১১ কোটি টন লবণের উপস্থিতি রয়েছে। প্রতি বছর এখান থেকে উত্তোলন করা হয় প্রায় ২৫,০০০ টন লবণ।
লবণের পাশাপাশি এখানে মজুদ রয়েছে বিপুল পরিমাণে ধাতু। মহাকাশ থেকে তোলা সালার দি ইউনির স্যাটেলাইট চিত্রে যে অতি জ্যামিতিক চিত্র দেখা যায়, তা মূলত লিথিয়ামের পুকুর। এক হিসেব মতে, সালার দি ইউনির ভূমিতে প্রায় ৯০ লক্ষ টন লিথিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে, যা পরিমাণের বিবেচনায় পৃথিবীতে থাকা মোট লিথিয়ামের প্রায় অর্ধেক। ২০১৯ সালের এক গণনানুযায়ী, বলিভিয়া প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মোট লিথিয়ামের প্রায় ৫০%-৭০% সরবরাহ করে।
মরচে পড়া রেলগাড়ির সমাধি, চোখ ঝলকানো লবণের হ্রদ, লবণের তৈরি হোটেল ও ফুটন্ত কাদার পুল, প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির পাখি ইত্যাদি কারণে সালার দি ইউনি ভ্রমণপিপাসুদের নিকট অন্যতম জনপ্রিয় এক গন্তব্যস্থল।