‘মাদার তেরেসা’ নামটি এখন বিশ্ববাসীর কাছে মায়া-মমতা, উদারতা এবং আত্মত্যাগের প্রতিশব্দ। মাদার তেরেসার কৃতিত্ব এবং ত্যাগ কখনোই ভোলার মতো নয়৷ আর এই লোভ-লালসা এবং স্বার্থপরতার যুগে যেখানে কেউ নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু ভাবারই সুযোগ পায় না, সেখানে অন্যের জীবনকে সুন্দর করার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মতো মানুষ তো বিরল। তাই তো যুগের পর যুগ চলে যায়, কিন্তু মাদার তেরেসার মতো স্বচ্ছ মনের মানুষের দেখা মেলা ভার হয়ে ওঠে।
কিন্তু, কিছু মানুষ এখনও মনুষ্যত্বের অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে দেননি। আর এমন একজন হলেন নেপালের অনুরাধা কৈরালা। হাজার হাজার নারী এবং শিশুর অন্ধকার জীবনকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন দিন-রাত। তার এই উদ্যোগ যেন দুর্দমনীয়। কোনোপ্রকার সহায়তা ছাড়াই কাজ শুরু করে আজ হাজারো মানুষের একমাত্র অভিভাবক এই অনুরাধা। নিজের কাজের জন্য তিনি ‘নেপালের মাদার তেরেসা’ নামে পরিচিত।
ছোট একটি উদ্যোগ হতে ‘মাইতি নেপাল’- এর যাত্রা
আজ থেকে প্রায় ২৬ বছরেরও আগে তথা নব্বইয়ের দশকে অনুরাধা কৈরালা নারী ও শিশু পাচার বন্ধ করতে এবং তাদেরকে যৌন নির্যাতন থেকে বাঁচানোর জন্য কিছু করার প্রয়োজন অনুভব করেন। এর পাশাপাশি যেসকল নারী নিজ পরিবারে অত্যাচারের স্বীকার হন, তাদের জন্যও কিছু করবেন বলে ঠিক করেন। সেই সময়ে তিনি কাঠমান্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরে প্রতি সকালেই যেতেন। যাওয়ার পথে ভিক্ষারত নারীদেরকে দেখে তার তাদের জীবন সম্পর্কে জানার ইচ্ছা জাগে। তিনি তাদের সাথে কথাবার্তা শুরু করেন। কথা বলে তিনি জানতে পারেন, প্রায় সকলেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
তাদের এসব কষ্ট এবং ভোগান্তি অনুরাধা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলেন। কারণ, জীবনের একটা সময় তিনিও শিকার হন অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের। অনুরাধার স্বামী প্রায়ই তাকে মারধোর করতেন। আর এর ফলে অনুরাধার তিন তিনবার গর্ভপাতও ঘটে। তবে এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, কার কাছে যাওয়া উচিত, কিছুই তার জানা ছিলো না। তাই অনেকদিনই মুখ বুজে সব সহ্য করে নেন। কিন্তু তৃতীয়বার গর্ভপাত ঘটলে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। নির্যাতনের শিকার অনুরাধা তার মতো নির্যাতিতদের কথা শুনে বুঝতে পারলেন যে সঠিক জ্ঞান, সহায়তা এবং ব্যবস্থার অভাবে তারাও দুর্বিষহ জীবন পার করছেন।
শুরু হয় তার নির্যাতিত নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার সফর। যেসকল ভিক্ষুকদের সাথে তিনি কথা বলতেন, তাদেরকে তিনি আর্থিক সহায়তার কথা দেন, যদি তারা ভিক্ষা ছেড়ে দেন। এ প্রস্তাবে মাত্র আটজন নারী সাড়া দেন। তাদের প্রত্যেককে তিনি ১০০০ রুপি করে দেন, যেন তারা রাস্তায় ছোট ছোট দোকান চালিয়ে নিজের ভরণ-পোষণ করতে পারেন। তারা প্রতিদিন যা লাভ করত, তা থেকে দুই রুপি করে সংগ্রহ করতেন অনুরাধা। সংগৃহীত সকল অর্থই অন্য সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য খরচ করা হতো। অনুরাধার নিজের আয় ছিলো কম। তবে তার চেষ্টায় এবং ইচ্ছায় কোনো ত্রুটি ছিলো না। সাধ্যের মধ্যে যতটুক আর্থিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়, তিনি তার পুরোটাই দেন।
পরবর্তী সময়ে তার এই উদ্যোগকে আরো দৃঢ় রূপ দেওয়ার জন্য আরো পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ‘মাইতি নেপাল’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন অনুরাধা, যা গত ২৬ বছর ধরে নির্যাতিত নারী এবং শিশুদের সহায়তা করে যাচ্ছে। ‘মাইতি’ হলো একটি নেপালি শব্দ, যার অর্থ মায়ের বাড়ি। যারা নিজের বাড়িতেই অত্যাচার এবং নির্যাতনের কারণে স্বস্তি পায়নি, তাদের নতুন বাসস্থান হয় এই মাইতি নেপাল। প্রাথমিকভাবে কোনোরকম একটি বাড়ির ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ছিল। অনেক নারীই দিনের পর দিন নির্যাতনের শিকার হয়েও বাড়ি ছাড়ত না, কারণ তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিলো না।
আর রাস্তায় বসবাসরত নারী এবং শিশুদেরও এই অভাবের কারণেই ভোগান্তি পোহাতে হতো। খুব স্বল্প পরিসরে গড়ে ওঠা সংস্থাটির বর্তমানে তিনটি নিবারণ কেন্দ্র, ১১টি পরিবহন কেন্দ্র, দু’টি ধর্মশালা এবং একটি স্কুল রয়েছে। যেসকল নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হয় এবং যারা এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত বা এইডস রোগে আক্রান্ত, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সংস্থাটি। আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, নির্যাতিতদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য সহায়তা প্রদান- যা অনেকেই গুরুত্ব দেয় না। মাইতি নেপাল এই মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্যও কাজ করে। অনুরাধা কৈরালা তার সংস্থার সহায়তায় নারী ও শিশু পাচার বন্ধ করার তাগিদে নেপালের বর্ডারে কয়েকটি পরিত্রাণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। এরকম ২৬টি কেন্দ্র ভারত এবং নেপালের বর্ডারে রয়েছে।
উদ্যোগটি অত্যন্ত কার্যকরী হয়ে দাঁড়ায়। এখন পর্যন্ত সংস্থাটি ১৮,০০০-এরও বেশি নারীকে পাচারের হাত থেকে রক্ষা করে। ২০১২ সালের দ্য গ্লোবাল পিস লিডারশিপ কনফারেন্সে তিনি এই তথ্য দেন। অর্থাৎ, নিঃসন্দেহে এই সংখ্যা বর্তমানে আরো বেশি। অনুরাধার সংস্থাটি যৌনপল্লী থেকেও অনেক নারীকে উদ্ধার করেন। তাছাড়া, প্রায় ১,০০০ শিশুর থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে মাইতি নেপাল।
অনুপ্রেরণা
১৯৪৯ সালের ১৪ এপ্রিল অনুরাধা কৈরালা জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের কাছ থেকে সবসময়ই কম ভাগ্যবানদের তথা সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্য-সহযোগিতা করার শিক্ষা পান। তাই ছোটবেলা থেকেই সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের সদিচ্ছা তার মধ্যে দেখা যায়। তিনি ভারতের কালিম্পং জেলার একটি হিল স্টেশনে পড়াশোনা করেন। সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুলের মাদার এবং সিস্টারস তার মধ্যে সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করার স্পৃহা আরো বাড়িয়ে দেয়।
এখানে থাকাকালীন তিনি মাদার তেরেসাকে নিজের আদর্শ হিসেবে বেছে নেন। কাঠমাণ্ডুর বিভিন্ন স্কুলে ২০ বছর শিক্ষকতা করে মানসিক স্বস্তি পাওয়া সত্ত্বেও অনুরাধা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার লক্ষ্য ছিলো আরো বড়। ১৯৯৩ সালে নারী-শিশু পাচার বন্ধ করার যাত্রা এবং মাইতি নেপাল প্রতিষ্ঠার কাজে লেগে পড়েন তিনি। এই দু’টি পদক্ষেপ ছিল তার লক্ষ্য পূরণের পথে গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা।
প্রাপ্তির ঝুলি
অনুরাধা কৈরালা তার কাজের জন্য এখন পর্যন্ত ৩৮টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- পদ্মশ্রী, যা কিনা ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ২০১০ সালে অনুরাধাকে ‘সিএনএন হিরো অব দ্য ইয়ার’ নামে অভিহিত করা হয়।
তিনি যেন নিজের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, তাই তাকে ১,২৫,০০০ মার্কিন ডলারও দেওয়া হয়। তাছাড়া প্রবাল গোর্খা দক্ষিণ বহু পদক ১৯৯৯, ত্রিশক্তিপত্ত অ্যাওয়ার্ড ২০০২, বেস্ট সোশ্যাল ওয়ার্কার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড- নেপাল ১৯৯৮, জার্মান ইউনিফেম প্রাইজ ২০০৭, কুইন সোফিয়া সিলভার মেডেল অ্যাওয়ার্ড ২০০৭, দ্য পিস আবে এবং কারেজ অভ কনশাস ২০০৬ তার উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি। অনুরাধার অবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামের জন্য নেপাল সরকার সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখকে ‘পাচারবিরোধী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। অনুরাধাকে তার কৃতিত্বের জন্য একসময় নারী-শিশু এবং সামাজিক কল্যাণ বিভাগের সহযোগী প্রাদেশিক মন্ত্রী হিসেবেও নিয়োজিত করা হয়েছিল।
তিনি কৈরালা যেভাবে নিপীড়িত নারী এবং শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। হাজারো অনাথ শিশুর জন্য তিনিই মা এবং বাবা দু’জনেরই দায়িত্ব পালন করছেন। আর নির্যাতিত নারীদের নতুন করে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন এই মহীয়সী নারী। অনুরাধা যে তার উপাধি যথাযথভাবে ধরে রাখছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।