ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের এলিট ফোর্স হলো কুদস ফোর্স। সেই কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন কাসেম সোলাইমানি, যাকে গত ৩ জানুয়ারি বাগদাদ বিমানবন্দরে ড্রোন হামলার মাধ্যমে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো এই সোলাইমানিকে। যে কারণে তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আরেকটি উপসাগরীয় যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সাথে ইরানের ছায়াযুদ্ধ চলছে। কিন্তু সোলাইমানিকে হত্যা করার পর থেকে বলা যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এরপর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন সমরবিদ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সমর শক্তির তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ তুলে ধরছেন।
বাস্তবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সামরিক শক্তির কাছে ইরান একেবারেই নস্যি। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের এক নম্বর সামরিক শক্তির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ইরান ও ইসরায়েলের অবস্থান যথাক্রমে ১৪তম ও ১৭তম। সামরিক শক্তিতে পিছিয়ে থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের বুক ফুলিয়ে লড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু ভূরাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ড রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ট্রাম্প কার্ড হলো হরমুজ প্রণালি, যা বিশ্বের তেল বাণিজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ।
ইরান প্রায়ই হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিয়ে থাকে। যদিও কখনো তারা সেটা করেনি। তবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হলে ইরান এই প্রণালি বন্ধ করেও দিতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো যদি কখনো ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয় তাহলে বিশ্বে কী প্রভাব পড়বে? আরেকটি প্রশ্ন হলো- ইরান কি আদৌ এই প্রণালি বন্ধ করে রাখতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তরসহ হরমুজ প্রণালি সম্পর্কিত আরো বেশ কিছু তথ্য সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
অবস্থান
ওমান উপসাগর ও পারস্য উপসাগরের মধ্য দিয়ে আরব সাগরে গিয়ে মিশেছে হরমুজ প্রণালি। এই প্রণালির উত্তর উপকূলে রয়েছে ইরান এবং দক্ষিণ উপকূলে রয়েছে আরব আমিরাত ও মুসানদাম নামে ওমানের একটি ছিটমহল। এই প্রণালি ১৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। এবং সর্বোচ্চ ৯৬ কিলোমিটার এবং সর্বনিম্ন ৩৩ কিলোমিটার প্রশস্ত। সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক ও সাধারণ নৌযানগুলোকে হরমুজ প্রণালি হয়েই আরব সাগরে প্রবেশ করতে হয়। এছাড়া ভিন্ন আর কোনো পথ নেই।
বাণিজ্যিক গুরুত্ব
হরমুজ প্রণালি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম সমুদ্র পথ। এই প্রণালি হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিদিন প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল সরবরাহ করে থাকে আরব দেশগুলো। যার ৭৬ ভাগেরই গন্তব্য চীন, জাপান ও ভারতসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে। অর্থের হিসাবে প্রতিদিন হরমুজ প্রণালি দিয়ে ১.১৯৭ বিলিয়ন ডলারের তেল রপ্তানি করে ওপেক ভুক্ত আরব দেশগুলো। এর মধ্যে ইরানের রপ্তানিকৃত তেলও রয়েছে। প্রতি বছর বিশ্বের মোট তেল চাহিদার ২০ শতাংশই হরমুজ প্রণালি দিয়ে যায়। পাশাপাশি এক-তৃতীয়াংশ তরল প্রাকৃতিক গ্যাসও রপ্তানি হয় এই পথে।
হরমুজ প্রণালি হয়ে সিংহভাগ তেল এশিয়ার দেশগুলোতে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর জন্যও এই সমুদ্রপথ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে ৩০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রপ্তানি হয়ে থাকে, যার মূল্য প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলার, এবং দেশটির মাসিক আমদানিকৃত তেলে ১০ শতাংশ। ফলে ভৌগোলিকভাবে হরমুজ প্রণালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এশিয়ার দেশ চীন, জাপান ও ভারতের জন্য।
রাজনৈতিক গুরুত্ব
ইরানের সিরিকের কাছে হরমুজ প্রণালির প্রশস্ততা ৩৩ কিলোমিটার, যা পুরো প্রণালির মধ্যে সর্বনিম্ন। কিন্তু ৩৩ কিলোমিটার প্রশস্ত হলেও এই স্থানটির মাত্র ৩ কিলোমিটারের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারে। এবং এই স্থানটিতে ইরানের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বলা যায়, ভূরাজনৈতিকভাবে ইরানের জন্য এই তিন কিলোমিটার সমুদ্র পথ প্রাণ স্বরূপ। ইরান যদি কোনোভাবে কয়েক সপ্তাহের জন্য এই স্থানটি বন্ধ করে দেয় তাহলে বিশ্ব বাজারের তেলের দাম বেড়ে যাবে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও ভারতের মতো দেশগুলো। একইসাথে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে মধ্যপ্রাচ্যের তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের যে বর্তমান প্রভাব তার জন্য হরমুজ প্রণালির গুরুত্ব অপরিসীম। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল অথবা সৌদি জোট যদি কখনো ইরানে হামলা চালায় তাহলে তাদের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া। ইরান যদি কয়েক সপ্তাহের জন্য এই প্রণালি বন্ধ রাখে তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধ্বস নামবে। তখন নিজেদের প্রয়োজনে ইরানের পাশে দাঁড়াবে চীন। কেননা মধ্যপ্রাচ্যের তেল ছাড়া এশিয়ার শিল্প কারখানার চাকা বন্ধ হয়ে যাবে।
মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-প্রধান ইরান বলা চলে প্রায় নিঃসঙ্গ। ইরাক ও সিরিয়ায় শিয়া সরকার থাকলেও তারা ইরানকে বড় ধরনের সহযোগিতা করতে পারছে না। বরং সেসব দেশে শিয়া সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য ইরানকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে হচ্ছে। যদিও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতির অবস্থা একেবারেই নাজুক।
বিপরীতে সুন্নি প্রধান সৌদি জোটের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং পেট্রো ডলারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেনা অস্ত্রের ভাণ্ডারও অনেক বড়। কিন্তু এরপরও এই অসম যুদ্ধে ইরান এখন পর্যন্ত সফলভাবে টিকে থাকার অন্যতম কারণ হলো হরমুজ প্রণালি, যার ফলে এখন পর্যন্ত ইরানে সরাসরি হামলা করার সাহস পায়নি সৌদি জোট।
যদিও ইসরায়েল চায় তেহরানে তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র হামলা করুক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশও তা করার সাহস পাননি। কিংবা নিজ দেশের অর্থনীতির জন্য নিরাপদ মনে করেননি। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির মূলনীতি হলো তেলের দাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কতটুকু তেল উৎপাদন করছে সেটা তাদের মুখ্য বিষয় নয়। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো তেলের দাম যথাসম্ভব কম রাখা। আর তার জন্য প্রয়োজন হরমুজ প্রণালির স্বাভাবিক গতি। হরমুজ প্রণালির গতি যত মন্থর হবে তেলের দাম ততই লাগামহীন হবে।
ইরানের পক্ষে কী হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা সম্ভব?
ইরান প্রতিনিয়ত হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসলেও এখন পর্যন্ত তারা এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এর কারণ হলো এই প্রণালি দিয়ে ইরান নিজদের তেলও রপ্তানি করে থাকে। পাশাপাশি এই প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া মানে একাধিক দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। ফলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া ইরানের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে যদি তাদের নিজেদের তেল রপ্তানি নামতে নামতে তলানিতে চলে আসে তখন নিজেদের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে রক্ষা করার জন্য এই প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঝুঁকি নিতেই হবে। কিন্তু ইরান কি সত্যিকার অর্থে তা করতে পারবে?
হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে সবার প্রথমে সেখানে ইরানের নৌশক্তি বাড়াতে হবে। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে ইরানের নৌবাহিনীর সর্বমোট ৩৯৮টি নৌযান রয়েছে। এর মধ্যে ফ্রিগেট ৬টি, করভেট ৩টি, সাবমেরিন ৩৪টি, মাইন ওয়ারফেয়ার ৩টি এবং ৮৮টি সমুদ্রসীমা পাহারা দেওয়ার নৌযান। অধিকাংশ যুদ্ধজাহাজ ইরানের নৌবাহিনীর অধীনে রয়েছে। পাশাপাশি ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের আলাদা একটি বাহিনী রয়েছে৷ তাদের অধীনে কিছু মিসাইল হামলা চালানোর ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু যুদ্ধজাহাজ রয়েছে।
হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার জন্য ইরান তার এই নৌশক্তির সাহায্যে সেখানে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলো হামলা চালাতে পারে। কিন্তু তাদের জন্য সমস্যা হলো হরমুজ প্রণালিসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সমুদ্রসীমায় নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের পঞ্চম নৌবহর মোতায়েন করে রেখেছে। যার সদর দপ্তর বাহরাইনের রাজধানী মানামায়। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহরের সামনে ইরানের পুরো নৌশক্তিও কিছু নয়। ফলে ইরানের পক্ষে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা করে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
তবে ইরানে বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পর থেকেই নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির করার জন্য নিয়মিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অনিয়মিত ও আধা সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছে। তারা এসব বাহিনীর মাধ্যমে চোরাগুপ্তা ও সন্ত্রাসী হামলার পাশাপাশি সাইবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ ইরান জানে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রচলিত কোনো যুদ্ধে তাদের জয় পাওয়া অসম্ভব। তাই তারা ভিন্ন পথে হাঁটছে। হরমুজ প্রণালি বন্ধের ক্ষেত্রেও তারা নৌবাহিনীকে একইভাবে ব্যবহার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ইরান ছোট ছোট নৌযানে মেশিন গান ও ছোট আকারের ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ করতে পারে। এতে করে তেল সরবরাহে বেশ প্রভাব পড়বে। তবে এতে হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি বন্ধ হবে না।
ইরানের সামনে দ্বিতীয় যে উপায় আছে তা হলো হরমুজ প্রণালিতে নেভাল মাইন স্থাপন। ২০১৮ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ইরানের কাছে ২০০০ থেকে ৩০০০ নেভাল মাইন রয়েছে। যার মধ্যে কিছু মাইন উত্তর কোরিয়ায় তৈরি। যেগুলো রাশিয়ার ১৯০৮ অথবা ১৯২৬ এর ডিজাইন অনুযায়ী তৈরি। উভয় ডিজাইনের মাইনই মোরড মাইন অর্থাৎ এগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য সরাসরি জাহাজের সাহায্য প্রয়োজন হয়। এছাড়া এই মাইনগুলোর অর্ধেক আধুনিক জাহাজ শব্দ, চুম্বক কিংবা পানির চাপের সাহায্যে নির্ণয় করতে পারে। এছাড়া পুরনো মাইনগুলো সাবমেরিনের সাহায্যে স্থাপন করা যায় না। তবে যদি ইরানের কাছে নতুন প্রযুক্তির মাইন থাকে সেগুলো সাবমেরিনের সহায়তায় স্থাপন করা সম্ভব।
হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করার জন্য মাইন স্থাপন ইরানের জন্য কার্যকরী হতে পারে। তবে যদি তারা যুক্তরাষ্ট্রের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সফলভাবে সেগুলো স্থাপন করতে পারে তবেই সম্ভব। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইরানের মাইন স্থাপনের হুমকি সম্পর্কে ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল। এ কারণে ইরানকে মাইন স্থাপন করতে হবে একেবারে গোপনে এবং অতি দ্রুততার সাথে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর যদি বুঝতে পারে ইরান মাইন স্থাপন করছে তাহলে তারা সরাসরি ইরানের নৌযানগুলোতে হামলা করতে এক মুহূর্ত দেরি করবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেইটলিন টালম্যাজ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার বিষয়ে একটি রিপোর্ট লিখেছেন। তার মতে, ইরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে অতি দ্রুত মাইন বসাতে চায়, তাহলে তারা আনুমানিক সর্বোচ্চ ৭০০টি মাইন বসাতে পারবে। যা হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে যথেষ্ট। এই পরিমাণ মাইন অপসারণ করতে প্রায় এক মাস সময় লাগবে। এর আগে হরমুজ প্রণালিতে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক হবে না।
তৃতীয়ত, ইরানের কাছে অ্যান্টি-শিপ ক্রুজ মিসাইল (এএসসিএম) রয়েছে। যেগুলো যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ ও ভূমি থেকে নিক্ষেপ করা যায়। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার বেশ বড়। এবং বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র থাকায় তাদের কাছে মোট কতগুলো এএসসিএম আছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয় তাদের কাছে কয়েক শত এএসসিএম আছে। পাশাপাশি সেগুলো নিক্ষেপ করার জন্য কয়েক ডজন ব্যাটারি রয়েছে। এছাড়াও ইরানের কাছে আরো রয়েছে ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। এবং তাদের কাছে রাশিয়ান ক্রুজ মিসাইলও থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
তবে ইরানের নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বস করার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। পাশাপাশি ভৌগোলিকভাবেও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ক্ষেত্রে ইরানের কিছু সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এরপরও হরমুজ প্রণালির জাহাজগুলোকে হুমকি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। ইরানের নিক্ষেপ করা কোনো ক্ষেপণাস্ত্র যদি কোনো জাহাজে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয় অথবা যুক্তরাষ্ট্র যদি সেগুলো আটকে দেয় এরপরও সেখানে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে তাতে এক বা দুই সপ্তাহ করে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে। এতে করে ইরান প্রায়ই সেখানে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিতে পারবে।
কেইটলিন তালম্যাজের তথ্যমতে, ইরান যদি হরমুজ প্রণালিতে ৩৬টি ব্যাটারি মোতায়েন করে এবং তারা যদি প্রতিদিন একটি করে মিসাইল নিক্ষেপ করে, সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র যদি ৫০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম হয়, এরপরও ৭২দিন সেখানে জাহাজ চলাচলা পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার অপেক্ষায় বসে থাকবে না। হরমুজ প্রণালিতে যদি ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তাহলে তারাও নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করবে।
সর্বশেষ, হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ চলাচল বন্ধ করার জন্য তাদের যুদ্ধ বিমানগুলো মোতায়েন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও মাইন অপসারণের ক্ষমতার পাশাপাশি তাদের আকাশেও আধিপত্য রয়েছে। ইরানের বিমান বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় কোনো হুমকি নয়। তবে তাদের কাছে রাশিয়ার তৈরি দুরূহ এস-৩০০ অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট সিস্টেম রয়েছে। যদিও রাশিয়া এই এয়ার সিস্টেমের ব্যাপক পরিবর্তন করেছে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত জানা যায়নি ইরান তাদের আকাশকে সুরক্ষিত করার জন্য এস-৩০০ এর উন্নয়ন করেছে কি না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ এবং এফ-২২ যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে এস-৩০০ কিছুটা অকার্যকর। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীকে পরিকল্পনা গ্রহণে সমস্যা তৈরি করতে পারে। তবে তাদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করতে সক্ষম হবে না।
পরিশেষে ইরান যদি হরমুজ প্রণালিকে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এবং তারা যদি মাইন স্থাপন করে অথবা অ্যান্টি-শিপ ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করে তাহলে সেখানে এক থেকে দুই মাস জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে এরপরও সেখানে কোনো তেলের ট্যাংকার চলতে পারবে না তেমন না। তবে সিংহভাগ বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত তেল রপ্তানি করার জন্য পাইপ লাইন নির্মাণ করে লোহিত সাগরের উপকূলে নিতে পারে। সেখান থেকে তারা জাহাজে তেল রপ্তানি করতে পারে। যদি তা সম্ভব হয় তাহলে হরমুজ প্রণালির গুরুত্ব অনেকাংশে কমে যাবে।
আরেকটি বিষয় হলো ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সেটা হবে তাদের সর্বোপরি যুদ্ধ ঘোষণা। ইরান এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবে। কিন্তু যদি তাদের দেয়ালে পিঠ থেকে যায়, তাহলে হয়তো এছাড়া তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প পথ থাকবে না।