দৃশ্যপট-১
তার মাথায় ধবধবে সাদা চুল, চোখদুটো কোটরের ঠিক মাঝখানে মার্বেলের মতো জ্বলজ্বল করে, নাকটি ভীষণ সরু, পরনে লম্বামতন নীল রঙের আলখেল্লা, গলায় ঝোলানো আছে মানুষের মাথার খুলিতে তৈরি একটি মালা। লোকালয় তার ভালো লাগে না, তিনি বসবাস করেন গহিন জঙ্গলের মাঝে নির্জন এক কুটিরে। ভর পূর্ণিমায় মানুষের রক্তপান করলে তিনি বর লাভ করেন! তিনি একজন ভয়ানক ডাইনি।
দৃশ্যপট-২
এখন যার কথা বলবো, তিনি একটু অন্যরকম ডাইনি, কিছুটা আধুনিক বলতে পারেন! তিনি জঙ্গলে বাস করেন না, তবে মানুষের সংস্পর্শেও না। তিনি বসবাস করেন শহরের শেষ প্রান্তে একটি পুরনো বাড়িতে। ডাইনিবিদ্যার নানান দিক নিয়ে তিনি অল্পবিস্তর গবেষণা করেন, তৈরি করেন নানাবিধ পোশন, যেগুলো পান করে বিভিন্ন শক্তি লাভ করা যায়। তার রয়েছে জাদুর ঝাড়ু, যেগুলোতে চড়ে তিনি হাওয়ায় ভেসে বেড়ান, পৃথিবী ভ্রমণ করে আসেন মাথায় একটি কালো রঙের লম্বা টুপি পরে।
দৃশ্যপট-৩
দুজন কদাকার ডাইনির কথা বলা হলো তাই ভাববেন না ডাইনিরা কেবল কদাকার চেহারারই হয়। এবার আপনাদের নিয়ে যাবো একজন রূপবতী ডাইনির নিকট, যার কণ্ঠও শ্রুতিমধুর, যার হাসিও মনভোলানো! এই ডাইনির বসবাস ক্যারিবিয়ান সাগরের সেইন্ট মার্টিন দ্বীপে। ক্যারিনা স্মিথ নামক এই সুন্দরী মহিলাকে জাদুবিদ্যাচর্চা করার জন্য ডাইনি ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ক্যারিনা অবশ্য জাদুবিদ্যা চর্চা করেননি। এই নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানে অসামান্য জ্ঞান রাখতেন এবং নানাবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন, এই ছিল তার অপরাধ। তবে, ফাঁসিতে তাকে ঝোলানো যায়নি শেষতক।
দৃশ্যপট-৪
ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে নিজের চার সন্তানকে নিয়ে বাস করতেন মুন্ডা নাম্নী এক উপজাতি নারী। কোনো অজানা কারণে তাকে ডাইনি হিসেবে অভিহিত করা হলো। কে অভিহিত করলো সেটাও নিশ্চিত নয়। এরপর কোনো এক রাতে মুন্ডা যখন তার চার সন্তান নিয়ে ঘুমন্ত, তখন লাঠিসোঁটা আর কুড়াল নিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করলো একদল লোক, যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন একজন ‘ডাইনি ডাক্তার(!)’। কোনো শব্দ করার পূর্বেই ‘ডাইনি’ এবং তার চার সন্তানকে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তারপর তাদের লাশগুলো ফেলে দেয়া হলো বাড়ির পাশের এক কুয়ায়।
প্রথম তিনটি দৃশ্যপটই কাল্পনিক। পৃথিবীতে আদ্যবধি কোনো ডাইনির বাস্তব প্রমাণ মেলেনি। ডাইনিরা গল্প-উপন্যাসের বইয়ের পাতায়, কার্টুনে আর সিনেমাতেই দৃশ্যমান, বাস্তবে ডাইনি বলে কিছু নেই। প্রথম দৃশ্যটি ঠাকুর মার ঝুলির, দ্বিতীয়টি টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনের আর তৃতীয়টি ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’ সিরিজের ৫ম সিনেমার। বস্তুত, একবিংশ শতাব্দীতে এসে ডাইনি শব্দটি শোনামাত্র যে কেউ বই আর সিনেমার কথাই ভাববে। কারণ, বিজ্ঞানের উৎকর্ষের এ যুগে মানুষ কুসংস্কার থেকে মুক্ত। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারত যেন একটি প্যারাডক্স। কারণ, ৪র্থ দৃশ্যপটটি বাস্তব, যেটি এ বছর ২৫ জানুয়ারির ঘটনা!
‘উইচ হান্ট’ বা ডাইনি নিধনের ইতিহাস কিন্তু আজকের নয়। এটি চলে আসছে মধ্যযুগ থেকেই, কিংবা তারও আগে। মধ্যযুগে ইউরোপে ডাইনি নিধনের নামে যে বর্বরতা হয়েছে তা অবর্ণনীয়। ১৪ শতক থেকে বাড়তে থাকা এ ব্যাধি প্রশমিত হয় ১৮ শতকের শেষভাগে। আর ততদিনে ঝড়ে গেছে হাজারো প্রাণ। বিভিন্ন হিসাব মতে ডাইনি আখ্যা দিয়ে এ সময় ইউরোপে ৩৫ -৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে! কোনো কোনো হিসাবে তো তা ১ লক্ষ ছাড়ায়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন উগ্র দুর্বৃত্তদের আক্রোশের শিকার এ মানুষগুলোর সিংহভাগই নারী। রয়েছে পুরুষ আর শিশুও!
ধারণা করা হতো, অষ্টাদশ শতকেই বিশ্বে ডাইনি নিধনের বর্বরতা সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু, কুসংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানপ্রযুক্তির এ যুগে এসে দেখা যাচ্ছে সে ধারণা ভুল। আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশে এখনো ঘটে চলেছে ডাইনি নিধন। ২০০৯ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে উল্লেখ করা হয় যে কেবল গাম্বিয়াতেই প্রায় হাজারখানেক নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করে হয়েছে। সেখানকার ডাইনি ডাক্তাররা ছিল আবার সরকার কর্তৃক স্বীকৃত! দক্ষিণ এশিয়াতে ভারত আর নেপালে এই ঘৃণ্য অপরাধ ঘটছে নিয়মিতই। একই অপরাধ কিছুটা ভিন্ন রূপে ঘটছে সৌদি আরবেও, যেখানে শিকারকে জাদুবিদ্যা চর্চা করছে বলে অভিযুক্ত করা হয়।
তবে সর্বশেষ, কিছুদিন আগেই ভারতে ঘটে যাওয়া বর্বর ঘটনাটি সেখানকার দুরবস্থার চিত্র নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। পুলিশ এখনো পর্যন্ত ৬ জন অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে। এই অপরাধীদের বিচার হয়তো হবে, কিন্তু মোটাদাগে অপরাধীরা পার পেয়েই যায়, যার সাক্ষ্য দিচ্ছে পরিসংখ্যান। ২০০০ সালের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ২৫০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ডাইনি নিধনের নামে! ২০১৬-১৭ সালে কেবল উড়াষ্যাতেই ৯৯টি এবং রাজস্থানে ১২৭টি ডাইনি নিধনের অভিযোগ দাখিল হয়েছে পুলিশের খাতায়। স্পষ্টত আইনের শাসন কার্যকর থাকলে সংখ্যাটা এতো বড় হতে পারতো না। তবে সংখ্যাটা এর চেয়েও বড় হবার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা ভারতের অনেক রাজ্যেই ডাইনি নিধনের কোনো অভিযোগ পুলিশ গ্রহণ করে না, যেখানে ডাইনির অস্তিত্ব ব্যাপারটিকে কুসংস্কার বলে গণ্য করা হয়। আইন সেটিকে কুসংস্কার বললেও অপরাধ ঠিকই ঘটছে এবং সেগুলো পুলিশের কাছে আসলেও তালিকাভুক্ত হচ্ছে ভিন্ন কোনো নামে।
ডাইনি নিধনের বর্বরতার শিকার নারীদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, তাদের অধিকাংশই ছিলেন কিছুটা স্বাধীনচেতা স্বভাবের, প্রতিবাদী কিংবা ঝগড়াটে। বিশেষজ্ঞরা একে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের একটি দিক হিসেবেও দেখছেন। নারীকে সবসময় দুর্বল ভাবা এবং অবদমিত করে রাখার মানসিকতাই তাদের গলার স্বর উঁচু হতে দেয় না। ব্যতিক্রম হলে পুরুষের অহমে আঘাত করে যা ডাইনি নিধনের তথ্য উপাত্তে প্রমাণিত হয়। নির্যাতনের পর বেঁচে যাওয়া অনেক নারী বলেছেন যে তাদেরকে ডাইনি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় নানাবিধ কারণে। গ্রামে কোনো নবজাতকের মৃত্যু, মহামারীর আগমন, গৃহপালিত পশু মৃত্যু, এমনকি আবহাওয়া খারাপ হলেও অনেক সময় এই চিহ্নিত ‘ডাইনি’দের দোষী করা হয়। তবে ঘটনার গভীরে গেলে আরো ভয়ানক তথ্য মেলে। অনেক নারীকেই ডাইনি আখ্যা দেয়ার ভয় দেখিয়ে নিয়মিত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে গ্রামের প্রভাবশালী শ্রেণী। আবার অনেক নারীকে তার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্যই দেয়া হয় এরকম অমূলক পরিচিতি। ডাইনি হিসেবে হত্যা করা নারীদের বেশির ভাগই বিধবা, বয়োঃবৃদ্ধ কিংবা পরিবার ছেড়ে একাকী বাস করা নারী।
একবার ডাইনি তালিকায় নাম উঠে গেলে সে নারীর আর রক্ষা নেই। তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে হত্যা করা হয়। যারা বেঁচে যান, তাদেরও বাকী জীবন কাটাতে হয় হাত, পাসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ছাড়াই! এরকম ডাইনি নিধন প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই পরিচালিত হয় গ্রামের তথাকথিত ‘ডাইনি ডাক্তার’ কর্তৃক। পাড়া প্রতিবেশী তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে ভেবে সর্বদাই এরা দলবেঁধে আক্রমণ চালায়, ঘড়বাড়ি ভেঙে তছনছ করে, ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত নারীকে মৃত্যুর পূর্বে দেয় নানাবিধ শারীরিক যন্ত্রণা। কখনো চোখেমুখে মরিচের গুড়া ছিটিয়ে দেয়া হয়, কখনোবা মেরে আধমরা করে ফেলে রেখে ঘরসুদ্ধ জ্বালিয়ে দেয়া হয়!
ডাইনি নিধনযজ্ঞে অংশ নেয়াদের অপরাধের একটি ছোট্ট বর্ণনা দেয়া যাক। ২০১৪ সালে গুজরাটে তিনজন আদিবাসী নারীর উপর হামলে পড়েছিল একদল দুর্বৃত্ত। ঘটনার শুরু হয় সে গ্রামের দুজন যুবকের মৃত্যুতে। অভিযোগ আনা হয় যে ঐ তিন নারী ‘ডাইনি’ যুবকদ্বয়ের আত্মা খেয়ে ফেলেছেন! বিশ্বাস করা কষ্টকর যে এরকম গাঁজাখুরি অভিযোগও অধিকাংশের নিকট গ্রহণযোগ্য মনে হলো! ঐ তিন নারীকে গ্রামের কেন্দ্রে এনে সকলের সামনে বাঁধা হলো। সকলের মুখে তখন একটাই কথা, ‘ডাকান’, ‘ডাকান’(গুজরাটি শব্দ ডাকানের অর্থ ডাইনি)। এরপর ডাইনি ডাক্তার তাদের ডাইনি হবার প্রমাণ দিলেন অদ্ভুত উপায়ে। তাদের প্রত্যেকের সামনে একটি করে পাত্রে পানি রাখা হলো। অতঃপর সেগুলোতে মসূর ডাল ছাড়া হলো। উদ্দেশ্য হলো, যদি মসূরের একটি দানাও পানিতে ভেসে থাকে, তাহলে তারা ডাইনি বলে বিবেচ্য হবে! বলা বাহুল্য প্রত্যেকেই পরীক্ষায় আটকে গেলেন। লোহার পাইপ আর রড দিয়ে পিটিয়ে তাদের হাত পা ভেঙে দেয়া হলো, মাথার চুল কেটে দেয়া হলো, চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়া হলো মরিচের গুড়া! রক্তাক্ত অবস্থায় তাদের ফেলে রাখা হয়েছিল সেখানটাইতেই, যেখানে তাদের নির্যাতন করা হয়। পঙ্গুত্ব বরণ করলেও, পুলিশ এসে উদ্ধার করায় সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী সোমা চৌধুরীর মতে, অঞ্চলভেদে ডাইনি নিধনের ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখা গেলেও প্রতিটির গভীরে নারীবিদ্বেষী মনোভাব কাজ করছে। নারীকে অবদমিত করে রাখা, শাস্তি দেয়া, যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথা প্রতিষ্ঠান আর সংস্কার মানতে বাধ্য করার মানসিকতাই পুরুষদের এহেন অপরাধে প্রলুব্ধ করে। বিশেষ করে পরিবার পরিজনহীন কোনো নারী জমির মালিক হয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠলে অনেকেরই চক্ষুশূলে পরিণত হন। বিশেষ করে আদিবাসী আর উপজাতি নারীদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। কেননা, এরকম ঘটনা তাদের সাথেই অহরহ ঘটছে।
তবে সকল ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া থাকে। একদিকে যেমন এই ঘৃণ্য অপরাধ ঘটেই চলেছে, অন্যদিকে এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে জনমত, সংগঠিত হচ্ছে প্রতিবাদ। ‘সেন্টার ফর সোশ্যাল জাস্টিস’ এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ডাইনি নিধন প্রবণ এলাকায় নারীদের অধিকার এবং সম্পত্তি সংরক্ষণে কাজ করে চলেছে। ডাইনি নিধনের শিকার নারীদের জন্য সুবিচার এবং ক্ষতিপূরণের জন্যও কাজ করে এ সংগঠনটি। ‘আনান্দি’ নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার নারীদের সংঘবদ্ধ করে এবং এসব অপরাধ প্রতিহত করার সাহস যোগায়, আইনি জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানীয় সংগঠন ও এনজিও ভারতে এই অপরাধ রোধে কাজ করে যাচ্ছে।
আরো আশার বিষয় হলো, এসব অপরাধ রোধে এখন ব্যক্তিগতভাবেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেক নারী। নারী অধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিত আসামের বিরুবালা রাভা তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ ডাইনি নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তার নিরলস পরিশ্রম ও সাহসী ভূমিকায় আসামে ডাইনি নিধনের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতের মধ্যে কঠোরতম আইন পাস হয়েছে। অন্যদিকে প্রখ্যাত লেখক এবং ‘র্যাশনালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ এর প্রতিষ্ঠাতা স্যানাল এদামারুকু সেই ৯০’র দশক থেকে ডাইনি নিধনের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছেন। যদিও ব্লাসফেমির অভিযোগে গ্রেফতার এড়াতে তিনি দেশের বাইরে আছেন, তথাপি বাইরে থেকেই কাজ করে চলেছেন তিনি। তার মতে, শিক্ষাই এই অপরাধ প্রতিহত করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে শিখিয়েছেন যে রোগ ব্যাধি হয় জীবাণুর বিস্তারের কারণে, আবহাওয়া খারাপ হয় প্রাকৃতিক বিভিন্ন নিয়ামকের কারণে, কোনো ডাইনির জাদুতে নয়।
ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলাদের মধ্যে আরেকটি বড় নাম নিকিতা সোনাভেন। মুম্বাইয়ে বেড়ে ওঠা এ নারী এখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ডাইনি নিধনের শিকার নারীদের বিচারের জন্য একাই লড়াই করে চলেছেন। কখনো স্থানীয়দের পাশে পেয়েছেন নিজের সাহসী ভূমিকার জন্য, কখনোবা সমর্থনের বদলে শিকার হয়েছেন নানান প্রতিকূলতার। সোনাভেন আইন পড়েছেন, তাই আইনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে রয়েছে তার দক্ষতা। তিনি দ্বারে দ্বারে গিয়ে নারীদের বুঝিয়েছেন যে তাদের জমির অধিকার তাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। ‘ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট ২০০৬’ এর কথা উল্লেখ করে তিনি ভরসা দিয়েছেন তাদের সম্পত্তি রক্ষার। কেননা, বিগত বছরগুলোতে ডাইনি নিধনের গোড়ার কারণ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই জমিজমা ও সম্পত্তির মালিকানা। আর এসকল কাজ পরিচালনার জন্য শহর ছেড়ে গুজরাটের এক গ্রামে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন তিনি।
সোনাভেন, রাভা কিংবা এদামারুকুদের মতো আরো অনেকেই এগিয়ে আসছেন ডাইনি নিধনের নামে হত্যাযজ্ঞ চালানোদের প্রতিহত করার জন্য। এরকম পরিস্থিতি কেবল এনজিও আর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, যদি না সরকারের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা থাকে। সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা ছড়ানোর পাশাপাশি আইনের শাসন দৃঢ় করাও এখন সময়ের দাবী। সিগমুন্ড ফ্রয়েড যখন মনোবিজ্ঞানের বই লেখা শুরু করেছিলেন, পৃথিবী থেকে ভূত-প্রেত আর ডাইনিদের কুসংস্কার এক ফুঁৎকারে পালিয়েছিল। অথচ ফ্রয়েডের মৃত্যুর আট দশক পরেও ভারতে এখনো ডাইনি নিধনের মতো ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক এবং হতাশার। গত ২৫ জানুয়ারির মর্মান্তিক ঘটনা যেকোনো সুস্থ মানুষের মনে নাড়া না দিয়ে পারে না। এ ঘটনার যথাযথ বিচার হবে এটাই এখন সকলের প্রত্যাশা। শুধু এ ঘটনাটিই নয়, সমগ্র ভারতে বিগত বছরজুড়ে ঘটতে থাকা এই স্পর্শকাতর অপরাধের প্রতিটির সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যে কঠোর আইন তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তবেই আজকের আধুনিক সভ্যতার কালে আদিম এই বর্বরতার অবসান ঘটবে।