বিডিএস মুভমেন্ট: ইসরায়েলের বিপক্ষে বৈশ্বিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন

বেশ কিছুদিন আগে বৈশ্বিক গণমাধ্যমে একটি খবর বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। আইরিশ লেখিকা স্যালি রুনি তার উপন্যাস ‘বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড, হোয়্যার আর ইউ’ হিব্রু ভাষায় অনুবাদের জন্য ইসরায়েলের একটি অনুবাদ কোম্পানিকে দিতে অস্বীকৃতি জানান। ইসরায়েলি অনুবাদ কোম্পানি ‘মোডান’ উপন্যাসটি অনুবাদের জন্য আইনগত পদ্ধতি অনুসরণ করে যথাযথ বিড করার পরও তিনি সসম্মানে তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, যদি এমন কোনো কোম্পানি উপন্যাসটি অনুবাদের দায়িত্ব নেয় যে কোম্পানির নীতির সাথে তার রাজনৈতিক অবস্থানের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে, তাহলে তিনি নিঃসন্দেহে সম্মানিত বোধ করবেন। তিনি আরও বলেন, “আমি এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করতে পারি না যে প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেনি এবং জাতিসংঘ-ঘোষিত ফিলিস্তিনিদের অধিকারগুলোর পক্ষে নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করতে পারেনি।” নিজের অবস্থান আরও পরিষ্কার করার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইআরডব্লিউ) একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, যেখানে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।

Hxkvlhbl
আইরিশ লেখিকা স্যালি রুনি, যিনি সম্প্রতি ইসরায়েলি অনুবাদ কোম্পানি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন; image source: teenvogue.com

স্যালি রুনি যে কারণে ইসরায়েলি অনুবাদ কোম্পানিকে নিজের লেখার অনুবাদস্বত্ব দিতে চাননি, সেটি তার বক্তব্যের মাধ্যমেই পরিষ্কার। যে মোডান কোম্পানি তার উপন্যাস অনুবাদ করতে চেয়েছিল, তারা দিনশেষে ইসরায়েলের সরকারকেই কর প্রদান করার মাধ্যমে ইসরায়েলি দখলদারিত্বে সহায়তা করে। স্যালি রুনি হয়তো হিব্রু ভাষায় অনুবাদের কাজে অনুমোদন দিলে তার নতুন পাঠকসমাজ তৈরি হতো, যেটি ভবিষ্যতে যেকোনো প্রকাশনার ক্ষেত্রে তাকে বাড়তি সুযোগ এনে দিত। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি এতে আর্থিকভাবেও লাভবান হতেন। এছাড়া তার এই ঘটনায় বেশ বড়সড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ইসরায়েলি আইনসভার একজন সদস্য তার এই অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুমোদন না দেয়াকে ‘ইহুদিবিদ্বেষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাশ্চাত্যের অনেক ব্যক্তি তার রাজনৈতিক অবস্থানেরও সমালোচনা করেছেন। তবে স্যালি রুনি শুরু থেকেই নিজের অবস্থানে অনড়।

Jfkglhlh
স্যালি রুনির উপন্যাস ‘বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড, হোয়্যার আর ইউ’; image source: vulture.com

স্যালি রুনি যে দেশের লেখিকা, সেই আয়ারল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়াই করেছে। ইসরায়েলিরা যেভাবে ফিলিস্তিনিদের ভূমি কেড়ে নিয়ে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, সেটি উপনিবেশের শাসনকাল স্মরণ করিয়ে দেয়। পৃথিবীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় সব উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। উল্টোদিকে, ফিলিস্তিনিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েলের কাছে নিজেদের ভূমি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অতীতে দেখা গিয়েছে, ঔপনিবেশিক শাসকেরা স্থানীয় নাগরিকদের সাথে বর্ণবাদী আচরণ করত। তাদেরকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ভোগ করা থেকে পরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত করত। এমনকি তাদের বর্ণবাদী আচরণকে আইগত বৈধতা দেয়া জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করত। ইসরায়েলও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এজন্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যেসব দেশ দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছে, সেসব দেশের অনেক মানুষ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন।

স্যালি রুনির মতো অসংখ্য সেলিব্রিটি ফিলিস্তিনিদের একটি বৈশ্বিক আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, পেশাগত জীবনেও তারা এই সংগঠনের নীতিগুলো অনুসরণ করেন। স্যালি রুনি যে ইসরায়েলি কোম্পানির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন, তার প্রধান কারণ এই আন্দোলনের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এড়িয়ে চলা। লেখিকা স্যালি রুনি এটাও বলেছেন, কোনো অনুবাদ প্রতিষ্ঠানের যে তারা রাজনৈতিক অবস্থান যদি এমন হয় যে তারা ইসরায়েলি আধিপত্যের বিরোধিতা করে থাকে, তাহলে তিনি দ্বিতীয়বার ভাবা ছাড়াই তাদের অনুবাদের দায়িত্ব দেবেন। বিডিএস আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করা লানা দেল রে, স্টিভি ওয়ান্ডার, এলভিস কস্তেলোর মতো বেশ কয়েকজন গায়ক ইসরায়েলে নিজেদের কনসার্ট বাতিল করেছেন। ২০১৫ সালে পুরো বিশ্ব থেকে প্রায় ৭০০ শিল্পী একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেন, যে চিঠিতে বলা হয়- তারা ইসরায়েলের কোনো আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন না, পেশাগত জীবনে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কোনো অর্থ গ্রহণ করবেন না এবং ইসরায়েলি কোনো প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করবেন না। চিঠিতে স্বাক্ষর করা ব্যক্তিদের মধ্যে স্যালি রুনিও ছিলেন।

Iglhlbbbkc
বিডিএস আন্দোলনের সমর্থকেরা নিয়মিত শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা করে থাকেন; image source: timesofisrael.com

বিডিএস মুভমেন্ট (BDS Movement) এর পূর্ণরূপ হচ্ছে বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাংকশন মুভমেন্ট (Boycott, Divestment and Sanction Movement)। ২০০৫ সালে বিচ্ছিন্নভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন পরিচালনা করা প্রায় ১৭০টি ছোট-বড় সংগঠন নিয়ে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিদের সাথে ইসরায়েলের শান্তি আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ইন্তিফাদা সংঘটিত হয় এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি মারা যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিদের এই বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে এই আন্দোলন ইসরায়েলকে ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ শাসকেরা আইনের মাধ্যমে বর্ণবৈষম্য পরিচালিত করত। দেশটিতে কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যেভাবে বয়কটের ডাক দিয়ে সফল হয়েছিল, সেটি বিডিএস আন্দোলনের নেতৃত্বকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তারা এই অহিংস পন্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেয়।

Gdkgll
বিডিএস আন্দোলন পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত শহরে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে; image source: middleeastmonitor.com

বিডিএস আন্দোলনের প্রধান তিনটি লক্ষ্য হচ্ছে–

১) ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের জায়গার উপর যে অন্যায় আধিপত্য প্রতিসাম্য করেছে, তা থেকে সরে আসতে বাধ্য করা। এছাড়া পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সরকার যে অবৈধ সীমানা প্রাচীর তৈরি করেছে এবং গাজায় কৃত্রিম মানবিক সংকটের উদ্দেশ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সেগুলো তুলে নেয়া।

২) ইসরায়েলে যেসব ফিলিস্তিনি নাগরিক রয়েছেন, তাদের ইহুদিদের সম-অধিকার নিশ্চিত করা।

৩) ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের সময় ও পরবর্তীতে যেসব ফিলিস্তিনি শরণার্থী নিজেদের জায়গা থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালিয়ে এসেছেন, তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা।

বিডিএস আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও সমর্থকরা নিয়মিত বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেন। প্রতিবছর পৃথিবীর প্রায় পঞ্চাশটি শহরে ‘ইসরায়েলি অ্যাপার্থেড উইক’ পালন করা হয়। আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়মিত র‍্যালি ও পদযাত্রার আয়োজন করে এই আন্দোলনের কর্মীরা। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের উচ্চশিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘ইউনিভার্সিটি এন্ড কলেজ ইউনিয়ন’ আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে ‘হিস্তাদরুত’ এর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে। হিস্তাদরুত হচ্ছে ইসরায়েলি ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যদের একটি সংগঠন। তারা এর পেছনে কারণ হিসেবে দেখায় যে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ২০০৯ সালে গাজায় যে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল, তাতে হিস্তাদরুত সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। একটি ট্রেড ইউনিয়ন কখনও এই ধরনের কাজে সমর্থন ব্যক্ত করতে পারে না।

দক্ষিণ আফ্রিকার মানবাধিকার কর্মী ডেসমণ্ড টুটু, পিংক ফ্লয়েডের সাবেক গায়ক রজার ওয়াটার্স, আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক জুডিথ বাটলারসহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই আন্দোলনে নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তবে এর তীব্র বিরোধিতা করে ইসরায়েল। তারা ইসরায়েল বয়কটের মতো আন্দোলনকে নিজ দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং এই আন্দোলনের সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের ঘোষণা দিয়েছে। আমেরিকাতেও গত বছর বিডিএস আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিল পাশ হয়েছে। শুধু ইসরায়েলেই নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই আন্দোলনকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী আন্দোলন’ হিসেবে দেখছেন অনেকে। তবে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য প্রায় সময়ই বিডিএস কর্মীরা বলে থাকেন- তাদের এই আন্দোলন ইহুদিদের বিরুদ্ধে নয়, বরং ইহুদি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে।

ইতোমধ্যে এই আন্দোলন বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করেছে। সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে- তাদের মাধ্যমে অনেক মানুষ ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন। সোডাস্ট্রিম (Sodastream) নামের একটি কোম্পানি দখলকৃত পশ্চিম তীর থেকে নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এই আন্দোলনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের জনসমর্থন বেড়েই চলেছে। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য তাদের অহিংস পন্থাগুলো ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে।

Related Articles

Exit mobile version