লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দুই শিক্ষার্থীকে ১৯৮৪ সালের ১৬ এপ্রিল দেশটির ত্রিপোলি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই ঘটনার পরদিন, ১৭ এপ্রিল, যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের সেইন্ট জেমস স্কয়ারে অবস্থিত লিবিয়ার দূতাবাস, লিবিয়ান পিপলস ব্যুরো, সংলগ্ন এলাকায় গাদ্দাফির শাসনের অবসান এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর দ্য স্যালভেশন অব লিবিয়া’ নামের একটি সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে।
কূটনীতিকদের সুরক্ষা এবং অন্যান্য সুবিধা ১৯৬১ সালে প্রণীত কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশন দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে এই কনভেনশনের আলোকে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যে ‘দ্য ডিপ্লোমেটিক প্রিভিলেজেস অ্যাক্ট’ পাশ করা হয়। ফলে, লন্ডনে অবস্থিত লিবিয়ার দূতাবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ব্রিটিশ সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেখানে অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা ইভোন ফ্লেচার দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেই বিক্ষোভ চলাকালে সকাল ১০টা ১৮ মিনিট নাগাদ লিবিয়ার দূতাবাসের ভেতর থেকে মেশিনগান দিয়ে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ফলে, ইভোন ফ্লেচার গুরুতর আহত হন, এবং পরবর্তীতে ২৫ বছর বয়সী এই পুলিশ কর্মকর্তা ওয়েস্টমিনস্টার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়াও এই গুলিবর্ষণের ঘটনায় অন্তত ১১ জন বিক্ষোভকারী আহত হন।
মূলত আশির দশকের শুরু থেকে বিদেশে অবস্থানরত ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যার জন্য গাদ্দাফির সরকার তৎপর হয়ে ওঠে। এ সময় যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত গাদ্দাফি সরকারের বেশ কয়েকজন সমালোচক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ১৯৮৪ সালের ১৭ এপ্রিলের এই ঘটনার পর বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে লন্ডনের লিবিয়ার দূতাবাস ঘিরে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। অন্যদিকে, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের দূতাবাস ঘিরে দেশটির নেতা গাদ্দাফির অনুগত রেভ্যলুশনারি গার্ড কর্পসের সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। ফলে লিবিয়ায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত অলিভার মাইলস এবং অন্যান্য কর্মকর্তাসহ প্রায় ২৫ জন ব্যক্তি দূতাবাসের ভেতর আটকা পড়েন। এছাড়াও, কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই ত্রিপোলি থেকে তিনজন ব্রিটিশ নাগরিককে আটক করা হয়।
এই ঘটনার পরদিন, ১৮ এপ্রিল, ত্রিপোলিতে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের দূতাবাস থেকে রেভ্যলুশনারি গার্ড কর্পসের সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়। লিবিয়া সরকারের প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনার জন্য দেশটিতে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত অলিভার মাইলসকে অনুমতি দেওয়া হয়, এবং ত্রিপোলি থেকে আটক করা একজন ব্রিটিশ নাগরিককে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯ এপ্রিল দেশটির নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি গণমাধ্যমে প্রদান করা বক্তব্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য ব্রিটিশ সরকারকে সরাসরি দায়ী করে দেশটির তীব্র সমালোচনা করেন। সেই সপ্তাহ জুড়ে লন্ডনে চারটি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়; তবে ২০ এপ্রিল হিথ্রো বিমানবন্দরের দ্বিতীয় টার্মিনাল সংলগ্ন এলাকায় একটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ২২ জন আহত হন। এই ঘটনার সাথে লিবিয়া সরকারের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলা হয়।
ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে অবস্থিত লিবিয়ার দূতাবাস ‘লিবিয়ান পিপলস ব্যুরো’র অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতির জন্য দেশটির সরকারের কাছে আহবান জানায়। তবে, লিবিয়া সরকার সেই আহবান প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৬১ সালে প্রণীত কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতের অনুমোদন ব্যতীত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা একটি দূতাবাসের অভ্যন্তরে তল্লাশি চালাতে পারে না। ১৭ এপ্রিল যখন লিবিয়ার দূতাবাসের ভেতর থেকে মেশিনগান দিয়ে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়, সেই সময় দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা বাইরে অবস্থান করছিলেন। এই দুই দূতাবাস কর্মকর্তা ব্রিটিশ নিরাপত্তাবাহিনী এবং দূতাবাসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে, এই সমঝোতার উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি, এবং ব্রিটিশ সরকার বিশেষ কমান্ডো বাহিনী ‘স্পেশাল এয়ার সার্ভিস’ (এসএএস) প্রস্তুত রাখতে নির্দেশনা জারি করে।
পরবর্তীতে, ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার লিবিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়ে দেশটির কূটনীতিকদের যুক্তরাজ্য ত্যাগের জন্য ২৯ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত সময়সীমা বেধে দেয়। একইসাথে, সেই সময়ের মধ্যে ত্রিপোলিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দেশে ফিরতে নির্দেশনা জারি করে। ২৭ এপ্রিল ইভোন ফ্লেচারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়, এবং সেই দিনই লিবিয়ার কূটনীতিকরা যুক্তরাজ্য ত্যাগ করতে শুরু করে। দেশটি ত্যাগের প্রাক্কালে কূটনীতিকদের লাগেজে ‘ডিপ্লোমেটিক সিল’ ছাপ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৬১ সালে প্রণীত কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের ৯ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, একটি স্বাগতিক দেশ সেই দেশে নিযুক্ত কোনো দেশের কূটনীতিকদের ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করতে পারে, যেটি ‘persona non grata’ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, একই কনভেনশনের ২৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কূটনীতিকদের ব্যবহৃত ‘ডিপ্লোমেটিক ব্যাগ’ সব ধরনের নিরাপত্তা তল্লাশি থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকে।
ব্রিটিশ সরকারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে মোট পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে লিবিয়া দূতাবাসের ৩০ জন কর্মকর্তা নিজ দেশে ফেরার জন্য সেই ভবন ত্যাগ করেন এবং প্রত্যেক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি ছবি তুলে রাখা হয়। এ সময় সৌদি আরব, সিরিয়া, এবং তুরস্কের প্রতিনিধিরা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পুরো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত আটটার মধ্যেই লিবিয়া দূতবাসের কূটনীতিকরা যুক্তরাজ্য ছেড়ে যাওয়ার জন্য বিমানে আরোহণ করেন। অন্যদিকে, একইদিনে ত্রিপোলিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত এবং অবশিষ্ট কর্মকর্তারা যুক্তরাজ্যে পৌঁছান।
লিবিয়া দূতাবাসের কর্মকর্তারা যুক্তরাজ্য ত্যাগ করার পর তদন্তকারী দল সেই দূতাবাসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ব্যাপক অনুসন্ধান পরিচালনা করে। সেই অনুসন্ধানে দূতাবাসের ভেতর থেকে বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি সেখান থেকে গুলি করে ইভোন ফ্লেচারকে হত্যার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়ার দাবি করা হয়। এদিকে, ১৪–১৬ মে এর মধ্যে আরও চার ব্রিটিশ নাগরিক লিবিয়াতে আটক হন, যাদের জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যে আটক গাদ্দাফি প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত চারজন লিবিয়ার নাগরিকের মুক্তি দাবি করা হয়। জিম্মি হওয়া এই ব্রিটিশ নাগরিকদের মুক্তির জন্য ব্রিটিশ সরকার আলোচনার পদক্ষেপ গ্রহণ করে, এবং সেই বছরের ১ সেপ্টেম্বর দুই ব্রিটিশ নাগরিক মুক্তি পান। জিম্মি হওয়ার প্রায় নয় মাস পর ১৯৮৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অন্যান্য ব্রিটিশ নাগরিকরা মুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছান, এবং এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকদের জিম্মিদশার অবসান ঘটে।
ইভোন ফ্লেচারকে হত্যাকাণ্ড এবং কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিকের জিম্মি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন লিবিয়াতে বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন যুক্তরাজ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের বিমান ঘাঁটিগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেয়। পরবর্তীতে, ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে লিবিয়া সরকার ইভোন ফ্লেচার হত্যাকাণ্ডে নিজেদের দায় স্বীকার করে নেয় এবং ফ্লেচারের পরিবারকে আড়াই লাখ পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ লিবিয়া গণবিধ্বংসী অস্ত্র কর্মসূচি পরিত্যাগের ঘোষণা করলে দেশটির সাথে যুক্তরাজ্যের সম্পর্কের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়। ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার লিবিয়া সফরে গিয়ে গাদ্দাফির সাথে সাক্ষাত করেন, এবং এই সফরের মধ্যমে দেশ দুটোর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্কের অগ্রগতি ঘটে। ২০০৯ সালের অক্টোবরে ব্রিটেনের সংবাদভিত্তিক চ্যানেল ‘স্কাই নিউজ’কে দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ইভোন ফ্লেচার হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
তীব্র গণ-আন্দোলন এবং ন্যাটো বাহিনীর হামলার মুখে ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর লিবিয়ার সির্তে শহরে মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিহত হন। তার মৃত্যুর পর লিবিয়ায় ক্ষমতাসীন নতুন প্রশাসনের নিকট ব্রিটিশ সরকার ইভোন ফ্লেচার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দেশটির নিকট হস্তান্তরের আহবান জানায়। ব্রিটিশ সরকারের অনুসন্ধানে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সন্দেহভাজন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে সেই সময় দূতাবাসে কর্মরত মাতুউক মোহামেদ মাতুউক ও আবদুল কাদির আল বাগদাদি– এই দুজনের নাম ওঠে আসে। গুলিবর্ষণের সাথে দূতাবাসের আরেক কর্মকর্তা আবদুল মাজিদ সালাহ আমেরি জড়িত বলে প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সালাহউদ্দিন খলিফা নামে একজনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। ২০২১ সালের নভেম্বরে লন্ডনের রয়্যাল কোর্টস অব জাস্টিস ইভোন ফ্লেচারের মৃত্যুর ঘটনায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সালেহ ইব্রাহিম মাবরুককে যৌথভাবে দোষী সাব্যস্ত করে। তবে, পরবর্তীতে বিচারের জন্য তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি। ইভোন ফ্লেচারের হত্যাকাণ্ড যুক্তরাজ্য এবং লিবিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে।