মে, ২০২০। ইংল্যান্ডের ব্যারো-ইন-ফার্নেস শহর।
শান্ত এই শহরে হঠাৎ করেই দেখা দিয়েছে চাপা উত্তেজনা। অলিতে-গলিতে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে ফিসফাস আওয়াজ। পুলিশ স্টেশনের সামনেও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি মানুষের আনাগোনা। সবখানেই কেমন যেন একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ!
কিন্তু কেন? এজন্য দায়ী করতে হবে ১৯ বছরের এলেনর উইলিয়ামসের একটি ফেসবুক পোস্টকে। স্থানীয় এই তরুণী গুরুতর অভিযোগ এনেছেন কিছু লোকের বিরুদ্ধে, যাদের বেশ কয়েকজন এশিয়ান। তার পোস্ট অনুযায়ী, এই লোকগুলো নানাভাবে তাকে নির্যাতন করেছে। প্রমাণ হিসেবে নিজের বেশ কিছু ছবি ফেসবুকে তুলে দেন তিনি, যেখানে ফোলা চোখ, ক্ষতবিক্ষত আঙুল এবং শরীরে আঘাতের দাগ দেখা যায়।
অভিযুক্ত কয়েকজন
উইলিয়াম কেবল এশিয়ানদের প্রতি অভিযোগ করেননি, কয়েকজন শ্বেতাঙ্গও ফেঁসে যান তার জালে। এদের অন্যতম জর্ডান ট্রেঙ্গোভ। তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ- ২০১৯ সালে ঘুরতে নিয়ে গিয়ে তিনি উইলিয়ামসকে ধর্ষণ করেন, পরবর্তীতে আরো দুবার এর পুনরাবৃত্তি ঘটান। উইলিয়ামস আরো জানান, ট্রেঙ্গোভ তার বাসায় এসে ছুরি দেখিয়ে হুমকি দেন- মুখ খুললে তার কপালে খারাবি আছে। ফলাফল- ট্রেঙ্গোভকে ৭৩ দিন কাটাতে হয় জেলে!
অলিভার গার্ডনার নামে দ্বিতীয় আরেক ব্যক্তিও তাকে নির্যাতন করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন উইলিয়ামস। পাশাপাশি, দুই এশিয়ান ব্যক্তির কাছে সে তাকে বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো বলেও অভিযোগ করে বসেন। কৌশলে ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুল শহরে নিয়ে গিয়ে তাকে পাচার করার চেষ্টার কথাও বলেন। গার্ডনারকে মানসিক স্বাস্থ্য আইন দেখিয়ে আটক করে পুলিশ।
তবে পালের গোদা হিসেবে উইলিয়ামস বেছে নিয়েছিলেন মোহাম্মদ রমজান নামে শহরের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে। শিশু অবস্থায় তাকে অনৈতিক সম্পর্কে বাধ্য করার জন্য রমজানকে দোষারোপ করেন তিনি। এমনকি নারী পাচার চক্রের হোতা হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করেন। উইলিয়ামসের বক্তব্য অনুযায়ী, আমস্টারডামে নিলামে তুলে তাকে নাকি ২৫,০০০ পাউন্ডে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল রমজানের আদেশে, কিন্তু ক্রেতা শেষমুহূর্তে মত পরিবর্তন করলে বেঁচে যান তিনি। যদিও রমজান বারে বারে বলেছিলেন, উইলিয়ামসকে জীবনে একবার এক পার্টি বাদে কোনোদিন দেখেননি তিনি, তারপরেও ফেসবুকের পোস্টকে ধ্রুবসত্য ধরে নেয় বেশিরভাগ মানুষ। ভদ্রলোক ও তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়ে অন্তত ৫০০ চিঠি পাঠানো হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে রমজান তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভিন্ন শহরে চলে যেতে বাধ্য হন।
অভিযোগের প্রভাব
যেকোনো অভিযোগ বিচার-বিবেচনা করতে দু’পক্ষের কথা শোনার প্রয়োজন আছে। তবে আদালতে সেটা হলেও সোশ্যাল মিডিয়াতে তো আর এসবের বালাই নেই। তার ওপর উইলিয়ামস অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে অভিযোগ করেছেন! ফলে তার পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায় অল্প সময়েই। তার উপর করা অন্যায়ের বিচারের দাবি জানিয়ে ফেসবুকে ক্যাম্পেইন খুলে ফেলা হয়, সেখানে নাম লেখায় প্রায় এক লাখ মানুষ। আঙ্গুল ওঠে পুলিশের দিকেও, তারা নাকি দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে।
উইলিয়ামস যাদের নাম উল্লেখ করেন ফেসবুক পোস্টে, তারা সম্মুখীন হয় শহরবাসীর দুর্ব্যবহারের। ট্রেঙ্গোভের বাড়ির দেয়ালে কেউ বড় বড় অক্ষরে লিখে দিয়ে যায়-ধর্ষক! এশিয়ানদের বিরুদ্ধে হেট ক্রাইম বা ঘৃণাজনিত অপরাধের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় আগের বছরের তিনগুণ। অভিযুক্তদের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কেউ না থাকলেও কেবল এশিয়ান হবার কারণে সেরকম দুটি রেস্টুরেন্টের জানালা ঢিল মেরে ভেঙে দেয়া হয়। মুসলিম এক হোটেল মালিক, উইলিয়ামস যার নাম বলেছিলেন, তার ব্যবসায় প্রায় লালবাতি জ্বলার উপক্রম হয়।
তদন্ত কী বলে?
এলেনর উইলিয়ামস যখন ফেসবুকে ব্যস্ত, তখন কিন্তু পুলিশ তার অভিযোগ নিয়ে ঠিকই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো। সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট দিয়ে তো আর দোষী-নির্দোষ নির্ধারণ করা যায় না, এজন্য দরকার ফ্যাক্ট। পুলিশ সেই ফ্যাক্ট সংগ্রহে মন দেয়।
ব্ল্যাকপুলে তাকে পাচার করে দেয়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানা যায়- উইলিয়ামস আসলে তিনি সেখানে একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন। সিসিটিভি ফুটেজ আর ফোন রেকর্ড থেকে বেরিয়ে আসে পুরোটা সময় তিনি কাটিয়েছেন ঘরে টিভি দেখে। অভিযুক্ত দূরে থাক, দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিই তার সাথে ছিল না এ সময়। উইলিয়ামস পুলিশের কাছে দাবি করেছিলেন বিভিন্ন ব্যক্তি অনলাইনে তাকে হুমকি-ধামকি দিতেন। পুলিশ পরীক্ষা করে দেখতে পায়, আসলে তিনি নিজেই ভিন্ন ভিন্ন নামে অ্যাকাউন্ট খুলে নিজেকে এসব মেসেজ পাঠাতেন।
আমস্টারডামে নিয়ে মোহাম্মদ রমজান তাকে নিলামে তুলেছিলেন- এই দাবিও ধোপে টেকেনি। আদালতের কাছে রিপোর্টে পুলিশ জানায়, উইলিয়ামস নেদারল্যান্ডসে ওই সময় ছিলেন বটে, তবে রমজান তখন ইংল্যান্ডে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করছিলেন। ট্রেঙ্গোভের বিরুদ্ধে করা সমস্ত অভিযোগও উইলিয়ামসের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। ২০১৯ সালের মার্চে তার সাথে একবার ঘুরতে গিয়েছিলেন অভিযোগকারী, তবে মাতাল হয়ে যাওয়ায় ট্রেঙ্গোভ তাকে বাড়িতে দিয়ে যান। তাদের সম্পর্ক ব্যস এটুকুই! তাছাড়া যখন ধর্ষণের কথা বলেছেন উইলিয়ামস, তখন জর্ডান ট্রেঙ্গোভ ছিলেন খোদ পুলিশের জিম্মায়। রাস্তায় ঝগড়াঝাটির সূত্র ধরে তাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ।
তবে বড় একটি প্রশ্ন ছিল- উইলিয়ামসকে জখম করা হয়েছে সেটা তো মিথ্যে নয়, এর রহস্য কী? তার নিজের ভাষায় মে মাসের ১৯ তারিখ অজ্ঞাত পরিচয় এশিয়ান লোকেরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। জবানবন্দীতে উইলিয়াম উল্লেখ করেন তাকে এক বাড়িতে নিয়ে যৌন নির্যাতনের পর পিটিয়ে আহত করে অপহরণকারীরা। এরপর ফেলে যায় মাঠে।
তবে চিকিৎসকেরা যাচাই করে দিলেন ভিন্ন তথ্য। উইলিয়ামসের ক্ষত সবই সেলফ-ইনফ্লিক্টেড, তার মানে নিজেই নিজেকে মেরেছেন তিনি! যে বাড়িতে নিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল তা ছিল ফকফকা, ক্রাইম সিনের কোনো আলামতই ছিল না। প্রতিবেশীরা সাক্ষ্য দেয়- দু’বছর ধরে খালি পড়ে আছে বাড়ি, উইলিয়ামসের বলা সময়েও কাউকে দেখা যায়নি বাড়ির আশেপাশে।
পুলিশ প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে চিরুনি অভিযান চালায় সেই মাঠে, যেখানে উইলিয়ামসকে পাওয়া গেছে। দেখা মেলে একটি হাতুড়ির। সিসিটিভি ব্যবহার করে জানা যায়- স্বয়ং ভিক্টিম সুপারস্টোর থেকে কিনেছেন এই বস্তু! বিশেষজ্ঞরা আদালতে প্রমাণ করে দেন- সমস্ত জখম করা হয়েছে এই হাতুড়ি দিয়েই।
বিচার
উইলিয়ামসের বিচারক রবার্ট অ্যালথাম রায়ে উল্লেখ করেন- আসামীর শিশুকাল আনন্দময় ছিল না, সেজন্য সেলফ-হার্ম বা নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা আছে তার। তবে এজন্য অন্য মানুষের জীবন নরক করে তোলা যাবে এমন লাইসেন্স পেয়ে যাননি তিনি। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, আসামীর মধ্যে অনুতাপের কোনো চিহ্ন নেই, এবং ঠিক কী কারণে ভয়াবহ এই গল্প ফেঁদে সরকার ও সাধারণ মানুষের সময় ও টাকার অপচয় করলেন সেটারও কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দেননি তিনি। ফার্নেসের তপ্ত পরিবেশ ও পুলিশের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির পেছনে সীমিত হলেও তার দায় আছে বলেন মন্তব্য করেন বিচারক।
তবে নিজের দাবি থেকে খুব একটা সরে যাননি উইলিয়ামস। তার উকিল লুইজ ব্ল্যাকওয়েল আদালতের কাছে মক্কেলের একটি চিঠি উপস্থাপন করেন। সেখানে বলা ছিল কিছু কিছু ব্যাপার অতিরঞ্জন করেছেন তিনি, এবং সেজন্য অনুতপ্ত। কিন্তু তিনি দোষী নন, সত্যিই তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আর ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার ফলে এত ঝামেলা হবে জানলে এর ধারেকাছেও যেতেন না তিনি। তবে মন গলেনি বিচারক আর জুরিদের। আট অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাকে। সাড়ে আট বছরের কারাদন্ড জোটে কপালে। তবে এর বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে প্রায় সাথে সাথেই জানায় তার উকিলেরা।
সবচেয়ে বড় ক্ষতি কার হলো? সুপারিন্টেন্ডেন্ট পিয়ারম্যানের মতে, সেসব মানুষের, যারা সত্য সত্যই নির্যাতনের শিকার। কারণ গল্পের সেই রাখাল বালকের মতো বার বার বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে বলে যে ধোঁকা দিয়েছেন উইলিয়ামস, তাতে এরকম অভিযোগ করার আগে একশোবার চিন্তা করবেন আসল ভিক্টিমরা। সত্যিও তখন মিথ্যের তকমা পেয়ে যাবে!
উইলিয়ামসের বোন লুসি স্বীকার করেন যে তার বোন কিছু মিথ্যে বলেছেন। বিশেষ করে আমস্টারডাম ভ্রমণের সময় দুই বোন একসঙ্গেই ছিলেন, এবং পুরো ট্রিপ ছিল ঘটনাবিহীন। বার-তের বছর থেকেও রমজানের হাতে নির্যাতনের ঘটনাও কল্পকাহিনী, কারণ তখন বোনের সাথে একরুমেই থাকতেন তিনি। কোনোদিন এমন হলে তার নজরে পড়তো। তবে তিনি বোনকে শতভাগ দোষী করতে রাজি নন। তার দাবি- উইলিয়ামসকে আসলেই অনেকে হুমকি দিতেন, এবং তাদের নাম কোথাও আসেনি।
উইলিয়ামসের ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয় মিডিয়া ট্রায়াল কাউকে দোষী বানিয়ে দিলেই সে দোষী হয়ে যায় না। আইন-আদালত এমনি এমনি তৈরি করা হয়নি, সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে দোষী-নির্দোষ নির্ধারণের কাজ তাদের হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত। এই ব্যবস্থায় ত্রুতিবিচ্যুতি থাকতে পারে, এবং উন্নতির সুযোগ আছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে জাজ আর জুরি বনে যাওয়া এর বিকল্প হতে পারে না।