ধরুন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন একজন ব্যক্তির ওপরে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোনো রাষ্ট্রে প্রবেশের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। স্বভাবতই ‘আইনের শাসন’ নিয়ে গর্ব করা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কখনোই সেই ব্যক্তিকে তাদের মাটিতে পদার্পণ করতে দেয়ার কথা না। কিন্তু সেই ব্যক্তি শুধু যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাটিতে পা রেখেছেন তা নয়, তিনি ইউরোপে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জার্মানির চ্যান্সেলরের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। ‘আইন’ মেনে চলা ইউরোপীয়রা তাকে বহিষ্কার তো দূরে থাক, তার সঙ্গে সামান্য দুর্ব্যবহারও করার সাহস পায়নি, বরং তাকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আপ্যায়িত করেছে। এই ব্যক্তিটি আর কেউ নন, তিনি রুশ রাজনীতির পাপেট মাস্টার, রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের ‘ধূসর কার্ডিনাল’, ভ্লাদিস্লাভ সুরকভ।
চেচেন–বংশোদ্ভূত রুশ রাজনৈতিক মঞ্চের এই নাট্যকারের জীবনের ২০১২ সাল পর্যন্ত অংশকে এই নিবন্ধের প্রথম পর্বে আলোচনা করা হয়েছে। সুরকভের কূটকৌশলের ফলে রুশ রাজনীতি পরিণত হয়েছে একটি থিয়েটারে। রুশ বামপন্থী, মধ্যপন্থী এবং ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশ তিনিই পর্দার অন্তরাল থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন। রুশ এনজিওগুলোকে তিনিই সহায়তা করেন, আবার এনজিওগুলোকে পিটিয়ে তক্তা বানাতে ইচ্ছুক রুশ ডানপন্থীদের তিনিই উৎসাহ যোগান।
তার এসব পদক্ষেপের ফলে যা হয়েছে তা হলো, বিরোধী দলগুলোর মধ্যে কোনগুলো সত্যিকারের বিরোধী দল, আর কোনগুলো সরকার–সমর্থক বিরোধী দল, সেটা বুঝে ওঠা আর রুশ জনসাধারণের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তারা ক্রমেই সরকারবিরোধী রাজনীতি করা থেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে রাশিয়ার বর্তমান ক্ষমতাসীন অভিজাতদের ক্ষমতায় টিকে থাকা হয়ে উঠেছে তুলনামূলকভাবে সহজ।
রুশ ঔপন্যাসিক এদুয়ার্দ লিমোনভ সুরকভ সম্পর্কে বলেছেন, সুরকভের ব্যবস্থাপনায় রাশিয়া পরিণত হয়েছে একটি ‘চমকপ্রদ উত্তর–আধুনিক থিয়েটারে’। অন্যদিকে, রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিমিত্রি ওরেশকিনের মতে, ১৯২০ ও ১৯৩০–এর দশকে সোভিয়েত গোয়েন্দারা বিরোধী দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করত, সুরকভ সেটা আধুনিক রাশিয়ায় ব্যবহার করছেন সাফল্যের সঙ্গে। আর ‘সংযুক্ত রাশিয়া’ দলের উপ–সম্পাদক সের্গেই ঝেলেজনিয়াক বলেছেন, সুরকভ রাশিয়ার ‘সবচেয়ে প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একজন’।
সুরকভের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে সহিংসতা এড়িয়ে চলার পক্ষপাতী। সহিংসতার পরিবর্তে তিনি কূটকৌশল, চাতুর্য এবং প্রচারণার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা রক্ষায় আগ্রহী। তার এই বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে মস্কো রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটের সাংবাদিকতা বিষয়ক অধ্যাপক ইগর ইয়াকোভেঙ্কো বলেন, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কৌশল ছিল ‘তিন ভাগ সহিংসতা ও এক ভাগ প্রচারণা’, আর সুরকভের রাজনৈতিক কৌশলের সারমর্ম হচ্ছে ‘চার ভাগ প্রচারণা ও খুব স্বল্প পরিমাণ সহিংসতা’!
বস্তুত রাজনৈতিক বিরোধীদের কীভাবে দমন করা উচিত এই বিষয়টি নিয়ে পুতিনের সঙ্গে সুরকভের মতপার্থক্যও হয়েছে। প্রাক্তন কেজিবি কর্মকর্তা পুতিন স্বভাবতই রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনে নিপীড়নমূলক পন্থার পক্ষপাতী, অন্যদিকে প্রাক্তন থিয়েটার বিষয়ক ছাত্র সুরকভ চাতুর্যের সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করতে ইচ্ছুক। ২০১১ সালে যখন রাশিয়ায় ব্যাপক আকারে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল, তখনও তাঁদের মধ্যেকার এই পার্থক্য ফুটে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী পুতিন তখন কঠোর হাতে বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারকে আহবান জানিয়েছিলেন, অন্যদিকে সুরকভ বিক্ষোভকারীদের ‘নতুন একটি সৃজনশীল শ্রেণী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দিমিত্রি মেদভেদেভের প্রথম মেয়াদ শেষ হলে রুশ অভিজাতদের মধ্যে পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান কে হবেন সেটা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। তাদের একদল মেদভেদেভকে পুনরায় রাষ্ট্রপতি করার পক্ষপাতী ছিলেন, অন্য দল পুতিনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী ছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, সুরকভ এই দ্বন্দ্বে মেদভেদেভের পক্ষাবলম্বন করেন, কিন্তু পুতিনের সমর্থকরা এই দ্বন্দ্বে জয়ী হন এবং পুতিন আবার তৃতীয় মেয়াদে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
পুতিন ক্ষমতায় এসে কিন্তু এজন্য সুরকভের ওপরে প্রতিশোধ নেননি। কিংবা হয়ত, নিতে পারেননি। ২০১২ সালের ২১ মে সুরকভকে রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির প্রশাসনের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালের ৮ মে পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। এসময় সুরকভের নামে অভিযোগ ওঠে, তিনি মস্কোর ‘স্কোলকোভো উদ্ভাবন কেন্দ্রে’র নির্মাণের সময় দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কারো নামে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেই সেটি যে সত্যি, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ, রাশিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করা নতুন কিছু নয়। পরবর্তীতে অবশ্য সুরকভের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু সুরকভকে তার পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়।
২০১৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাকে রুশ রাষ্ট্রপতির সহকারী নিযুক্ত করা হয় এবং তিনি দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া সংক্রান্ত বিষয়ে পুতিনের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। সাধারণ দৃষ্টিতে এটি ছিল সুরকভের জন্য পদোবনতি, কিন্তু রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ক্রেমলিনের ক্ষমতার বিন্যাস পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় ভিন্ন, তাই এখানে কোনো ব্যক্তির পদমর্যাদা তার প্রকৃত ক্ষমতা নির্দেশ করে না।
এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন ২০১৩–২০১৪ সালে ইউক্রেনে সংঘটিত পশ্চিমা–সমর্থিত অভ্যুত্থানের ফলে রুশপন্থী ইউক্রেনীয় সরকারের পতন ঘটে এবং তদস্থলে একটি উগ্র ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী ও পশ্চিমাপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন হয়। সুরকভ এসময় পুতিনের ইউক্রেন বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে রুশ সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাই সুরকভকে ইউক্রেন বিষয়ক দায়িত্ব প্রদান করাটা তার প্রকৃত গুরুত্বেরই পরিচায়ক।
সুরকভের দিকনির্দেশনায় ২০১৪ সালে পূর্ব ইউক্রেনে ব্যাপক গোলযোগ শুরু হয় এবং ক্রিমিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। রুশ সৈন্যরা ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং ২০১৪ সালের ১৬ মার্চ রুশ তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটে ক্রিমিয়ার অধিবাসীরা রাশিয়ার সঙ্গে যোগদানের পক্ষে ভোট দেয়। পশ্চিমা বিশ্ব এই গণভোটের ফলাফলকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুরকভসহ ক্রিমিয়ার গণভোটের সাথে জড়িত ১১ জন ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এবং তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২১ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়া সুরকভের ওপরে অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
তার ওপরে জারিকৃত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে সুরকভকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে তিনটি বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে তারা হলো টুপাক শাকুর, অ্যালেন গিন্সবার্গ আর জ্যাকসন পোলোক। তাদের কাজ সম্পর্কে জানার জন্য আমার সেখানে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
আর সুরকভের ওপরে জারিকৃত ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা কতটুকু ছিল, তা তো এই নিবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদ থেকেই আন্দাজ করা যায়।
২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম ইউক্রেনের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তার পিছনে সুরকভের ‘অবদান’ অপরিসীম। নিজ রাষ্ট্রে যিনি রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে সহিংসতা ব্যবহারে অনিচ্ছুক, রাষ্ট্রসীমার বাইরে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে তিনি নিপুণভাবে সহিংসতাকে ব্যবহার করেছেন। পূর্ব ইউক্রেনীয় রুশপন্থীদের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও তাদের গোপন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান থেকে শুরু করে রুশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া পূর্ব ইউক্রেনীয় মিলিশিয়া কমান্ডারদের গুপ্তহত্যার আয়োজন– সবকিছুতেই সুরকভের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে বলে পশ্চিমা ও ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিযোগ।
ইউক্রেনীয় গৃহযুদ্ধের ফলে রাশিয়া ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি, কিন্তু ইউক্রেনের পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মধ্যে স্থায়ী একটি বিরোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এবং পূর্ব ইউক্রেনে প্রতিষ্ঠিত দনেতস্ক ও লুগানস্ক প্রজাতন্ত্র দুটি যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাটোতে সদস্যপদ লাভ করতে পারবে না। কারণ পশ্চিমারা রাশিয়ার সঙ্গে প্রায় যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে এরকম একটি রাষ্ট্রকে নিজেদের সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে আগ্রহী নয়। অর্থাৎ, ইউক্রেনীয় গৃহযুদ্ধের ফলে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পথ রুদ্ধ হয়েছে, এবং সুরকভ এতে সক্রিয় অবদান রেখেছেন।
রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের নামানুসারে ‘পুতিনবাদ’ নামে যে রাজনৈতিক মতবাদ রাশিয়ায় প্রচলিত হয়েছে, তার মুখ্য প্রবক্তাও সুরকভ। আজকের রাশিয়ায় পুতিনের যে জনপ্রিয়তা, সেটির সৃষ্টির পেছনে সুরকভের অবদান অনস্বীকার্য। ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সুরকভ ‘নেজাভিসিমায়া গাজেতা’ (Независимая газета) পত্রিকায় ‘পুতিনবাদের দীর্ঘাবস্থা’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন এবং এতে পুতিনবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেন। সাধারণভাবে এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো শক্তিশালী রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় প্রভাবাধীন অর্থনীতি, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া, জাতীয় স্বার্থের একটি সাধারণ ব্যাখ্যা, একটি বহুত্ববাদী ঐক্যবদ্ধ রুশ সমাজ প্রভৃতি। পুতিনের সমর্থকরা পুতিনবাদকে অলিখিতভাবে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী, যাতে পুতিনের অনুপস্থিতিতেও রাশিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা বজায় থাকে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুরকভ রুশ রাষ্ট্রপতির ইউক্রেন বিষয়ক উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তার স্থলে ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত দিমিত্রি কোজাককে নিযুক্ত করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনস্কির নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইউক্রেনীয় সরকার যেহেতু পূর্ববর্তী সরকারের তুলনায় কম উগ্রপন্থী, সেজন্য বর্তমান অবস্থা বজায় রাখার ভিত্তিতে মস্কো কিয়েভের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে আগ্রহী। এজন্য সুরকভকে তার অবস্থান থেকে সরতে হয়েছে, কারণ তার নাম ইউক্রেনের সহিংসতার সঙ্গে স্থায়ীভাবে জড়িয়ে গেছে।
তবে ইউক্রেন বিষয়ক দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেও রুশ রাজনীতিতে সুরকভের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটবে এরকমটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত ক্রেমলিনের এই প্রধান রাজনৈতিক প্রযুক্তিবিদকে নতুন কোনো ভূমিকায় দেখা যাবে রাশিয়ার ক্রমশ জটিল হয়ে আসা রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে।
সুরকভের সমালোচক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যাও কম নয়। পশ্চিমা বিশ্বে তো বটেই, রাশিয়ার বহু বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ এবং কিছু সরকারি কর্মকর্তাও সুরকভের ঘোর বিরোধী। কিন্তু সুরকভ যে একজন অত্যন্ত ধুরন্ধর রাজনৈতিক কৌশলবিদ, সেটি তার চরম শত্রুরাও স্বীকার করে। বিখ্যাত রাশিয়া বিশেষজ্ঞ মার্ক গালেওত্তি সুরকভ সম্পর্কে বলেছেন, “সুরকভ এতটাই চালাক যে মাঝে মাঝে এটি তার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।” বস্তুত, সুরকভের চতুরভাবে রুশ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে অনেকেই ঈর্ষা করে এবং এর ফলে তার শত্রুতে পরিণত হয়।
সুরকভ একজন চমকপ্রদ সাহিত্যিকও বটে। ২০১০ সালে তিনি ‘নাতান দুবোভিৎস্কি’ ছদ্মনামে ‘প্রায় শূন্য’ নামে একটি রাজনৈতিক উপন্যাস প্রকাশ করেন। এই উপন্যাসে ‘অসমান্তরাল যুদ্ধ’ (non-linear war) সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে ইউক্রেনে রুশপন্থী ও পশ্চিমাপন্থীদের মধ্যে যে সংঘাত চলছে এবং তাতে রাশিয়া যে কৌশল ব্যবহার করছে, তার অনেক কিছুই বর্ণিত হয়েছে এই বইটিতে।
ব্যক্তিগত জীবনে সুরকভ বিবাহিত। ১৯৮৭ সালে ইউলিয়া ভিশনেভস্কায়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়, কিন্তু ১৯৯৬ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৯৮ সালে সুরকভ তার ব্যক্তিগত সহকারী নাতালিয়া দুবোভিৎস্কায়াকে বিয়ে করেন এবং বর্তমানে এই দম্পতি চার সন্তানের জনক–জননী। সুরকভ যে ‘নাতান দুবোভিৎস্কি’ ছদ্মনামে লেখালেখি করেন, এই নামটিও তার বর্তমান স্ত্রীর নাম থেকে নেয়া। উপন্যাস লেখার পাশাপাশি সুরকভ ‘আগাতা ক্রিস্তি’ নামক একটি ব্যান্ডের জন্য সঙ্গীতও রচনা করেছেন। সুরকভ মাতৃভাষা রুশ ছাড়াও ইংরেজি, জার্মান ও চেচেন ভাষায় পারদর্শী।
সুরকভ তার রাজনৈতিক জীবনকে সংক্ষেপে এভাবে বর্ণনা করেছেন,
আমি ইয়েলৎসিনকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সহায়তা করেছি, আমি পুতিনকে রাশিয়াকে স্থিতিশীল করার কাজে সহায়তা করেছি, আমি মেদভেদেভকে রাশিয়াকে গণতন্ত্রায়িত করতে সহায়তা করেছি। সবগুলো দলই ছিল অসাধারণ!
বলাই বাহুল্য, যিনি ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’ ও ‘পুতিনবাদে’র প্রবক্তা, রুশ রাজনীতিতে তার ভূমিকা এর চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
এই সিরিজের প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১) ভ্লাদিস্লাভ সুরকভ (পর্ব – ১): রুশ রাজনৈতিক মঞ্চের নেপথ্যে থাকা পাপেট মাস্টার