পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক দলগুলোর একটি কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না। চীনকে এই রাজনৈতিক দল শাসন করছে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে। চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির ২০ তম ন্যাশনাল কংগ্রেস শুরু হয় অক্টোবরের ১৬ তারিখ, শেষ হয় অক্টোবরের ২২ তারিখে। পাঁচ বছর মেয়াদী চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস ছিল শি জিনপিংয়ের ক্ষমতা সুসংহতকরণের সুবর্ণ সুযোগ। শি সেই সুযোগ নিয়েছেন পুরোপুরি, তৃতীয় মেয়াদে সিসিপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি সুগম করেছেন তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথও।
শি জিনপিংয়ের তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা প্রত্যাশিত ছিল, প্রত্যাশিত ছিল সিসিপিতে ভিন্নমতাবলম্বীদের সরিয়ে দেওয়াও। চীনা প্রধানমন্ত্রী (প্রিমিয়ার) লে কেকিয়াং যেমন অবসরে যাচ্ছেন, পলিটিব্যুরো থেকে ঝড়ে পড়ছেন লি ঝানসু, হান ঝেংয়ের মতো বাজার অর্থনীতির সমর্থকেরা। চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির এবারের কংগ্রেসের বড় চমক, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে লি কুইয়াংয়ের উত্থান। আগামী মার্চে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন অবসরে যাবেন, তখন তিনিই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
লি কুইয়াং এর রাজনৈতিক উত্থান
চীনের ২০ তম ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাধ্যমে শুরুতে ২০৫ সদস্য বিশিষ্ট সেন্ট্রাল কমিটি নির্বাচন করা হয়েছে, পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে নির্বাচন করা হয়েছে ২৪ সদস্য বিশিষ্ট পলিটিব্যুরো ও ৭ সদস্য বিশিষ্ট পলিটিব্যুরো সেন্ট্রাল কমিটি। পুরো প্রক্রিয়াতেই শি জিনপিং সিসিপিতে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছেন, নিজের অনুগতদের দলের বিভিন্ন দায়িত্বে এনেছেন। নিজের অনুগতদের পার্টির শীর্ষপদে নিয়ে আসার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হলেন লি কুইয়াং, যিনি আগামী মার্চে চীনের প্রধানমন্ত্রী হবেন।
লি কুইয়াং বর্তমানে চীনের বাণিজ্য নগরী সাংহাইয়ের সিসিপির আঞ্চলিক সাধারণ সম্পাদক, একইসাথে সেখানকার সর্বোচ্চ প্রশাসকও। জেজিয়াং প্রদেশ থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিবিদের উত্থান শুরু ২০০৪ সালে, যখন লি তখনকার জেজিয়াং সিসিপির প্রধান শি জিনপিং এর চিফ অব স্টাফ হিসেবে কাজ করেন। শি জিনপিং যে বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন, একই বছরে লি কুইয়াং গভর্নর হিসেবে দায়িত্বে আসেন জেজিয়াং প্রদেশের। সেখান থেকে পার্টি প্রধান হন জিয়াংশোর, পরবর্তীতে শি তাকে নিয়ে আসেন বাণিজ্য নগরী সাংহাইয়ে।
সাংহাইয়ে দায়িত্ব পালনকালে লি সমালোচিত হয়েছেন কঠোর লকডাউন আরোপের জন্য, সোশ্যাল মিডিয়াতে লি শিকার হয়েছেন ব্যবহারকারীদের ট্রলের। দেশব্যাপী সমালোচনা সত্ত্বেও লি চীনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে আসতে সমর্থ হয়েছেন, কারণ তিনি শি জিনপিং এর সমর্থন ধরে রাখতে পেরেছেন।
কেন লি কুইয়াংকে বেছে নিলেন শি জিনপিং?
১৯৭৬ সালের পরে লি কুইয়াং প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, যিনি আগে উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি। চীনের শাসনকাঠামোতে এই প্রথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শি জিনপিং পদোন্নতির প্রথা ভেঙেছেন, কারণ গত দুই দশক ধরে লি কুইয়াং নিরঙ্কুশ আনুগত্য দেখাচ্ছেন শি জিনপিং এর প্রতি।
শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে দ্রুত আসতে থাকেন লি কুইয়াং, নেতৃত্ব দেন জেজিয়াং, জিয়াংশু আর সাংহাইকে। কিন্তু লি কুইয়াং তার প্রশাসনিক জীবনে বেইজিংয়ের দায়িত্ব পালন করেননি, বেইজিংয়ের ক্ষমতাবলয়ে লি কুইয়াং এর বিচরণও সীমিত। শি জিনপিং এমন একজন প্রধানমন্ত্রীই চেয়েছেন, যিনি সবকিছুর জন্য প্রেসিডেন্টের উপর নির্ভরশীল থাকবেন। কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা নিজের আশেপাশে কম দক্ষ লোক রাখতে পছন্দ করেন, যাতে ক্ষমতার কেন্দ্রে কোনো হুমকি না আসে। লি কুইয়াং সেদিক থেকে যোগ্য প্রার্থীই।
শি জিনপিং এর সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লি কুকিয়াংসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের একটি অন্যতম পার্থক্য বাজার ব্যবস্থাপনায়। লি কুকিয়াংরা বিশ্বাস করেন তুলনামূলক মুক্ত অর্থনীতিতে, শি জিনপিং বিশ্বাস করেন অর্থনৈতিক কাঠামোতে রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রের। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা লি কুইয়াং বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শি জিনপিংয়ের অনুসারী, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাখতে চান সরকারের নিয়ন্ত্রণেই।