নভেম্বর ০২, ২০১৬। ক্যালিফোর্নিয়ার শাস্তা (Shasta) কাউন্টির রেডিং শহর।
কিথ প্যাপিনি কাঁপা হাতে ৯১১ ডায়াল করলেন। তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানের মা শেরি (Sherri Papini) হাঁটতে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি। ছেলেমেয়েদের ডে-কেয়ার থেকে নিয়ে আসার কথা থাকলেও তার পাত্তা নেই। এমন তো কখনো হয়নি! কিথ প্রচন্ড উদ্বিগ্ন।
পুলিশ গুরুত্বের সাথে কিথের কথা শুনলো। প্রায় সাথে সাথেই কাজে নেমে পড়লো তাদের একটি দল। তাদের সাথে যোগ দিল শহরের অন্যান্য লোক এবং কিথের পরিবারের সদস্যরা। শেরি প্যাপিনির ব্যাপারে যেকোনো তথ্যের জন্য ঘোষণা করা হলো পুরষ্কার। এজন্য ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৫০,০০ ডলার তুলে ফেললেন কিথের বন্ধুরা।
শেরি প্যাপিনির অন্তর্ধান
প্যাপিনির নিখোঁজ হওয়া মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে বেশ গুরুত্ব পায়। চারদিন পর গুড মর্নিং আমেরিকা (Good Morning America) টিভি শো-তে কিথ আমন্ত্রণ পান। কথোপকথনে উঠে আসে বিকালে হাঁটতে বেরিয়ে উধাও হয়ে যান শেরি।সর্বশেষ তার সাথে কিথের যোগাযোগ হয় টেক্সট মেসেজে, তা-ও সকাল সাড়ে দশটায়, কিথ দুপুরে খেতে বাসায় আসবেন কিনা জানতে চেয়ে।
কিথ ফোন বাসায় রেখে যাওয়ায় স্ত্রীর মেসেজ দেখতে পান দুপুর দেড়টার পর, যখন তিনি লাঞ্চ করতে বাসায় ফেরেন। খালি বাসা দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তিনি, কারণ সবসময়েই তার স্ত্রী বাচ্চাদের এ সময় ডে-কেয়ার থেকে নিয়ে আসেন। কিথ এরপর ফোন ফাইন্ডার অ্যাপ দিয়ে শেরির মোবাইলের লোকেশন বের করেন। বাড়ি থেকে প্রায় এক মাইল দূরে রাস্তার ধারে পড়ে ছিল তার স্ত্রীর ফোন। সাথে ইয়ারবাড এবং প্যাপিনির একগাছি সোনালী চুল।
পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে প্যাপিনিকে। যোগ দেয় এফবিআই। বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেও বেশ ফলাও করেও প্রচারিত হয় ছোট্ট শহরের ঘটনা। অনেকেই বলতে শুরু করেন- অপহরণ করা হয়েছে অসহায় মহিলাকে। এমন সময় শুরু হয় নাটকের দ্বিতীয় ভাগ।
ইন্টারস্টেট-৫ এর পথচারী
শেরি প্যাপিনির নিখোঁজ হবার পর পেরিয়ে গেছে বাইশ দিন। রেডিং থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরে উডল্যান্ডের হাইওয়ে পুলিশের কাছে ২৪ নভেম্বর থ্যাঙ্কসগিভিং ডে-তে ভোর সাড়ে চারটায় ফোন এলো। এক মহিলাকে রাস্তার মাঝ দিয়ে দৌড়াতে দেখা যাচ্ছে। দ্রুত গাড়িতে করে অকুস্থলে হাজির হন অফিসারেরা। ইন্টারস্টেট-৫ হাইওয়ের থেকে বের হওয়ার পথে খুঁজে পেলেন ক্লান্ত আর আহত এক নারীকে। তার কোমরে শেকল, যার সাথে বাঁধা বাম হাত। দ্রুতই তাকে শেরি প্যাপিনি বলে চিহ্নিত করলো পুলিশ।
চিকিৎসার জন্যে প্যাপিনিকে নেয়া হলো নিকটবর্তী উডল্যান্ড মেমোরিয়াল হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা তার শরীরে অনেকগুলো ক্ষতের সন্ধান পেলেন। তার চুলও কাটা ছিল ছোট করে। তদন্তের সার্থে এখানেই তার কাপড়চোপড় থেকে ডিএনএ-র নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
খবর পেয়ে কিথ ও পরিবারের লোকেরা দ্রুতই শেরিকে নিয়ে যায়। তদন্তকারীরা তার সাথে প্রাথমিকভাবে কথা বলে কিছুই উদ্ধার করতে পারলেন না। শেরি তেমন কোনো কথা বলতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি দাবি করেন- তাকে অপহরণ করা হয়েছিল, এবং অপরাধীদের কথা থেকে মনে হয়েছিলো তাকে কোথাও পাচার করে দেবে তারা। তবে স্পষ্টভাবে কিছু মনে করতে পারছিলেন না বলে জানান তিনি।
বেশ কয়েকবার কথা বলেও শেরির থেকে পুরো ঘটনার সুস্পষ্ট বিবরণ বের করতে পারলেন না গোয়েন্দারা। তিনি কীভাবে পালিয়ে এলেন কিডন্যাপারদের হাত থেকে সেটাও পরিষ্কার হলো না। কেবল এটুকু জানা গেল যে ল্যাটিন দুই মহিলা তাকে জোর করে রাস্তার ধার থেকে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। তাদের একজন তাকে আঘাত করেছিল, ফলে অনেকটা সময় বেহুঁশের মতো পড়ে ছিলেন তিনি। তাকে কোথাও রাখা হয়েছিল সেখানকার বর্ণনাও ভালো করে দিতে ব্যর্থ হন শেরি।
সন্দেহের ছায়া
অপহরণের প্রায় এক বছর পর প্যাপিনির কথার উপর ভিত্তি করে সন্দেহভাজন কিডন্যাপারদের স্কেচ জনসমক্ষে প্রকাশ করে পুলিশ। তবে এর মধ্যেই পুরো ঘটনা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে তারা। শাস্তা কাউন্টির এক পুলিশ কর্মকর্তা প্যাট ক্রোফোলার (Pat Kropholler) এবিসি নিউজের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জানান- প্যাপিনির কথাবার্তায় প্রচুর ফাঁক রয়েছে। তিনি বিভিন্ন সময় অপহরণ নিয়ে এমন সব তথ্য দিচ্ছেন যা পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক।
ইতোমধ্যে প্যাপিনির কাপড় থেকে সংগৃহীত ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নিশ্চিত হওয়া গেছে এই ডিএনএ একজন পুরুষের। কিন্তু পুলিশের ডাটাবেসে রাখা কোনো নমুনার সাথে মেলেনি সেটা। তদন্তকারীরা এবার শেরির ফোন রেকর্ড চেক করেন। তবে খুব বেশি কিছু জানতে পারলেন না তারা।
এরপর প্রায় তিন বছর হিমাগারে চলে যায় তদন্ত। ২০২০ সালের মার্চে জেনেটিক প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে পরীক্ষা করা হয় ডিএনএ। সন্দেহভাজন ব্যক্তির একজন আত্মীয়কে শনাক্ত করতে সক্ষম হন তারা। সেই ব্যক্তির দুই ছেলের একজন জেমস রেইস (James Reyes), যার সাথে প্যাপিনির আগে বাগদান হয়। তদন্তকারীরা রেইসের ডিএনএ সংগ্রহ করে দেখতে পেলেন- তাদের নমুনার সাথে মিলে যাচ্ছে তা। প্যাপিনির ফোন রেকর্ড থেকেও তারা তথ্য পান যে নিখোঁজের আগে প্রায় মাসখানেক জেমস রেইসের সাথে কথা বলেছেন প্যাপিনি।
খোলাসা হলো রহস্য
অফিসারেরা রেইসের সাথে কথা বললেন। বেরিয়ে এলো চমকপ্রদ এক গল্প। প্যাপিনি নাকি রেইসকে বুঝিয়েছিলেন স্বামী প্রায়ই তার উপর নির্যাতন করে, তাই এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চান তিনি। রেইস মনে করেছিলেন পুরনো প্রেমিকা আবার তার কাছে ফেরত আসতে চাইছে, তাই রাজি হয়ে যান তিনি। অপহরণের দিন পরিকল্পনামতো রেডিংয়ের প্রায় দুশো মাইল দূরে কোস্টা মেসা (Costa Mesa) শহর থেকে গাড়ি নিয়ে চলে আসেন তিনি, অপেক্ষা করতে থাকেন স্টারবাক্সের একটি দোকানে। প্যাপিনি টেক্সট করলে তাকে রাস্তার পাশ থেকে তুলে নেন রেইস। গাড়িতে ওঠার আগে নিজের একগুচ্ছ চুল কেটে ইয়ারবাডের সাথে রাস্তায় ফেলে দেন প্যাপিনি। এরপর সোজা চলে আসেন কোস্টা মেসায়। এখানেই এক অ্যাপার্টমেন্টে উঠে পড়েন।
প্যাপিনির শরীরে ক্ষতের ব্যাপারেও জানতে চান অফিসারেরা। রেইস জানান, প্যাপিনি নিজেই সেগুলো ঘটিয়েছেন। এমনকি কয়েকবার রেইসকে অনুরোধ করেছেন তাকে আঘাত করতে। তবে ক্রমশই বাচ্চাদের জন্য উতলা হয়ে ওঠেন তিনি। ততদিনে রেইস বুঝে গেছেন তার সাথে নতুন করে সম্পর্কে জড়াতে প্যাপিনির কোনো আগ্রহ নেই। তাই কথামতো তাকে নামিয়ে দিয়ে আসেন উডল্যান্ডের কাছে ইন্টারস্টেট-৫ হাইওয়েতে। সেখান থেকেই পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। পুলিশ রেইসকে জিজ্ঞাসা করে সে কেন এতদিন মুখ খোলেনি। জবারে রেইস জানায় যে সে ভয় পাচ্ছিল তেমন হলে আইনী প্যাঁচে পড়তে পারে সে।
২০২০ সালের আগস্টে নতুন করে শেরি প্যাপিনি ও তার স্বামীকে ডেকে আনেন গোয়েন্দারা। পুরো ঘটনা তার সামনে পেশ করেন তারা। জানিয়ে দেন বানোয়াট গল্প বলে রেইসের সাহায্যে অপহরণ নাটক সাজিয়েছেন তিনি। প্রথমে কিছুটা গাঁইগুই করলেও শীঘ্রই প্যাপিনি বুঝে যান সত্য লুকোনোর আর উপায় নেই, তিনি স্বীকার করে নেন সবকিছু। কিথ তো পড়লেন আকাশ থেকে! এসবের কিছুই জানতেন না তিনি।
বিচার
২০২১ সালের মার্চে প্যাপিনিকে গ্রেফতার করা হয়। তার পেছনে সরকারিভাবে প্রায় তিন লাখ ডলার খরচ হয়েছিল। পাশাপাশি অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য তৈরি করা সরকারি ফান্ড থেকেও প্রায় ৩,০০০ ডলার তুলেছেন তিনি। সব টাকা ফেরত চেয়ে মামলা করা হয় তার বিরুদ্ধে। ২০২২ সালে কিথ প্যাপিনি স্ত্রীর থেকে তালাক চেয়ে আবেদন করেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার ইস্ট ডিস্ট্রিক্টের ইউএস অ্যাটর্নি ট্যালবার্ট (Phillip A. Talbert) সরাসরি জানিয়ে দেন প্যাপিনির অপহরণের ঘটনা পুরোটাই নাটক। জনগণের করের টাকা অযথাই ব্যয় হয়েছে তার পেছনে, খরচ হয়েছে প্রচুর মূল্যবান সময়। এই টাকা আর সময় অন্যান্য জরুরি কাজে দেয়া যেতো। কাজেই প্যাপিনিকে অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
পুলিশ বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনে প্যাপিনির বিরুদ্ধে। উকিলদের সাথে পরামর্শ করে দুটি অভিযোগ স্বীকার করে নেন তিনি। সমস্ত ঘটনা মানসিক অবসাদ থেকে ঘটিয়েছেন তিনি এই দাবি করে তার উকিলেরা শাস্তি হিসেবে এক মাসের হাজতবাস এবং সাত মাসের হাউজ অ্যারেস্টের অনুরোধ করেন। তবে সরকারি উকিল আট মাসের কারাদণ্ড চান। তবে বিচারক উইলিয়াম শাব (William Shubb) আরো কঠোর হলেন। তিনি আড়াই বছরের জন্য কারাগারে পাঠালেন প্যাপিনিকে, সেই সাথে নির্দেশ দেন তিন লাখ ডলার জরিমানা দিতে।
প্যাপিনি বর্তমানে সাজা খাটছেন যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে। ঠিক কী কারণে অপহরণের নাটক সাজিয়েছিলেন তিনি সেটা খোলাখুলি এখনও বলেননি তিনি। তবে তার পরিবার এবং উকিলদের মতে, মানসিক অসুস্থতা থেকেই এমন করেছিলেন তিনি। তবে এজন্য শাস্তি মওকুফ হয়নি তার।