করোনাজনিত মহামারির দরুন বিশ্বজুড়ে সাধারণ জনগণ বেশ কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারকে এই মহামারির কারণে সবচেয়ে বেশি মাশুল গুণতে হচ্ছে। বছরের পর বছর কষ্ট করে গড়ে তোলা বসতবাড়ি ও ব্যবসা হারিয়ে অনেকেই এখন নিঃস্ব। একবেলার খাবারও যোগাড় করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ক্রান্তিলগ্নে পুরোনো আরেকটি সামাজিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, আর সেটা হলো বাল্যবিবাহ। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখনও অনেক পরিবারে একটি ছেলেকে অর্থোপার্জনের ও পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্য ও মেয়েকে পরিবারের জন্য বোঝা হিসেবে ধরা হয়। তাই অভাব-অনটনে থাকা পরিবারগুলোতে ঘরের মেয়েকে বিয়ের বয়স হওয়া না সত্ত্বেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য অজ্ঞতা কিংবা কুসংস্কারই যে সবসময় বাল্যবিবাহের মূল কারণ ঠিক তা-ও না। অনেক সময় অভাবের কাছে মাথা নত করেই অন্তত নিজের মেয়ের জন্য একটা ভালো জীবনের আশায় কিছু মা-বাবা তাদের কন্যাকে বাল্যবিবাহ দেন।
তাছাড়া কিছু প্রভাবশালীর দমন-পীড়ন, কুনজর কিংবা ইভটিজিংয়ের মতো সমস্যায় জর্জরিত হয়েও অনেক কিশোরী বাল্যবিবাহের বলি হয়। কারণ যেটাই হোক না কেন, বাল্যবিবাহের ফল কখনোই একজন কিশোরীর জন্য মঙ্গলজনক নয়। না শারীরিক দিক থেকে, না মানসিক দিক থেকে। আর করোনা মহামারি বাল্যবিবাহের মতো এই অভিশাপকেই আরো শক্তিশালী করে তুলছে।
অভাব-অনটন আর বাল্যবিবাহের ছড়াছড়ি
এই বিষয়ে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখ করার মতো। মেহেরপুরের এক নারী অভাব-অনটনের কাছে হার মেনে তিন কন্যাকে বাল্যবিবাহ দেওয়ার অনুমতি চাইতে যান উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে। তবে মেয়েরা এতে রাজি ছিল না মোটেই। মায়ের সাথে কথা বলে বোঝা যায়, মা-ও তা চান না। মেয়েদেরকে পড়াশোনা করাতে চান। কিন্তু তাদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মেয়েদের অভুক্ত রাখার চেয়ে বিয়ে দেওয়াই শ্রেয় মনে করেন।
এই যাত্রায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. উসমান গণি মেয়েদের আগামী আট মাসের লেখাপড়ার খরচ ও পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করে দেন। কিন্তু এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হাজারও কিশোরী এখনও শিকার হচ্ছে বাল্যবিবাহের।
এই তিন কিশোরীর ভাগ্য ভালো হলেও অনেকের ক্ষেত্রে তা হয় না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বভাবতই এখন করোনা সংকট সামলাতে বেশি ব্যস্ত। কিন্তু বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার দিকটা দুর্বল হওয়ার দরুণ সামাজিক সমস্যা যে দিনে দিনে বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ মেয়ে শিশুদের কাছ থেকে তাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকারই কেড়ে নেয়। হয়তো মেয়ের জন্য একটি সুন্দর জীবনের আশায় তাকে বিয়ে দেন কিছু মা-বাবা। কিন্তু এতে করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোরীকে সইতে হয় অমানবিক নির্যাতন, যা প্রতিহত করার অধিকারও থাকে না মেয়েটির। তাছাড়া একজন কিশোরী যখন গর্ভবতী হয় তখন তার মৃত্যুঝুঁকি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মায়ের তুলনায় অন্তত চার গুণ বেড়ে যায়।
আর এই সুযোগে যৌতুকের মতো কুপ্রথাও যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। আর পারিবারিক সহিংসতাও বাড়বে। অর্থাৎ খরচের ভার কমানোর উদ্দেশ্যে কিছু মা-বাবা যে বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় তা তো সফল হয়ই না, উল্টো পরিবারের আর্থিক অবস্থার আরো অবনতি হয়।
সম্প্রতি ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা-পরবর্তীকালে বিশ্বের প্রায় এক কোটি শিশু হয়তো অভাবের দরুন আর স্কুলে যেতে পারবে না। এই প্রতিবেদন অনুসারে, ১২টি দেশে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। আর বাংলাদেশসহ আরো ২৮টি দেশে এই সম্ভাবনা মাঝারি বা অত্যন্ত বেশিও হতে পারে। আর এতে করে স্কুল ঝরে পড়া ছাত্রীদের ক্ষেত্রে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার ও বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও যে বৃদ্ধি পাবে সেটাও এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ১ কোটি ৭৩ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে যার ৫১% তথা প্রায় ৮৮ লাখ মেয়ে শিক্ষার্থী। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রী প্রায় শতকরা ৫৪ ভাগ বা ৫৬ লাখ ৭০ হাজার।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ
বাল্যবিবাহের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। ইউনিসেফের তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে শতকরা ৫৯ ভাগ মেয়ে ১৮ বছরে পদার্পণ করার আগেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। আর শতকরা ২২ ভাগ মেয়েকে তো ১৫ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ২০১০ সালে এই পরিসংখ্যান ছিল আরো ভয়াবহ। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট)-এর মতে, ২০১০ সালে ১৮ বছর হয়নি এমন কিশোরীদের শতকরা ৬৫ ভাগকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে এই সংখ্যা কমতে কমতে গত বছর ৫৯%-এ এসে দাঁড়ায়। তবে মহামারি বর্তমান পরিস্থিতিকে আবারো অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
শুধুমাত্র জুন, এই এক মাসে ৪৬২ জন কিশোরী বাল্যবিবাহের মতো কু-প্রথার শিকার হয়। জুন মাসে বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও সরকারি উদ্যোগের দরুন ২০৬টি বাল্যবিবাহ প্রতিহত করা হয়। মে মাসে দেশজুড়ে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ছিল ১৮০টি। আর এই সামাজিক কু-প্রথা থেকে বাঁচানো সম্ভব হয় ২৩৩ জন মেয়েশিশুকে। ব্র্যাকের একটি গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮৫ ভাগ বাল্যবিবাহ হচ্ছে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে মা-বাবার দুশ্চিন্তার কারণে। শতকরা ৭১ ভাগ বাল্যবিবাহের শিকার হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন। তাছাড়া বিদেশফেরত পাত্রদের হাতের কাছে পাওয়ায় শতকরা ৬২ ভাগ মেয়েশিশুকে তাদের পরিবার বাল্যবিবাহের জন্য বাধ্য করে।
প্রথমে যে হতভাগ্য মায়ের ঘটনাটি বলা হলো, সেটা ঘটেছিল মেহেরপুরের একটি উপজেলায়। মেহেরপুরে তার অনুমতি চাওয়ার বা খরচ পাওয়ার ঘটনাটি বিরল হলেও বাল্যবিবাহের ঘটনা বা এই ধারণা বিরল নয়। এই জেলায় মাধ্যমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা মিলে মোট ১৭৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২৭টি মেয়েদের জন্য। একটি জরিপে দেখা যায়, এই মহামারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর শতকরা ২০ ভাগ মেয়েদেরই বিয়ে হয়ে গেছে। কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তো ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। এটা তো গেল শুধু একটি জেলার পরিস্থিতি। এগুলো নজরদারিতে না আনলে দেশজুড়ে সমগ্র পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
বিশ্বজুড়ে বাল্যবিবাহের পরিস্থিতি
ওয়ার্ল্ড ভিশনের মতে, আগামী দুই বছরে বিশ্বের প্রায় ৪০ লাখ মেয়েশিশু বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে পড়বে। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির কারণে আগামী এক দশকে অতিরিক্ত ১ কোটি ৩০ লাখ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটতে পারে। কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এরকম আশঙ্কাই প্রকাশ করে জাতিসংঘ। উল্লেখ্য যে, বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লাখ মেয়ে ১৮ বছরে পা রাখার আগেই বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ প্রতি তিন সেকেন্ডে একটি মেয়েশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়। এই হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫ কোটি মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে করতে বাধ্য হবে। ভারত, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ সুদানে অকল্পনীয় হারে বাড়ছে বাল্যবিবাহ।
যেটা শুরুতেই বললাম অভাব-অনটনের বলির শিকার হয় সবার আগে নিম্নবিত্ত পরিবারের কন্যারা। বলা বাহুল্য, এ কারণে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই বাল্যবিবাহের প্রভাব বেশি দেখা যাবে। অনেক ক্ষেত্রে স্কুল মেয়েদের বাল্যবিবাহ থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেয়েশিশুদের অবস্থা, বাল্যবিবাহের জন্য চাপ বা তাদের উপর ঘটে যাওয়া সহিংসতার হিসাব রাখতে সহায়তা করে স্কুলগুলো। আর দীর্ঘ সময় এসব স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুরা তত্ত্বাবধান ও সুরক্ষার বাইরে চলে যাচ্ছে। গার্লস নট ব্রাইডস নামক একটি বৈশ্বিক সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১,৪০০টির বেশি সংস্থা নিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধে কাজ করছে।
এই সংস্থার প্রধান নির্বাহী ফেইথ মোয়াঙ্গি-পাওয়েল বলেন, “যারা মাঠে কাজ করছেন তারা জানান যে, পরিস্থিতি ভালো নয়। মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে বাল্যবিবাহের সংখ্যা আরো বাড়বে। এসব তথ্য আমরা ভারত, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা থেকে পেয়েছি। কেউ কেউ বলছেন, বাল্যবিবাহ ঠেকানোর জন্য গত কয়েক দশকে আমরা যত কাজ করেছি তা আবার ফিরে আসতে পারে। স্কুল মেয়েশিশুদের রক্ষা করে। তাই যখন স্কুল বন্ধ, তখন বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।” তিনি আরো বলেন, “করোনা-পরবর্তীকালে অনেক মেয়েই হয়তো আর স্কুলে যেতে পারবে না যেটা খুবই ভয়াবহ একটা বিষয়। তারা যেন স্কুলে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায় তা আমাদের নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”