দুই পায়ে চলা ক্যাঙ্গারু, হাঁসের মতো দেখতে প্লাটিপাস, উড্ডয়ন ক্ষমতাহীন ইমু পাখি কিংবা চরম অলস কোয়ালা, এক অনন্য জীববৈচিত্র্য নিয়ে গঠিত অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের সাথে এর সাদৃশ্যের চেয়ে অসাদৃশ্যের পরিমাণ বেশি। স্মরণাতীতকাল থেকে সেই অনন্য জীববৈচিত্র্য ছিল মানুষের নিকট অজানা। অন্তত স্বঘোষিত সভ্য মানুষের নিকট। কিন্তু ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুক পৃথিবীর সামনে সেই অজানার অস্তিত্ব তুলে ধরেন। তারপর থেকে শুরু হয় অস্ট্রেলিয়ার অনন্য জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের নিমিত্তে সভ্য মানুষের মহা কর্মযজ্ঞ। আর সেই ধ্বংসযজ্ঞের পরিক্রমা অদ্যাবধি বিদ্যমান।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্যাপ্টেন কুকের আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে অস্ট্রেলিয়ায় আগত ইউরোপীয় উপনিবেশিকরা যে পরিকল্পিতভাবে ঐ দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করতে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা কিন্তু নয়। বরং তাদের অদূরদর্শিতা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে অবহেলার দরুন ঐ জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে পড়েছে। সেই অদূরদর্শিতা ও অবহেলার অন্যতম বড় নিদর্শন হলো আক্রমণকারী প্রজাতি হিসেবে ইউরোপীয় খরগোশের (Oryctolagus Cuniculus) আমদানি। কিন্তু খরগোশের মতো কোমল, দৃষ্টিনন্দন ও শান্তশিষ্ট প্রাণীর আমদানি কীভাবে অস্ট্রেলিয়ার মতো বৃহদাকায় দ্বীপের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলে দিলো? এই প্রবন্ধে সংক্ষিপ্তসারে আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।
খরগোশের আগমন
অস্ট্রেলিয়ার বুকে সর্বপ্রথম খরগোশ আনা হয় ১৭৮৮ সালে। সে বছর খামার স্থাপনের জন্য নবাগত ইউরোপীয় উপনিবেশিকরা কয়েকটি জাহাজ ভর্তি করে বিভিন্ন প্রজাতির গবাদি পশু অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসে। ফার্স্ট ফ্লিট নামে পরিচিত সেই বহরের সাথে করেই হাতে গোনা কয়েকটি খরগোশ আনা হয়। তবে সেই খরগোশগুলো ছিল গৃহপালিত। এমনকি পরবর্তী কয়েক দশক ধরে অস্ট্রেলিয়ায় যত খরগোশ আনা হয় তার সবই ছিল গৃহপালিত। এছাড়া ১৮২৭ সালে তাসমানিয়া দ্বীপে কিছু বন্য খরগোশ অবমুক্ত করা হয়েছিল। তবে অস্ট্রেলিয়ার জীববৈচিত্র্য কিংবা সেখানে বসবাসরত উপনিবেশিকদের জন্য এরা কোনো ক্ষতির কারণ হয়নি। আসল ঘটনাটি ঘটে ১৮৫৯ সালে, যখন থমাস অস্টিন নামে এক জমিদারের হাত ধরে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় খরগোশ আগমন করে।
অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগে থমাস অস্টিন একজন নামকরা জমিদার ও বসতি স্থাপনকারী ছিলেন। ভিক্টোরিয়া রাজ্যের জিলং শহরের নিকটবর্তী বারওন পার্কে তার বিশাল জমিদারি ছিল। ১৮৫৯ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ইউরোপ থেকে কিছু খরগোশ আনার। মূলত নিজের জমিদারি এলাকায় ভবিষ্যতে বিনোদন হিসেবে খরগোশ শিকার করার উদ্দেশ্যে তিনি ঐ সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুসারে একই বছর ইংল্যান্ড থেকে মোট ২৪টি ইউরোপীয় খরগোশ আনা হয়। অস্টিন তার জমিদারী এলাকায় এরমধ্য থেকে মোট ১৩টি খরগোশ অবমুক্ত করেন। তবে অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে অন্য একটি মহাদেশ থেকে আগত খরগোশগুলোর বেঁচে থাকা নিয়ে তিনি শংকিত ছিলেন। কিন্তু তার শংকাকে ভুল প্রমাণ করে খরগোশগুলো শুধু বেঁচে থাকেনি, বরং নিজেদের সংখ্যায় বিস্ফোরিত হতে থাকে।
খরগোশের সংখ্যাবৃদ্ধি ও এর কারণ
১৮৫৯ সালে মাত্র ১৩টি খরগোশ ছাড়ার কয়েক বছরের মধ্যে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি মানুষের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ঐ খরগোশগুলোর বংশধরেরা শস্যক্ষেত্রসমূহে কীটপতঙ্গের ন্যায় বিচরণ শুরু করেছিল। ১৮৬৫ সালে শুধু থমাস অস্টিনের জমিদারি এলাকায় ২০,০০০ হাজার খরগোশ শিকার করা হয়। এতদ-সত্ত্বেও খরগোশের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং দিন দিন সেই সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে। ১৮৮০ সালের মধ্যে খরগোশ ভিক্টোরিয়া রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিউ সাউথ ওয়েলসেও প্রবেশ করে। ১৮৮৬ সালে কুইন্সল্যান্ড ও সাউথ অস্ট্রেলিয়া জুড়ে এবং ১৮৯৪ সালের মধ্যেই সুদূর ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আনুপাতিক হারে ক্রমবর্ধমান খরগোশ ১৯২৮ সালের মধ্যে প্রায় ৭৭ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটির এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ার বুকে খরগোশের অতিমাত্রায় সংখ্যা বৃদ্ধির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো এদের প্রজনন ক্ষমতা, অনুকূল পরিবেশ, খাদ্যের প্রাচুর্যতা ও প্রাকৃতিক শিকারির অভাব।
স্তন্যপায়ী প্রাণীসমূহের মধ্যে প্রজননের দিক দিয়ে খরগোশ সবার উপরে। সাধারণত একটি স্ত্রী খরগোশ তার জীবনকালে ৩৬০টিরও অধিক ছানা জন্ম দিতে পারে। এদের গর্ভধারণকাল মাত্র ২৮ থেকে ৩০ দিন এবং প্রতিবারে এরা ৪ থেকে ৬টি ছানার জন্ম দেয়। অন্যদিকে সন্তান জন্ম দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে তারা আবার গর্ভধারণ করতে পারে। এছাড়া একটি খরগোশ জন্মের মাত্র তিন থেকে চার মাস পর প্রজনন কর্মে অংশ নিতে সক্ষম। অন্যদিকে প্রজননের ক্ষেত্রে জলবায়ু বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তবে খরগোশের জন্য সৌভাগ্যক্রমে অস্ট্রেলিয়া হলো খরগোশ বংশবৃদ্ধির আদর্শ জায়গা। ইউরোপে খরগোশ সাধারণত শীতকালে প্রজনন বন্ধ করে দেয়। কারণ খরগোশ ছানা পশম ছাড়া জন্মগ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে ইউরোপের বরফাচ্ছন্ন ঠাণ্ডায় এদের বেঁচে থাকা অসম্ভব। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় সেই চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অস্ট্রেলিয়ার শীতকাল ইউরোপের মতো তীব্র ও মারাত্মক নয়। ফলে খরগোশ সারা বছর প্রজনন চালিয়ে যেতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রজননের অনুকূল পরিবেশ পাওয়ার সাথে সাথে খাদ্য ঘাটতি পূরণেও খরগোশের তেমন বেগ পেতে হয়নি। কারণ ঐ দ্বীপটির বুকে তৃণভূমির অভাব কোনোদিন ছিল না। এছাড়া মানুষের চাষকৃত শস্যক্ষেত্রের ফলে খাদ্য ছিল সর্বত্র। ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন খরগোশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে এদের খাদ্য ঘাটতিও পূরণ হয়েছে। তবে প্রজনন ক্ষমতা, অনুকূল পরিবেশ ও খাদ্যের প্রাচুর্যতার চেয়ে প্রাকৃতিক শিকারির অনুপস্থিতি খরগোশের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। সাধারণত যেকোনো বনের বস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষায় শিকার ও শিকারির সম্পর্ক অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রাকৃতিকভাবে এদের সংখ্যা হ্রাসকারী কোনো শিকারির আবির্ভাব ঘটেনি। তাই খরগোশের সংখ্যা লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি পৃথিবীতে অন্য কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর এত দ্রুত সংখ্যা বিস্তারের নজির নেই।
জাতীয় সমস্যা
ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকেই অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ইউরোপীয় বন্য খরগোশের সংখ্যা এতো বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে থাকে যে তা সাধারণ মানুষ, এমনকি থমাস অস্টিনের মতো জমিদারদের নাগালের বাইরে চলে যায়। আর খরগোশগুলো কীটপতঙ্গের মতো চাষাবাদকৃত জমির ফসল নষ্ট করে যাচ্ছিল। ফলশ্রুতিতে তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ার সরকার খরগোশের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে ১৮৮৩ সালে ‘খরগোশ উপদ্রব আইন’ নামে একটি আইন পাস করে। এই আইন অনুসারে খরগোশ নিধনকল্পে সরকারি কর্তৃপক্ষকে বিনা অনুমতিতে যেকোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে প্রবেশের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এছাড়া সাধারণ মানুষদের উদ্বুদ্ধকরণে সরকার খরগোশ শিকারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। তবে কোনোকিছুতেই কোনো লাভ হয়নি। বরং ১৮৮৩ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত পুরস্কারের অর্থ বাবদ অস্ট্রেলিয়ার সরকারের পকেট থেকে প্রায় ৭৫ লক্ষ ডলার গচ্চা যায়।
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার অতি শুষ্ক ও অনুর্বর মরু অঞ্চল ছাড়া সবখানেই খরগোশের উপস্থিতি ভালভাবে টের পাওয়া যায়। তবে বর্তমানের খরগোশের উপদ্রবের পরিমাণ বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে তুলনামূলক কম। কারণ ১৯৫০ সালে যেখানে খরগোশের সংখ্যা ছিল ৬০ কোটিরও বেশি, সেখানে বর্তমানে সেই সংখ্যা ২০ কোটির কম। কিন্তু আনুপাতিক হারের কথা চিন্তা করলে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের ৬০ কোটি খরগোশের সংখ্যা একবিংশ শতাব্দীতে এসে হাজার কোটিতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। তবে ১৩টি থেকে হাজার কোটিতে পৌঁছাবার সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করেছে মানুষের গৃহীত কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা না হলে বর্তমান সময়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রতি ইঞ্চি মাটি খরগোশের দখলে থাকতো।
প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা
খরগোশের উপদ্রব বৃদ্ধির প্রাথমিক যুগ থেকেই খরগোশ নিধনকল্পে বন্দুক দিয়ে গণহারে হত্যা, মাটির নিচের গর্ত গুড়িয়ে দেওয়া বা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার, ফাঁদ পাতা, বিষ প্রয়োগ ও কুকুর নিয়োজিত করা সহ বিভিন্ন উপায়ে অবলম্বন করা হয়। অন্যদিকে সেই সময় থেকেই কৃষি জমি ও গবাদি পশুর খামারগুলোর তৃণভূমিতে খরগোশের অনুপ্রবেশ রোধে জমির চারিদিকে আলগা পাথরের দেয়াল তৈরির রীতি বেশ প্রচলিত ছিল। কিন্তু খরগোশগুলো এতো রকমের প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ঠিকই মাটি খুঁড়ে কিংবা লাফ দিয়ে সংরক্ষিত এলাকায় অনুপ্রবেশ করতো। এছাড়া ঈগল পাখি, ডিঙ্গো, শেয়াল ও বন্য বিড়াল প্রাকৃতিক শিকারির কাজ করলেও তা খরগোশের সংখ্যার অনুপাতে অতি নগণ্য। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে খরগোশের বিস্তার রোধে প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘ বেড়া নির্মাণ।
বেড়া নির্মাণের হিড়িক
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহে খরগোশের উপদ্রব রীতিমতো মহামারীর আকার ধারণ করে। তবে তখন পর্যন্ত খরগোশের উপদ্রব অস্ট্রেলিয়ার সর্ব পশ্চিমের রাজ্য ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তাই বসে থেকে সময় ক্ষেপণ না করে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য সরকার পরিসংখ্যানবিদ আর্থার মেসনকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার সীমান্তে প্রেরণ করে খরগোশের সংখ্যা ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। মেসন দক্ষিণের সাউথ অস্ট্রেলিয়া ও উত্তরের নর্থান টেরিটরি রাজ্যদ্বয়ের পশ্চিম সীমান্ত বরাবর একাধিক বেড়া নির্মাণের পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ১৯০১ সালে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে নিরবচ্ছিন্ন লোহার জালের বেড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৯০১ সালেখরগোশ প্রতিরোধ বেড়ার নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তী ছয় বছরে নির্মিত ৩,২৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়া তিন ভাগে বিভক্ত। নির্মাণের সময় এই বেড়াগুলো একত্রে পৃথিবীর দীর্ঘতম বেড়া ছিল। এরমধ্যে প্রথমটি ১,৮২২ কিলোমিটার, যা অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার রাজ্যের দক্ষিণ উপকূলের এস্পারেন্স থেকে উত্তর উপকূলের পোর্ট হেডল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর পার্থ থেকে ২৩০ কিলোমিটার পূর্বে বিস্তৃত। তবে যখন বেড়াটির নির্মাণকাজ চলছিল তখন বেশ কিছু সংখ্যক খরগোশ বেড়া দ্বারা সংরক্ষিত এলাকায় অনুপ্রবেশ করে। ফলশ্রুতিতে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য সরকার আরেকটি বেড়া নির্মাণে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় বেড়াটি ১নং খরগোশ প্রতিরোধ বেড়া থেকে পশ্চিমে নির্মাণ করা হয়।
ক্রমানুসারে নামকরণকৃত ২নং খরগোশ প্রতিরোধ বেড়া দক্ষিণ উপকূলের পয়েন্ট আ্যন থেকে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগে গিয়ে ১নং বেড়ার সাথে যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় বেড়াটি ১,১৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। এরপর উপকূলের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য ২৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩নং বেড়াটি নির্মাণ করা হয়। এই বেড়াগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। তবুও এগুলোর নিয়মিত দেখভাল করা হয়। অন্যদিকে এই তিনটি বেড়া নির্মাণের পূর্বে ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে সাউথ অস্ট্রেলিয়া, নিউ সাউথ ওয়েলস ও কুইন্সল্যান্ডে বেশ কিছু খরগোশ প্রতিরোধ বেড়া নির্মাণ করা হয়। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় খরগোশের সংখ্যা এতো বেড়ে যায় যে উক্ত বেড়াগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে।
ভাইরাসের ব্যবহার
খরগোশের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে অস্ট্রেলিয়ার সরকারের গৃহীত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তবে কার্যকারী পদক্ষেপ ছিল জৈবিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে মাইক্সোমা (Myxoma) ভাইরাসের ব্যবহার। ১৯৫০ সালে কমনওয়েলথ সাইন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (CSIRO)-এর সহায়তায় তারা অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মাইক্সোমা ভাইরাসে আক্রান্ত খরগোশ অবমুক্ত করা হয়। এই ভাইরাস আক্রান্তের শরীরে মাইক্সোমাটোসিস (Myxomatosis) নামক প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি করে। তবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, এই ভাইরাস খরগোশ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীর জন্য প্রাণঘাতী নয়। এর ব্যবহারে খরগোশের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফলতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। এমনকি ১৯৫২-৫৩ অর্থ বছরে অস্ট্রেলিয়ায় চারণভূমি সমূহে খরগোশের উপদ্রব কমে আসায় গবাদি পশু খাতের উৎপাদন এক লাফে প্রায় ৭ কোটি ডলার বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরবর্তী তিন দশক যাবত মাইক্সোমা ভাইরাসের দাপট বজায় ছিল। তবে ১৯৮০ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন যে, এই ভাইরাসের প্রভাবে খরগোশের মৃত্যুর হার কমে আসতেছে। কারণ প্রাকৃতিক ভাবেই খরগোশের শরীরে এই ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৮০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা রেবিট হেমোরেজিক ডিজিজ ভাইরাস (Rabbit Hemorrhagic Disease Virus) নিয়ে গবেষণা শুরু করে। মাছিবাহিত এই ভাইরাস ক্যালিসিভাইরাস (Calicivirus) নামেও পরিচিত। এর প্রভাব মাইক্সোমা ভাইরাসের মতোই শুধু খরগোশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর ফলে আক্রান্ত খরগোশের শরীরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করে। এমনকি এই ভাইরাস এতটাই মারাত্মক যে আক্রান্ত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই একটি খরগোশ মারা যেতে পারে। ১৯৯৬ সালে পুরোদমে ক্যালিসিভাইরাসের ব্যবহার শুরু হয়। এরপর এই ভাইরাস অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক অঞ্চলসমূহে খরগোশের সংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। তবে আর্দ্র ও জলাভূমি বহুল অঞ্চলে এর প্রভাব তুলনামূলক কম।
১৯৫০ সালে ‘মাইক্সোমা’ ভাইরাস ব্যবহার শুরুর প্রায় দুই দশক পর বিজ্ঞানী লক্ষ্য করেছিলেন যে খরগোশগুলোর শরীরে এই ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই এই কথা মাথায় রেখে তারা ক্যালিসিভাইরাস নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গেছেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এর নতুন ধরন সংগ্রহ করেছেন। অর্থাৎ মাইক্সোমা ভাইরাসের মতো ক্যালিসিভাইরাস যাতে এর প্রভাব না হারিয়ে ফেলে তাই। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় ভাইরাস ব্যবহারের মাধ্যমে খরগোশ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। খরগোশের উপদ্রবের কারণে বিরানভূমিতে পরিণত হওয়া এলাকার সবুজায়ন সম্ভব হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ভাইরাসের ব্যবহারের সাথে সাথে অন্যান্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালু রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনৈতিক ক্ষতি
একবিংশ শতাব্দীতে এসে কয়েক প্রকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরও খরগোশের উপদ্রবের দরুন অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ কম নয়। তবে এই উপদ্রবের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশটির কৃষিখাত। বর্তমানে প্রতিবছর এই খাতেই ২০ কোটি ডলার সমপরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া গবাদি পশু উৎপাদন খাতও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। কারণ খরগোশগুলো নিজেদের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য ফসলি জমির পাশাপাশি তৃণভূমির উপরও আক্রমণ করে। ফলশ্রুতিতে গবাদি পশুর খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। তবে খরগোশের অত্যধিক উপস্থিতি যে শুধু মানুষ ও তাদের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর তা নয়। বরং অস্ট্রেলিয়ার অনন্য জীববৈচিত্র্যও বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
ভারসাম্যহীন জীববৈচিত্র্য
মানুষের হাত ধরে অস্ট্রেলিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আক্রমণকারী প্রজাতির আগমন ঘটেছে। আক্রমণকারী প্রজাতি বলতে ঐ সকল প্রাণীকে বুঝায় যারা কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থানীয় না হওয়া সত্ত্বেও অন্য আরেকটি অঞ্চল থেকে পরবর্তীতে আগমন করে উক্ত অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছায় কোনো এক অঞ্চলের স্থানীয় প্রাণী অন্য কোনো অঞ্চলে আক্রমণকারী প্রজাতির রূপ লাভ করে। যেমনটি ঘটেছে ইউরোপের স্থানীয় খরগোশের ক্ষেত্রে। গত দেড় শতাব্দীতে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মূল ভূখণ্ডে প্রায় সবখানে খরগোশ পঙ্গপালের ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। এদের উপস্থিতি মাটির উর্বরতায় হেরফেরের মাধ্যমে বনাঞ্চল উজাড় করার সাথে সাথে অসংখ্য স্থানীয় প্রাণীদের বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বসবাসকারী ঐ স্তন্যপায়ী প্রাণী অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে অনবরত গর্ত খোঁড়ার ফলে মাটির উর্বরতা এবং সেই মাটিতে উদ্ভিদ জন্মানোর হার আশংকাজনকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। আর উদ্ভিদ জন্মানোর হার কমে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে সবুজায়নের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভূমি ক্ষয়ের পরিমাণও আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে খরগোশ যে শুধু মাটির উপরে থাকা ঘাস ও লতাপাতা এবং মাটির নিচে থাকা বিভিন্ন শিকড়জাতীয় ফল খায় তা নয়। বরং মাটির নিচে বাসস্থান তৈরির সময় এদের কাঁচির মতো ধারালো দাঁত দিয়ে এরা অনেক বৃহদকায় প্রজাতির বৃক্ষের অসংখ্য চারাগাছের শিকড় কেটে ফেলে। ফলশ্রুতিতে বনাঞ্চলে বৃহদ্বাকায় বৃক্ষের সংখ্যাও কমে এসেছে।
অন্যদিকে অতিমাত্রায় প্রজননরত খরগোশগুলো নিজেদের খাদ্য ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত পরিমাণে ঘাস ও অন্যান্য উদ্ভিদ ভক্ষণ করার ফলে উক্ত বনাঞ্চলের অন্যান্য ক্ষুদ্রকায় তৃণভোজী প্রাণীগুলোর খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্থানীয় লতাপাতা ও গাছপালা বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় মোট ৩০৪টি প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ খরগোশ মহামারীর দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত এবং এর মধ্যে ২৪টি প্রজাতি যেমন, পিগমি পসোম, অরেঞ্জ বেলিড প্যারোট ও বেলারিনা অরচিড বিলুপ্তপ্রায় হিসেবে গণ্য।
খরগোশ মহামারির ব্যতিক্রমী দিক
অস্ট্রেলিয়ায় খরগোশের আগমন যে শুধু ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে এনেছে তা নয়, বরং এর কিছু ব্যতিক্রমী দিকও রয়েছে। যেমন, ১৯৩০-এর দশকজুড়ে চলা মহামন্দার সময় অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ জনগণের প্রধান খাদ্যে পরিণত হয় অফুরন্ত খরগোশের মাংস। ফলশ্রুতিতে মহামন্দার কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে তেমনভাবে করতে হয়নি। এমনকি দুই বিশ্ব যুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়ার সৈন্যদের জন্য কৌটাজাতকৃত খরগোশের মাংস খাদ্য হিসেবে প্রেরণ করা হতো। অর্থাৎ যে খরগোশগুলো দেশের মাটিতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, সেগুলো আবার খাদ্য হয়ে বিদেশের মাটিতে সৈন্যদের জীবন রক্ষা করছিল।
এছাড়া খরগোশ শিকারের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় একটি পেশাদার শ্রেণির সৃষ্টি হয়। যারা অর্থের বিনিময়ে যেকারো জমিতে ও এর আশপাশে অবস্থানরত খরগোশ শিকার করে দিত। বেকারত্ব দূর করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও খরগোশ মহামারীর ভূমিকা রয়েছে। তবে খরগোশের সংখ্যা বিস্তারের সুফলের চেয়ে কুফল কয়েকগুণ বেশি। অস্ট্রেলিয়া আজও খরগোশের উপদ্রব থেকে মুক্ত হয়নি। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে মরনব্যাধী সৃষ্টিকারী ভাইরাস ব্যবহারের মাধ্যমেও এদের সংখ্যা নাগালের মধ্যে আসেনি। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় ২০ কোটিরও বেশি খরগোশের বাস। যা অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার থেকে প্রায় আট গুণ বেশি। তাই বিষয়টি নিশ্চিত যে খরগোশের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার যুদ্ধ আরও অনেকদিন টিকে থাকবে। তবে কতদিন টিকে থাকবে তাই দেখার বিষয়।
শেষ কথা
ইউরোপীয়রা অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের পর উক্ত দ্বীপটিকে নিজেদের বাড়ি তথা ইউরোপের মতো করে সাজাতে চেয়েছিল। সেই লক্ষ্যে তারা চাষাবাদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অস্থানীয় পশু আমদানি করা শুরু করে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া তো ইউরোপ না। অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতির নিজস্ব গতি ও নিয়ম রয়েছে। তবে ইউরোপীয়রা নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সেই দিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ না করে স্বেচ্ছাচারিতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে অস্ট্রেলিয়ায় হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে আজ বিলুপ্তির পথ ধরেছে। তবে স্বেচ্ছাচারিতার এই গল্প শুধু উপনিবেশিক ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নয়। বরং পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতি সমান দোষে দুষ্ট। আর এর ফলাফল একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা হাতেনাতে পেতে শুরু করেছি। তবে এখনো সময় আছে ঘুরে দাঁড়ানোর। সময় আছে আমাদের বাসস্থানটির দীর্ঘ স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করার।