১
আসুন, একটা অদ্ভুত প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। আপনি যে প্রতিদিন সুতির টি-শার্ট পরেন, এরকম একটা টি-শার্ট বানাতে কয় লিটার পানি লাগে জানেন? ভাবুন। প্রশ্নের জবাব একটু পরে দিচ্ছি।
নিত্য ব্যবহার্য পণ্য প্রকৃতির ওপরে কী প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে আমরা আসলে কখনো ভাবতে চাই না। কারণ, এসব নিয়ে ভাবতে গেলে মাথায় এত বেশি চাপ পড়বে যে, জীবন অনেকক্ষেত্রেই অসহনীয় হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রকৃতিকে অস্বীকার করে, যা ইচ্ছে তাই করে তো আর বেশিদিন চলা যাবে না। ভাবছেন, হঠাৎ এসব গুরুগম্ভীর কথা বলছি কেন? কারণটা লুকিয়ে আছে ওপরের প্রশ্নের উত্তরে।
একটি সুতির টি-শার্ট বানাতে প্রায় ২,৭০০ লিটার পানি খরচ হয়। এবারে ভাবুন তো, আপনার এরকম কয়টি টি-শার্ট আছে?
২
আমাদের প্রয়োজনে পৃথিবীর মজুদ প্রাকৃতিক সম্পদ যথেচ্ছ ব্যবহার করছি আমরা। বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট বানানো থেকে শুরু করে কাগজ বানানোর জন্য গাছ কাটতে হয়। কারখানায় নানা ধরনের দ্রব্য বানাতে গিয়ে উৎপন্ন হয় কালো ধোঁয়া বা কার্বন ডাই-অক্সাইড। আর, পানির ব্যবহার তো প্রায় সবখানে। তবে এর মধ্যেও কিছু জিনিস আছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেটা আমাদের জন্য অপরিহার্য। কিছু জিনিস একটু কম দরকারি। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
আমরা আজ মূলত পানির ব্যবহার নিয়েই কথা বলব। সেই সঙ্গে গার্মেন্টস খাতে পানির ভূমিকা ও প্রকৃতিতে এর প্রভাব নিয়ে কথা বলব। উদাহরণটা তাই পানি দিয়েই দেই।
পৃথিবীর মাত্র ১ শতাংশ পানি আমরা ব্যবহার করতে পারি। যাকে বলে ‘মিঠা পানি’। এই মিঠা পানির ৭০ শতাংশ চলে যায় কৃষিকাজের পেছনে। এটা আমাদের জন্য দরকারি। আবার, একটু আগে যে টি-শার্টের কথা বললাম, বানাতে ২,৭০০ লিটার পানি লাগে। এই ২,৭০০ লিটার পানি একজন সাধারণ মানুষ ৯০০ দিন খেতে পারবে। অর্থাৎ একটি টি-শার্ট কম বানানো হলে বেঁচে যাবে একজন মানুষের ৯০০ দিনের খাবার পানি। ব্যাপারটা কি বোঝা যাচ্ছে?
৩
কথা হচ্ছে, এত পানি লাগছে কেন? উত্তরটা সহজ। কটন বা তুলা, এবং এ থেকে বানানো সুতির কাপড় অনেক বেশি পানিগ্রাসী।
কতটা পানিগ্রাসী, তা নিয়ে ২০১৩ সালের একটি গবেষণার তথ্য দেই। সে বছর ভারত যে পরিমাণ তুলো রপ্তানী করেছে, তা দিয়ে ভারতের ১.২৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ মানুষের প্রত্যেকে দিনে ১০০ লিটার করে পানি ব্যবহার করলেও ১ বছর চলতে পারত।
পৃথিবীতে কেজি প্রতি তুলোর জন্য গড়ে ১০,০০০ লিটার পানি খরচ পড়ে!
দেখা গেছে, ভারতে ১ কেজি তুলো উৎপাদনের জন্য খরচ হয় ২২,৫০০ লিটার পানি। তবে কোথাও কোথাও অনেকটা কমও হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন প্রতি কেজি তুলোর পেছনে খরচ হয় ৮,০০০ লিটার পানি। এরচেয়ে কম খরচে আর কোথাও তুলো চাষ হয় না। পুরো পৃথিবীকে ধরে গড় হিসাব করলে তাই কেজি প্রতি ১০,০০০ লিটার পানি খরচ পড়ে।
এটুকু শুধু চাষেই খরচ হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণ, রং করা ইত্যাদির পেছনের হিসেব তো ধরাই হয়নি এখনো! ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের হিসেবে, প্রতিবছর পোশাক শিল্প কারখানায় ওয়াশিং এবং ডায়িং-এর কাজে ১৫শ বিলিয়ন লিটার পানি খরচ হয়!
সেজন্যই টি-শার্টের পেছনে এত পানি লাগে। আর, জিন্স? একটা জিন্সের প্যান্ট বানাতে কতটা পানি লাগে, ভাবতে পারেন? ৭,৬০০ লিটার বা ২,০০০ গ্যালন!
৪
এ তো গেল বৈশ্বিক গড় হিসাব। কিন্তু বাংলাদেশে কী হচ্ছে? অন্যান্য অঞ্চলের কথা বাদ দেই, খোদ ঢাকা শহরের অনেক জায়গাতেই পানি পাওয়া যায় না ঠিক করে। এর পেছনেও কিন্তু গার্মেন্টস খাতে ব্যবহৃত পানির ভূমিকা আছে। স্বাভাবিক। বাংলাদেশে গার্মেন্টস কতটা বিস্তৃত, সেটা আমরা সবাই জানি।
শুধু সুতা ও কাপড় ধোয়া ও রং করার পেছনে বাংলাদেশে প্রতি বছর পানি খরচ হয় ১ কোটি ৫০ লাখ লিটার!
সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে এ ধরনের তথ্য পাওয়া মুশকিল। নিয়মিত এসব নিয়ে গবেষণা করা ও প্রয়োজনে রাশ টেনে ধরার লোক নেই। অনেক খুঁজে অল্প কিছু তথ্য পাওয়া গেল।
২০১৭ সালে দৈনিক যুগান্তর এ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটা পোশাক রং করা ও ধোয়ার কাজে ব্যয় হয় ২৫০ লিটার পানি। এই হিসেবে, শুধু সুতা ও কাপড় ধোয়া ও রং করার পেছনে প্রতি বছর পানি খরচ হয় ১ কোটি ৫০ লাখ লিটার! ওয়াসার হিসেবে প্রতি লিটার পানির সে সময়কার বাজারমূল্য হিসেবে এই পানির দাম পড়ে ৪ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা।
বলাই বাহুল্য, এই পানির সবটুকুই মিঠা পানি হতে হয়। নোনা পানি দিয়ে এ কাজ হয় না। ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের হিসেবে, এ কারণে প্রতি বছর ঢাকার পানির স্তর ২-৩ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে।
২০১৯ সালে এ নিয়ে মহাখালীতে অবস্থিত ব্র্যাক সেন্টারে একটি সেমিনার হয়। সেমিনারের নাম, ‘ভয়েসেস অ্যান্ড সল্যুশন্স : এচিভিং গ্রোথ থ্রো সাসটেইনেবল প্রোডাকশন এন্ড কনসাম্পশন ইন দ্য ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি’। শুধু পানি-ই না, জ্বালানীর ব্যবহার নিয়েও আলোচনা হয় এই সেমিনারে। বিজিএমইএ-র সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম, বিজিএমইএর সে সময় সদ্য নির্বাচিত পরিচালক শরীফ জহির এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সুলতান আহমেদ প্রমুখেরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারের ধারণাপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, ঢাকার পানি সরবরাহের প্রায় ৮২ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানির ওপরে নির্ভরশীল। আর, এই বিপুল চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর পানির স্তর ২-৩ মিটার করে কমে যাচ্ছে। এভাবে কমতে থাকলে ২০৫০ সালের দিকে এটা ১১০-১১৫ মিটারে নেমে যাবে।
৫
জানি, আপনি ভাবছেন, চারপাশে আসলে হচ্ছেটা কী? এরকম ভয়ংকর অবস্থার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? আসলে, পোশাকের প্রয়োজনীয়তা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে কী পরিমাণ পোশাক একটা দেশ তৈরি করতে পারে, এ সংক্রান্ত নির্দেশনা তৈরি করা যেতে পারে। সেটা শুধু আর্থিক লাভের দিকে তাকিয়ে করা যাবে না, অদৃশ্য মূল্যের দিকেও তাকাতে হবে।
গার্মেন্টস খাত থেকে বিশ্বের ২০ শতাংশ বর্জ্য পানি ও ১০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়। কিন্তু এই চড়া মূল্য খালি চোখে দেখা যায় না। সেজন্য এসব হচ্ছে গার্মেন্টস খাতের অদৃশ্য মূল্য।
এছাড়াও, আন্তর্জাতিকভাবে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (WWF) এর সহযোগিতায় দ্য বেটার কটন ইনিশিয়েটিভ ও সি এন্ড এ ফাউন্ডেশনের কটনকানেক্ট নামের দুটি আন্তর্জাতিক সংঘটন তুলা চাষে পানির ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে তুলা চাষের মাত্র ১ শতাংশ প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন করা হয়। তাই এ সমস্যার সমাধান সহসা হবে বলে মনে হচ্ছে না।
৬
ব্যক্তি উদ্যোগে আমরা কি এ নিয়ে কিছু করতে পারি? আসলে, তেমন কিছু করা সম্ভব না। বা, যেটুকু করা সম্ভব, তাতে খুব একটা লাভ হবে না। তবু সাধ্যমতো টুকটাক কিছু তো আমরা করতেই পারি।
যেমন, হাত-মুখ বা প্লেট-গ্লাস ধোয়ার সময় অযথা কল খুলে না রাখা। কাপড় ধোয়ার সময় অপ্রয়োজনে পানি খরচ না করা। বিলাসিতা করে বাড়তি কাপড় কম কেনা। এরকম ছোটখাট কিছু কাজ করতেই পারি আমরা।
আপনি একা একটা টি-শার্ট কম কিনলে হয়তো কিছুই হবে না। কিন্তু দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ২-৩ কোটি মানুষও যদি একটা করে টি-শার্ট কম কেনে…নাহয়, ২-৩ লাখই হলো-সেটাও কিন্তু অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। ৩ লাখ টি-শার্ট কত লিটার পানি বাঁচিয়ে দিতে পারে, সেটা নাহয় আপনিই হিসেব করে নিন!
একদিনেই হয়তো অনেক কিছু হবে না। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি-আমি-আমরা সবাই মিলেই এই দেশ, এই পৃথিবী। নিজে সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও চারপাশের মানুষকে আমরা একটুখানি সচেতন করে তুলতে পারি, তাহলেই বদলে দেয়া যাবে পুরো পৃথিবীটাকে। এই বদলের শুরুটা নাহয় আপনার হাত ধরেই হোক!