ভ্লাদিমির পুতিন; সাবেক কেজিবি গোয়েন্দা অফিসার থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার গল্পের রচয়িতা। শুধু প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেই ক্ষান্ত হননি, রাশিয়ার সুদিন ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি, নিজেকে আরও অনেকগুলো বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট রাখার জন্য আইনগত বৈধতাও দিয়ে ফেলেছেন।
রাশিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে তিনি এমন একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা, যিনি সোভিয়েত আমলের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে ঘোড়ার পিঠে আরোহন করার, অত্যাধুনিক সাবমেরিনে চড়ে সুগভীর সমুদ্রের নিচে যাওয়ার কিংবা শীতের দিনে মাইনাস ডিগ্রি তাপমাত্রায় কনকনে ঠান্ডা পানিতে গোসল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়ার ছবিগুলো ভাইরাল হতে দেখা যায়। সবমিলিয়ে একজন ‘আদর্শ স্ট্রংম্যান’ হওয়ার জন্য যা দরকার, তার সবকিছুই রাশিয়ার এই সুপ্রিম লিডারের মধ্যে আছে।
সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা নাগরিকদের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায় প্রায়ই। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা যখন জনগণের স্বার্থ ভুলে গিয়ে খামখেয়ালিপনার আশ্রয় নেন, রাষ্ট্র যখন হয়ে ওঠে নিপীড়নের হাতিয়ার, তখন শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জনগণের পবিত্র অধিকার– অ্যারিস্টটল হাজার বছর আগেই এই কথা বলে গিয়েছেন। রাশিয়াতে যে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সবাই পছন্দ করেন, বিষয়টি এমনও নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শহরে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল এবং সেগুলোকে নির্মমভাবে দমন করারও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বছর দুয়েক আগে রাশিয়ায় ঘটতে যাচ্ছিল অদ্ভুত এক ঘটনা। মস্কো থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এক ব্যক্তি, তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে উৎখাত করার জন্য নিজ শহর থেকে রওনা হয়েছিলেন। তার দৃষ্টিতে পুতিন ছিল একজন ‘শয়তান’ এবং তার কর্তব্য ছিল ক্রেমলিন থেকে ‘পুতিন দ্য ডেমন’কে উৎখাত করা। সে-সম্পর্কে জানা যাবে আজকে।
যে মানুষটি পুতিনকে উৎখাত করার অদ্ভুত পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, তার সম্পর্কেই প্রথমে জেনে নেয়া যাক। আলেক্সান্ডার গ্যাবিশেভ নামের সেই ব্যক্তির বয়স একান্ন বছর। তিনি যে শহরে থাকেন, সেই ইয়াকুতস্ক রাজধানী মস্কো থেকে প্রায় পাঁচ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। তার নিজ শহরে অবস্থিত ইয়াকুতস্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসের উপর স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি স্বল্পমেয়াদে কিছু পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু একটি দুঃখজনক ঘটনা তার জীবনকে আমূল পাল্টে দেয়। বেশ আকস্মিকভাবেই তার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা তাকে এতটাই আঘাত করে যে, তিনি অত্যধিক শোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সামগ্রিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন তাকে মানসিক চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহ দিলেও তিনি শেষ পর্যন্ত তার মায়ের কথামতো জঙ্গলে ধ্যানে বসার সিদ্ধান্ত নেন।
তিন বছর পর তিনি ধ্যান থেকে ফিরে আসেন এবং নিজেকে ‘যোদ্ধা শামান’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে শুরু করেন। তিনি যে অঞ্চলে বসবাস করতেন সেখানে ‘শামানিজম’ (Shamanism) বেশ জনপ্রিয় একটি বিশ্বাস, যে বিশ্বাসে প্রকৃতির সাথে মানুষের যোগসূত্র স্থাপন করা হয়। রাশিয়ায় এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার শামান রয়েছেন, যাদের একটি আনুষ্ঠানিক সংগঠনও রয়েছে। মূলত যারা শামান হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন, তারা চিকিৎসক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাদের চিকিৎসায় কোনো কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করা হয় না, তারা সবই প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। তারা আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবেও সমাজে সম্মান পেয়ে থাকেন এবং অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চিকিৎসার সমাধানও বাতলে দেন। আলেক্সান্ডার গ্যাবিশেভ যখন ধ্যান থেকে ফিরে এসেছিলেন, তখন তিনি সবার মধ্যে এটি প্রচার করতে শুরু করেন যে পুতিন আসলে ‘শয়তানের প্রতিনিধি’ এবং কোনো রক্তাক্ত সহিংসতা ছাড়াই তাকে ক্রেমলিন থেকে উৎখাত করতে হবে।
আলেক্সান্ডার গ্যাবিশেভের লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে তার বলা কিছু কথার উপর আলোকপাত করা যেতে পারে। ২০১৯ সালের মার্চে তিনি বলেন,
এটি একটা দুর্দান্ত যুদ্ধ হবে। হ্যাঁ, খুব গৌরবময় যুদ্ধ হবে এটি। যুদ্ধের জন্যই জন্ম হয়েছে আমার– আমি মার্শাল আর্টের সবধরনের কৌশল জানি। শুধু এক ঘন্টার কোনো সংঘর্ষ হবে না এটি, পুরো একদিন ধরে চলবে। যদি কেউ একদিন ধরে যুদ্ধ করে, তাহলে পুরো রাশিয়া জেগে উঠবে। তখন আমি আর একা থাকবো না, আমার পেছনে তখন লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেখা যাবে।
মস্কোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার পর তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে শান্তিপূর্ণ উৎখাতের জন্য নতুন পদ্ধতি নিয়ে হাজির হন তিনি। তার ভাষায়,
পুতিনকে উৎখাত করার জন্য হাঁটছি আমি। তার মাথার একটি চুলেরও ক্ষতি হবে না। আসলে কারও শারীরিক ক্ষতি করার কোনো অধিকার আমার নেই– কারণ সেটি পাপ। তাকে শুধু ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে হবে, কোনো সহিংসতা ছাড়াই যেভাবে সম্ভব, ঠিক সেভাবে। সহিংসতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এমনকি শয়তানের বিরুদ্ধেও।
২০১৮ সালের শেষের দিকে একবার তিনি মস্কোর উদ্দেশ্যে বের হন, কিন্তু সেসময়ে তার কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না বলে জানা যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ির আঘাতে প্রিয় কুকুর রেক্স আহত হলে তিনি নিজ শহরে ফিরে আসেন। ২০১৯ সালের মার্চে তিনি পায়ে হেঁটে মস্কো যাওয়ার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা শুরু করেন। প্রায় ছয় মাস ভ্রমণের পর তিনি রাশিয়ার চিতা শহরে উপস্থিত হন, যেখানে পুতিন-বিরোধী আন্দোলন চলছিল। এই ছয় মাসে বেশ কিছু গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে সংবাদ ছাপানো হয় এবং তিনি রাশিয়ার ইন্টারনেট জগতে ‘মিম ম্যাটেরিয়াল’-এ পরিণত হন। চিতা শহরে পা রাখার পর একটি সমাবেশে তাকে ভাষণ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। চার মিনিটের সেই ভাষণে তিনি এমন আইনসভার কথা বলেছিলেন, যেখানে নিজেদের মতো আইন প্রণয়ন করা হবে। সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,
এখন থেকে আর পুতিনের কোনো আদেশ চলবে না। আপনারা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে শুরু করুন। এটাই এখন আইন!
সেপ্টেম্বর মাসে আলেক্সান্ডার গ্যাবিশেভ উলান-উদে শহরে পৌঁছান। সেখানে তখন মেয়র নির্বাচন চলছিল। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইগোর শুতেনকভ প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করেন। নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যেই একজন স্থানীয় ব্যক্তি ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে একটি ট্রাক কেনেন, যাতে করে সেটার মাধ্যমে শামান গ্যাবিশেভ ও তার সমর্থকদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রগুলো বহন করা যায়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ট্রাকটি রেজিস্ট্রেশনে অপারগতা প্রকাশ করে। পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন মানুষ স্থানীয় প্রশাসনকে ট্রাক রেজিস্ট্রেশনের জন্য চাপ দিলে পুলিশ ট্রাক জব্দ করার পাশাপাশি সেই মানুষগুলোকেও গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারের ঘটনার পর স্থানীয় একজন ভিডিও ব্লগার সরকারি নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণকে এক হওয়ার ডাক দেন। তার ডাকে বেশ কিছু মানুষ সাড়া দিয়ে একত্র হয়, কিন্তু রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ডের মাধ্যমে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়।
২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্রামের জন্য বুরিয়াতিয়া ও ইর্কুতস্ক অঞ্চলের সীমান্তে তাঁবু টানান গ্যাবিশেভ ও তার অনুসারীরা। মাঝরাতে কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য তাদের ওখানে হানা দেয় এবং তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বুরিয়াতিয়া অঞ্চলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, গ্যাবিশেভকে তার নিজ শহরেই বিভিন্ন অপরাধের জন্য খোঁজা হচ্ছিল। এরপর সরকারি কর্মকর্তারা তাকে একটি প্লেনে করে ইয়াকুতুস্ক শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য একটি নিউরো-সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রাশিয়ার আরেকটি দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো দাবি করে, গ্যাবিশেভ মানসিকভাবে সুস্থ এবং তাকে মত প্রকাশের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়।
শান্তিপূর্ণভাবে পুতিনকে উৎখাত করার জন্য মস্কোর উদ্দেশ্য ২০১৯ সালের মার্চে গ্যাবিশেভ যে যাত্রা শুরু করেন, তা সেপ্টেম্বরেই শেষ হয়ে যায়। আসলে এরকম অদ্ভুত উৎখাত পরিকল্পনার জন্য তিনি কোনো জাতীয় সমর্থন লাভ করতে পারেননি, উল্টো তাকে নিয়ে ইন্টারনেট জগতে ব্যাপক হাস্যরস শুরু হয়। মিডিয়ার কল্যাণে তিনি বেশ পরিচিতি লাভ করেন বটে। রাশিয়ায় পুতিনের সমর্থকদের একটি বড় অংশের বসবাস শহর থেকে দূরবর্তী গ্রামগুলোতে, যেখানে গ্যাবিশেভদের মতো শামানদের খুবই শ্রদ্ধা করা হয়।
পুতিনের প্রশাসন চায়নি গ্যাবিশেভ মস্কো পর্যন্ত এসে বাড়তি কোনো ঝামেলা শুরু হোক। তাই তার যাত্রা শুরু হওয়ার পর গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে যখন কিছু সমর্থন তিনি লাভ করেন, তখন তাকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারের পতন ঘটানোর এরকম অদ্ভুত পরিকল্পনায় মানুষ যে বেশ মজা পেয়েছিল তা তো না বললেও চলে!