টোকিও অলিম্পিকের পদক তৈরি হবে ই-বর্জ্য থেকে

প্রাচীন গ্রীসে অলিম্পিক গেমস যখন শুরু হয়েছিল তখন বিজয়ীদের মাথায় পরিয়ে দেওয়া হতো জলপাই গাছের পাতা আর কাণ্ডে নির্মিত জয়মাল্য। এই জয়মাল্য ছিল বীরত্বের প্রতীক।

১৮৯৬ সালে যখন আধুনিক অলিম্পিক শুরু হয় তখন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদেরকে পদক দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়। তবে তখন প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া ব্যক্তিকে রৌপ্য আর রানার্স-আপ প্রতিযোগীকে দেওয়া হতো তামার পদক। ১৯০৪ সালের অলিম্পিক গেমস থেকে কোনো প্রতিযোগীতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হওয়া প্রতিযোগীদের যথাক্রমে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জের পদক দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়।

প্রাচীন গ্রিসে বিজয়ীদের জয়মাল্য; Image Source: commons.wikimedia.org

বর্তমানে একেকটি অলিম্পিক স্বর্ণপদকে থাকে ৫৫০ গ্রাম রৌপ্য আর ছয় গ্রাম স্বর্ণ। রৌপ্যপদকে থেকে ৫০৯ গ্রাম রৌপ্য এবং ৪১ গ্রাম তামা দিয়ে। সর্বশেষ, ব্রোঞ্জ পদক বানানো হয়ে থাকে তামা, টিন আর দস্তা বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে। 

২০২০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত হবে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক এবং প্যারাঅলিম্পিক। দেশ-বিদেশের হাজারো প্রতিযোগী অংশ নেবে অলিম্পিকের এই আসরে। প্রতিটি প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদের গলায় ঝুলবে বিজয়ের জয়মাল্য। আর এই লক্ষ্যে জাপানের অলিম্পিক গেমস আয়োজন কমিটিকে তৈরি করতে হবে পাঁচ হাজার স্বর্ণ, রৌপ্য আর ব্রোঞ্জ পদক।

কিন্তু এই পদকগুলো সরাসরি নিরেট স্বর্ণ থেকে বানানো হচ্ছে না। বিজয়ীদের গলায় ঝুলবে এমন প্রতিটি পদকই নির্মিত হবে ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য থেকে। হিটাচি, সনি, মিতসুবিশি আর প্যানাসনিক ইত্যাদি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের আতুড়ঘর জাপানে অন্যতম প্রধান সমস্যা ই-বর্জ্য। আর ই-বর্জ্যের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে জনসাধারণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের অপ্রয়োজনীয় ই-বর্জ্য।

ইলেকট্রনিক বর্জ্যের ভেতর, হোক সেটি মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা ছোটোখাটো ক্যালকুলেটর, এদের প্রতিটিতেই থাকে খুব অল্প পরিমাণ স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, টিন, দস্তার মতো ধাতু। তৈরির সময়ই এই ধাতুগুলো থাকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের অভ্যন্তরে। জাপান যেহেতু খনিজ সম্পদে অপ্রতুল তাই জনগণের হাতে জমা থাকা বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিক বর্জ্য সংগ্রহ করে সেখান থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহ করে অলিম্পিকের পদক বানানোর পদক্ষেপ নেয় অলিম্পিক আয়োজকরা।

ইলেকট্রনিক পণ্যগুলোতে থাকে কিছু পরিমাণ স্বর্ণ; Source: TechnoCrazed

পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা ইলেকট্রনিক বর্জ্য। প্রতিদিন নতুন ইলেকট্রনিক পণ্য বাজারে আসার সাথে সাথে গ্রাহকরা পরিত্যাগ করছে পুরোনো পণ্যটি। তৈরি হচ্ছে ইলেকট্রনিক পণ্যের বিশাল জঞ্জাল। এই জঞ্জালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মূল্যবান ধাতুর খনিকে অনেক বিশ্লেষক তাই ‘আরবান মাইন’ বা ‘শহুরে খনি’ নামে অভিহিত করে থাকেন।

তবে এই ই-বর্জ্যে মূল্যবান ধাতুর পাশাপাশি ভারী ধাতুর মতো বিষাক্ত পদার্থও থাকে। ঠিকভাবে এদেরকে আলাদা করতে না পারলে এরা খাদ্যশৃংখলে ঢুকে যেতে পারে এবং ঘটাতে পারে মারাত্মক বিপর্যয়। 

২০১৬ সাল নাগাদ পৃথিবীজুড়ে জমা হয়েছে প্রায় ৪৪.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন ই-বর্জ্য। প্রতি বছর এই বর্জ্যের পরিমাণ ৩-৪ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বর্জ্যের তালিকায় পুরোনো মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে ফ্রিজ, টেলিভিশন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, কম্পিউটার সবই আছে। তাই পৃথিবীর স্বার্থে এদেরকে পুনরায় ব্যবহারের বিকল্প নেই।

জাপানে ই-বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে অলিম্পিকের পদক তৈরির ব্যাপারটি আসলেই অসাধারণ। আর এই কাজে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটি দেশব্যাপী জনগণকে তাদের ঘরে পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয় ই-বর্জ্য জমা দিতে আহ্বান করে।

ঘোষণার এক বছরের মাথায় জমা পড়া ই-বর্জ্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ১৬.৩ কেজি স্বর্ণ। পদক বানাতে যতটুকো স্বর্ণ প্রয়োজন তার অর্ধেকেরও বেশি (৫৪.৫ শতাংশ)-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। রৌপ্য উদঘাটিত হয়েছে ১৮০০ কেজি যা লক্ষ্যমাত্রার ৪৩.৯ শতাংশ। আর ব্রোঞ্জ সংগ্রহ করা হয়েছে ৪১০০ কেজি। যা ইতোমধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে।

ই-বর্জ্য থেকে সংগৃহীত ধাতুর হালনাগাদ পরিমাণ; Image Source: tokyo2020.org

জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল নাগাদ সারাবিশ্বে ই-বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫২ মিলিয়ন টনে। আর ফেলে দেওয়া এই বর্জ্যের মাত্র ২০ শতাংশ পুনরায় ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে ই-বর্জ্য জমা হচ্ছে ল্যান্ডফিল আকারে, বিশাল জায়গাজুড়ে ফেলে দেওয়া ই-বর্জ্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাটি পানি আর পরিবেশ।

খনি খুঁড়ে প্রতি টন আকরিক থেকে যেখানে তিন থেকে চার গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া যায় সেখানে এক টন মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া যায় ৩৫০ গ্রাম স্বর্ণ। এই বাস্তবতার কথা চিন্তা করেই জাপানকে নামতে হয়েছে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। তবে ফেলনা জিনিস থেকে অলিম্পিক মেডেল তৈরির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকের ৩০ শতাংশ রৌপ্য এসেছিল ফেলে দেওয়া আয়না থেকে। আয়নার পেছনে রূপার যে প্রলেপ দেওয়া হয় সেখান থেকেই রৌপ্য উদ্ধার করা হয়েছিল।

টাকশালের বর্জ্য থেকে এসেছিল ব্রোঞ্জ মেডেলের ৪০ শতাংশ তামা। ২০১০ সালের ভ্যাংকুভার অলিম্পিকের মেডেলেও ছিল ১.৫ শতাংশ পুনব্যবহৃত ধাতু। তবে ২০২০ সালের জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক ছাড়িয়ে যাবে সব রেকর্ড। প্রতিযোগীদেরকে দেওয়া মেডেলে যে ধাতু ব্যবহার হবে তার সম্পূর্ণটাই আসবে ই-বর্জ্য থেকে।

অনেক বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে ২০১৮ সালের জুন নাগাদ ৪.৩২ মিলিয়ন ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সংগ্রহ করা হয়েছিল জাপানের অধিবাসীদের কাছ থেকে। অব্যবহৃত ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদি দানে উদ্বুদ্ধ করতে দেশব্যাপী চালানো হয় ক্যাম্পেইন, নির্মাণ করা হয় ভিডিওচিত্র। টোকিও অলিম্পিকের পদক নির্মাণের কাজে সহায়তার আহ্বানে জাপানজুড়ে বেশ ভালো সাড়া জাগে। ই-বর্জ্যের ব্যাপারে তৈরি হয়েছে সচেতনতাও।

জাপানের স্কুলগুলোতে চালানো হয়েছে ক্যাম্পেইন, তৈরি করা হয়েছে সচেতনতা; Image Source: tokyo2020.org

স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনগুলোও এই প্রকল্পে অংশ নিয়েছে। তারা সংগ্রহ করেছে ৩৮ হাজার ৫৭৯ টন বর্জ্য। এর মধ্যে আছে ছোটখাটো ইলেকট্রনিক বর্জ্য পণ্য থেকে মোবাইল ফোন পর্যন্ত।

তবে এখন পর্যন্ত যা ই-বর্জ্য সংগৃহীত হয়েছে তা জাপানের বার্ষিক ই-বর্জ্যের মাত্র তিন শতাংশ। তবে ই-বর্জ্য থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ আহরণের পরে বাকি অধাতব অংশ দিয়ে কী করা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মূল্যবান ধাতু সংগ্রহের পর অধাতব অংশ যদি আবারো ফেলে দেওয়া হয় তাহলে তা আবারো পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। তাই অধাতব অংশ বিশেষ করে প্লাস্টিককে আবারো ব্যবহার উপযোগী করে তোলাও জরুরী। 

টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এই বিপুল কর্মযজ্ঞে তাদের সহযোগীদের কাছ থেকে তারা স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জের সরবরাহ নিচ্ছেন। অধাতব অংশ সাধারণভাবেই প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে বলেও জানানো হয়। মোট ছয়টি ধাপে কাজগুলো করা হচ্ছে। আগ্রহী দাতাদের কাছ থেকে মোবাইল সংগ্রহের কাজ করছে জাপানি টেলিকম কোম্পানি ‘এনটিটি ডোকোমো’। ছোট বড় গৃহস্থালী ইলেকট্রনিক পণ্য সংগ্রহ করছে জাপানের বিভিন্ন মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ। 

এনটিটি ডোকোমোর কর্মী মোবাইল সংগ্রহ করছেন; Image Source: tokyo2020.org

সংগ্রহের পর যাছাই বাছাই করার কাজটি শুরু হয়। দক্ষ কর্মীরা বাছাই করে আলাদা করেন কোন মোবাইলগুলো থেকে ধাতু ব্যবহার করা যাবে পদক তৈরির কাজে। 

চলছে যাচাই বাছাই; Image Source: tokyo2020.org

যাছাই বাছাই শেষ হবার পর এদেরকে ভেঙ্গে ফেলার পালা। মোবাইলকে ভেঙ্গে এর ভেতর থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য কিংবা অন্য মূল্যবান ধাতুর প্রলেপ বের করে আনা হয়। 

ভেঙ্গেচুরে মূল্যবান ধাতু আলাদা করা হচ্ছে; Image Source: tokyo2020.org

প্রতিটি মোবাইল কিংবা ইলেকট্রনি পণ্য থেকে খুব সামান্য পরিমাণ মূল্যবান ধাতব উপাদান পাওয়া যায়। এক ধাতুর সাথে মিশ্রিত থাকে আরেক ধাতু। বিশাল চুল্লিতে ফেলে অপদ্রব্য দূর করে কাজে লাগানোর উপযোগী করে নেওয়া হয় এদেরকে। 

চুল্লিতে ফেলে অপদ্রব্য দূর করা হচ্ছে; Image Source: tokyo2020.org
পরিশোধনের পর পদক তৈরির উপযোগী স্বর্ণ; Image Source: tokyo2020.org

অপদ্রব্য দূর করতে বেশ কয়েক ধাপে পরিশোধন করা হয়। সর্বশেষ পরিশোধনের পর পাওয়া যায় পদক তৈরির উপযোগী খাঁটি স্বর্ণ। প্রায় একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রৌপ্য, তামা এবং টিনও আলাদা করে হয়ে থাকে। এবং এদের নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে তৈরি করা হয় পদক। টোকিও অলিম্পিকের আয়োজকদের প্রত্যাশা, ই-বর্জ্য থেকে তৈরি এই স্বর্ণ, রৌপ্য আর ব্রোঞ্জের পদক গলায় ঝুলিয়েই অলিম্পিকে বিজয়ীরা সারা পৃথিবীর কাজে বর্জ্য পুনঃব্যবহারের গুরুত্ব সবার কাছে ছড়িয়ে দেবেন।

This article is about how Japan is turning obsolete electronics into Olympic and Paralympic medals.

Feature Image credit: recupel.be

Related Articles

Exit mobile version