একটি দেশের জন্য স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর এমন একটি দিনে যদি সেই দেশ নিজের স্বদেশী নাম ফিরে পায়, তাহলে এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। ঔপনিবেশিক নাম বাদ দিয়ে স্বদেশী নামে নিজের দেশকে ডাকতে পারার ব্যাপারটাও বেশ শান্তির। সম্প্রতি এরকমই একটি ঘটনা ঘটলো আফ্রিকা মহাদেশের ছোট্ট একটি দেশ সোয়াজিল্যান্ডে। গত বছরের এপ্রিলের ১৯ তারিখ এই দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের আবহটাই ছিল বেশ উৎসবমুখর ও জাঁকজমক। তার উপর সেখানে উপস্থিত সবাই একটি অকল্পনীয় ঘোষণাও শুনতে পান।
ঘোষণাটি দেন সোয়াজিল্যান্ডের বর্তমান রাজা তৃতীয় এমসোয়াতি। সোয়াজিল্যান্ডের নতুন নাম হবে ‘ইসোয়াতিনি’। পুরো নাম ‘দ্য কিংডম অব ইসোয়াতিনি’। যার অর্থ সোয়াজিদের ভূমি। সত্যিকার অর্থে, ৬ সেপ্টেম্বর ইসোয়াতিনির স্বাধীনতা দিবস হলেও বর্তমান রাজা চান তার নিজের জন্মদিনে দেশটির স্বাধীনতা দিবস পালন করা হোক। তাই ১৯ এপ্রিল এই দিবস পালিত হয় যেখানে ভাষণ দেওয়ার সময় হঠাৎ করে এমসোয়াতির দেশের নাম পরিবর্তনের বক্তব্য অনেকই বুঝতে পারেননি। বিশেষ করে অনুষ্ঠানটিতে থাকা বিদেশি সাংবাদিক ও অতিথিদের জন্য তার বক্তব্য বোধগম্য ছিল না।
তবে তা অনুবাদ করা মাত্রই সকলের নিকট সংবাদটি সমাদৃত হয়। এ সময় ‘হাও ড্যার শি’ ট্র্যাভেল ব্লগের আমেরিকান লেখিকা জেসিকা ইলিয়ট সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার মতে, অনুবাদ শুনে সেখানে থাকা মানুষজন অবাক হলেও পদক্ষেপটিকে সবাই সাদরেই গ্রহণ করে। এই দিনে জিগস থর্নও সেখানে ছিলেন। তার জন্ম ইসোয়াতিনিতে এবং তিনি দেশটির একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান ‘বাশফায়ার মিউজিক ফেস্টিভ্যাল’ এরও উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, কোনো দেশের নাম পরিবর্তন হয়ে যাওয়া সাধারণ কোনো ব্যাপার না। এই পরিবর্তন আমাদের উৎসবে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে এরকম নাম বদলি তাদের ঐতিহ্য ও পরিচয় সবার নিকট তুলে ধরতে সহায়তা করবে। অনেকেই এই উৎসবকে শুধুমাত্র মিউজিক কনসার্ট হিসেবেই দেখেন। এছাড়া এ সম্পর্কে কারো কোনো ধারণাই নেই।
রাজা তৃতীয় এমসোয়াতির ঘোষণা হঠাৎ করে হলেও তা কোনোভাবেই অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ তিনি অনেক বছর ধরেই সোয়াজিল্যান্ডের ঔপনিবেশিক নামটি পরিবর্তন করে স্বদেশী নাম দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ২০১৪ সালে দেশটির প্রাদেশিক পার্লামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সোয়াজিল্যান্ডের নাম পরিবর্তনের কথা বলেন।
এমনকি ২০১৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ‘ইসোয়াতিনি’ নামটি উল্লেখ করে নাম পরিবর্তনের বিষয়টি ব্যাখা করেন। এই নতুন নাম রাখার স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে ‘সোয়াজিল্যান্ড’ নাম থাকার নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলেন। তিনি বলেন, বিশ্বের যেকোনো দেশে গেলেই আমাদেরকে প্রায়ই ভুলবশত সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা বলে মনে করা হয়। অনেক সময় তাদেরকে পরিচয় সংকটেও পড়তে হয়। এজন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
আপাত দৃষ্টিতে যদিও মনে হচ্ছে যে, এমসোয়াতি কাজটি ভালোই করেছেন, তবে অনেকে এই বিষয়ে দ্বিমতও পোষণ করছেন। সমালোচকদের মতে, একটি দেশের নাম পরিবর্তন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একাকী গ্রহণ করা একদমই ঠিক নয়। তার উচিত ছিলো বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ করে সাংবিধানিক উপায়ে পদক্ষেপটি গ্রহণ করা। সাধারণ জনগণের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা যায়। আফ্রিকার এই ছোট্ট দেশটিতে অরাজকতা ও ঝামেলার শেষ নেই। দিন দিন অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। এসব প্রয়োজনীয় ব্যাপার বাদ দিয়ে দেশের নাম পরিবর্তন করে বিশ্ব মিডিয়াকে আকর্ষণ করার বিষয়টি অনেকেই আড়চোখে দেখছেন।
উল্লেখ্য, বিশ্বে এইচআইভি রোগীর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এই ইসোয়াতিনিতে। ১.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটিতে এইচআইভি রোগী প্রায় ২,১০,০০০ জন। লিঙ্গ বৈষম্য, বিভিন্ন অধিকার থেকে দেশবাসীকে বঞ্চিত করা খুব সাধারণ ব্যাপার দেশটিতে। এমনকি দেশের অভ্যন্তরীণ অরাজকতা বিশ্ববাসীর নিকট যেন না পৌঁছে সেজন্য সংবাদ মাধ্যমগুলোকে জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। তবে বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন দেশটিতে বাড়তি চাপ প্রয়োগ করছে এসব সমস্যা সমাধান করার জন্য। অনেকের মতে, হয়তো এসব বিশৃঙ্খলার খবর সামাল দিতেই এই ঘোষণা। তবে নাম পরিবর্তনের বিষয়টা যে আসলেই ব্যতিক্রমী এবং ভালো তা মানতেই হবে।
সোয়াজিল্যান্ড তথা ইসোয়াতিনি ৬,৭০৪ বর্গমাইলের ছোট একটি দেশ। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে দেশটি ভ্রমণের জন্য বেশ চমৎকার। এখানে প্রধান দুটি শহর রয়েছে। একটি হলো এমবাবানে; যা দেশটির রাজধানী। আর মানজিনি দেশটির বৃহত্তম শহর। সবাই বেশ আরাম-আয়েশ এবং নিজেদের মতো করেই চলাফেরা করার সুযোগ পায়।
না কোনো ঝগড়াঝাটি, না কোনো ঝামেলা, আর না কোনো অশান্তি। ইসোয়াতিনির অধিবাসীরা অত্যন্ত ভদ্র এবং শান্তিপ্রিয়। থাকার জন্য প্রকৃতি প্রদত্ত উপাদানের যেমন অভাব নেই, তেমনি সাধারণ জনগণও বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে কোনো ত্রুটি রাখে নাই। ইসোয়াতিনিতে ঘুরতে আসা যেকোনো পর্যটকই এই বিষয়টি লক্ষ্য করতে পারেন।
ইসোয়াতিনির জনগণ সিসোয়াতি ও ইংরেজি দুই ভাষাই কথা বলেন। তবে অভ্যর্থনা ও বিদায় জানাতে সিসোয়াতি ভাষারই প্রয়োগ করা হয়। রাস্তায় দেখা হওয়া কোনো অজানা, এমনকি ভিনদেশীকেও তারা অভ্যর্থনা জানান। কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে, এতে কারো প্রতি সম্মান ও বিনয় প্রকাশ করা যায়। আর সবার মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার ছাড়াও তাদের অনন্য সংস্কৃতি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া, সম্মান করা এবং বিশ্বের সামনে সেগুলো তুলে ধরাকে তারা তাদের দায়িত্ব বলে মনে করেন। তারা ‘লিসোয়াতি’ তথা সোয়াজির একজন বাসিন্দা হিসেবে জন্ম নিয়ে গর্ব বোধ করে। তাই তারা এই বিষয়টি জাঁকজমকভাবে পালন করে। ‘ইনকানা’ ইসোয়াতিনির জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবগুলোর একটি। শত শত বছর ধরে চলে আসছে এই অনুষ্ঠানটি। অনেক সময় ইনকানার বলতে প্রথম ফলের উৎসবকে বোঝানো হয়। অর্থাৎ এক মৌসুমে নতুন ফল ফলার পর তা খেয়ে দেখার উৎসব। শাব্দিক অর্থে এরকম মনে হলেও এটি পুরো উৎসব না, বরং অনুষ্ঠানটির একটি অংশ মাত্র।
এটি উদযাপিত হয় ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কিংবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। সময়টা সোয়াজি অধিবাসীরা তাদের বংশগত ও ঐতিহ্যবাহী পঞ্জিকা দেখে ঠিক করে থাকেন। একেবারে সাংস্কৃতিক সাজসজ্জা ও উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রায় সবাই এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানটি রাজকীয়ভাবে পালন করা হয়। শুদ্ধি ক্রিয়াও করা হয়। সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা ‘রেগালিয়া’ তথা রাজ্যাভিষেকে ব্যবহৃত বিশেষ পোশাক পরে আসেন। পর্যটকেরা দেখার সুযোগ পেলেও এতে অংশগ্রহণের সুযোগ পান না। তাছাড়া উৎসবের প্রতিটি পর্বের ছবি তোলারও অনুমতি নেই। তবুও অনেক ভিনদেশী ইসোয়াতিনিতে এই ইনকানা উৎসব দেখতে আসেন।
ইসোয়াতিনির অন্য একটি উৎসব হলো ‘দ্য রিড ডান্স‘। দেশটির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর দেখার জন্য এটা সবচাইতে ভালো। তাছাড়া এই উৎসবে ইনকানার মতো পর্যটকদের জন্য এত বেশি নিয়মকানুন আর ঝামেলাও নাই। আট দিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানে ছোট ছোট মেয়ে এবং কিশোরীরা বেণুবাঁশ বা নলখাগড়া কেটে ‘ইন্দলোভুকাজি’ উপহার দেয়।
সোয়াজিবাসীর রাণী মা হলেন এই ইন্দলোভুকাজি। রিড ডান্সে অংশ নেয় প্রায় ৪০,০০০ মেয়ে। তারা রঙিন ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এই নাচে অংশ নেয় এবং সাথে নিজেদের মাতৃভাষা তথা সিসোয়াতি ভাষায় গানও গায়। দ্য রিড ডান্স শুধুমাত্র ইসোয়াতিরই না, বরং পুরো আফ্রিকার সবচেয়ে জাঁকজমক সাংস্কৃতিক উৎসব।
যে দেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হলো তার নিজস্ব ঐতিহ্য, সেই দেশের নামটাও একদম স্বদেশী হবে এটাই সবার প্রত্যাশা। আর এই আশাই পূরণ হলো এত বছর পরে। যত কষ্ট-দুঃখ কিংবা ঝামেলা থাকুক না কেন, ইসোয়াতিনির জনগণ সবসময়ই হাসিখুশি থাকতে ভালবাসেন এবং বন্ধুসুলভ আচরণ করেন। আর নাম পরিবর্তনের বিষয়টির উদ্দেশ্য যাই হোক তা যে এই ইসোয়াতিনির সহজ-সরল মানুষকে বিশ্ববাসীর সামনে পরিচয় করে দিয়েছে এটাই বেশ।