নবজাতকের নাম যখন আরিয়া, খালিসি কিংবা উইন্টার!

 

 

 

 

ক্যাথরিন আকোস্তা থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে। ২০১৭ সালে গর্ভপাত হয় তার। শরীর এতটাই ভেঙে পড়ে যে, চিকিৎসকেরা তাকে সম্পূর্ণ বেড-রেস্টের পরামর্শ দেন। সারাটা দিন কি আর কারো বিছানায় শুয়ে থাকতে ভালো লাগে! তাই একঘেয়েমি কাটাতে প্রথমবারের মতো তুমুল আলোচিত টিভি সিরিজ গেম অব থ্রোন্স দেখতে শুরু করে দেন তিনি। এবং মাত্র এক সপ্তাহের ভেতরই, তখন পর্যন্ত প্রচারিত সাতটি সিজনই দেখা শেষ হয়ে যায় তার। সিরিজটি তার এতটাই ভালো লাগে যে, পরবর্তীতে আরো দু’বার সবগুলো এপিসোডই দেখেন তিনি।

এরপর আবার যখন ক্যাথরিন গর্ভধারণ করলেন, তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, কী হতে চলেছে তার মেয়ের নাম। খালিসি! হ্যাঁ, জর্জ আর আর মার্টিনের কল্পনাপ্রসূত ডোথরাকি ভাষার এই শব্দটিকেই তিনি অনাগত মেয়ের নাম হিসেবে নির্বাচন করেন, যার অর্থ রানী। এটি গেম অব থ্রোন্স সিরিজের অন্যতম প্রধান চরিত্র ডেনেরিস টারগারিয়েনের একটি খেতাবও বটে, যা সে লাভ করেছিল ডোথরাকি যোদ্ধাদের নেতা খাল ড্রোগোকে বিয়ে করার মাধ্যমে।

কেন কন্যাসন্তানের এমন নামকরণের চিন্তা করলেন, সে ব্যাপারে নিজের কাছে খুব যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে ক্যাথরিনের। এই চরিত্রটির মাঝে তিনি আদতে নিজেরই মিল খুঁজে পান। কারণ, ঠিক তার মতোই, খালিসিও তার সন্তানকে হারিয়েছিল, এবং তারপর আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল সে। সকল প্রতিবন্ধকতাকে সে জয় করতে সমর্থ হয়েছিল, এবং সে কী চায়, সে ব্যাপারেও তার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল।

ক্যাথরিনের শিশুকন্যা খালিসি; Image Source: The New York Times

ক্যাথরিনের নিজের মেয়ে খালিসিও কিন্তু জীবনের একেবারে সূচনাতেই খুবই কঠিন কিছু প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছে। নির্ধারিত সময়ের দু’ মাস আগেই পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে তার, অপরিণত শিশু হিসেবে। আর তাই টানা দুই সপ্তাহ তাকে হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।

এদিকে যে হাসপাতালে খালিসির চিকিৎসা চলছিল, সেখানেই কাজ করত আরেক নার্স, যে তার কন্যা সন্তানের নাম ‘আরিয়া’ রাখার চিন্তাভাবনা করছিল। আরিয়া হলো গেম অব থ্রোন্সের আরেক জনপ্রিয়, কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র।

এতটুকু পড়ে এসে গোটা বিষয়টিকে যাদের কাছে নিছকই গুটিকতক মানুষের পাগলামি বলে মনে হচ্ছে, এবার তাদের ভুল ভাঙিয়ে দেয়ার সময় হয়েছে। ২০১১ সালে এইচবিওতে যখন গেম অব থ্রোন্সের প্রিমিয়ার হয়, তার আগ পর্যন্ত খালিসি ছিল একদমই অজানা, অপরিচিত একটি শব্দ। অথচ সেটিই মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে পর্দা ছেড়ে বাস্তব জীবনের নিত্য-ব্যবহার্য শব্দের একটিতে পরিণত হয়েছে। সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এক জরিপ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এটি ছিল নবজাতক শিশুকন্যাদের প্রদত্ত ৬৩০তম জনপ্রিয় নাম। এটি জনপ্রিয়তায় এমনকি ‘ব্রিটানি’ বা ‘ব্রিটনি’কেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

সব মিলিয়ে ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৭৬ জন নবজাতক কন্যাশিশুর নাম রাখা হয়েছিল খালিসি। আর খালিসি তথা ড্রাগন কুইনের ভূমিকায় অভিনয় করা এমিলিয়া ক্লার্কের প্রকৃত নামটি দর্শকদেরকে আরো বেশি আকৃষ্ট করেছিল। ২০১০ সালে যেখানে মাত্র ৯২৫ জন এমিলিয়ার জন্ম হয়েছিল, সেখানে ২০১৬ সালে জন্ম হয় ৩,০১৯ জন এমিলিয়ার।

দ্য মাদার অব ড্রাগনস; Image Source: HBO

সাহিত্য বা পর্দার কোনো নারী চরিত্রের নাম বাস্তবজীবনে এতটা জনপ্রিয়তা লাভ সত্যিই অবাক করার মতো বিষয়। কেননা সাহিত্যাঙ্গনের আরো দু’টি খুবই জনপ্রিয় নাম হলো হারমায়োনি (হ্যারি পটার) এবং ক্যাটনিস (হাঙ্গার গেমস), যেগুলো কোনোদিনই কন্যাশিশুর নামকরণের তালিকায় সেরা ১০০০-এর ভেতরও আসতে পারেনি।

খালিসি নামটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের অভিভাবকেরা তাদের কন্যাসন্তানের নামকরণের ক্ষেত্রে খালিসির সাথে আরো কিছু সৃজনশীলতার সংযোজন ঘটাচ্ছেন। ২০১৭ সালে স্কটল্যান্ডে জন্ম নিয়েছে একজন খালিসি-ডেস্টিনি এবং একজন খালিসি-গ্রেস। আর গত বছর (২০১৮) এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে একজন খালিসি-মেরিও।

কিন্তু না, শিশুদের নামকরণের ক্ষেত্রে খালিসিই সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম নয়। এরচেয়েও বেশি জনপ্রিয় নামটি হলো ‘আরিয়া’। অনেকেই দাবি করতে পারেন, ‘আরিয়া’ তো কোনো মৌলিক শব্দ নয়। ভারত, ইরান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় আরিয়া বা প্রায় একই রকম উচ্চারণের কিছু শব্দের ব্যবহার শত শত বছর ধরেই হয়ে আসছে। কিন্তু তাদেরকে এ কথাও মানতেই হবে যে, সন্তানের নাম হিসেবে এ শব্দটি টিভি পর্দায় গেম অব থ্রোন্সের আগমনের পূর্বে কখনোই এত বেশি ব্যবহৃত হয়নি। আর হলেও, তা কেবল পুত্রসন্তানদের নাম হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই ২০১০ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্রে এটি সেরা ১০০০-এর ভেতরও ছিল না। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে কন্যাশিশুদের নামকরণের ক্ষেত্রে এটির জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে থাকে, এবং ২০১৭ সালে এটি জনপ্রিয়তার দিক থেকে ১৩৫তম অবস্থানে পৌঁছে যায়। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রের ২,১৫৬ জন নবজাতক শিশুর নাম রাখা হয়েছিল আরিয়া।

অষ্টম সিজনের পর হয়তো আরো বাড়বে আরিয়ার জনপ্রিয়তা; Image Source: HBO

এমনই একজন আরিয়া নামক কন্যাশিশুর মা হলেন নিউ জার্সির অধিবাসী মেরিনা লিপিনকট। গেম অব থ্রোন্সের পাগল ভক্ত তিনি। প্রতিটি নতুন সিজন আসার আগেই তিনি একবার করে পূর্ববর্তী সিজনগুলোর সব এপিসোড দেখে নিতেন। এছাড়া টিভি পর্দায় এ সিরিজটি আসার আগে মূল বইয়ের সিরিজটিও তিনি পড়েছেন। গেম অব থ্রোন্স তার মনে এতটাই মুগ্ধতা ছড়িয়েছে যে, তার বেবি শাওয়ারও ছিল গেম অব থ্রোন্স থিমে!

“অনেক মানুষই ভাবে, গেম অব থ্রোন্সকে নিয়ে আমার অবসেশনকে আমি অনেক দূর নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমার মেয়ে আরিয়া জানে সে কে, এবং সে কী হতে চায়। সে যা চায়, তা সে পেয়েই ছাড়ে। এতটুকু বাচ্চা একটা মেয়ে সে, তবু কোনোকিছুতেই সে হাল ছেড়ে দেয় না।”

এভাবেই নিজ কন্যা আরিয়ার মাঝে নেড স্টার্কের কনিষ্ঠা কন্যা আরিয়া স্টার্কের ছায়া খুঁজে পাওয়ার কথা জানান মেরিনা।

খালিসি ও আরিয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নবজাতক শিশুদের নাম হিসেবে উল্লেখযোগ্য আরেকটি নাম হলো ডেনেরিস। অবশ্য খালিসির তুলনায় খালিসির প্রকৃত নামটি জনপ্রিয়তায় বেশ পিছিয়েই আছে। এছাড়া কেবল ২০১৭ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছে ২০ জন সানসা, ১১ জন সার্সেই, ৫৫ জন টিরিয়ন এবং ২৩ জন থিয়ন। পোষ্য জীবজন্তুদের নাম হিসেবেও অনেকের প্রথম পছন্দ গেম অব থ্রোন্সের বিভিন্ন চরিত্র। যেমন অনেকেই তার কুকুরের নাম রাখছে জোরাহ, আশা কিংবা টিরিয়ন, আর বিড়ালের নাম লেডি কিংবা ড্রোগো।

গেম অব থ্রোন্সের কারণে কমতে শুরু করেছিল জেইমি নামের জনপ্রিয়তা; Image Source: HBO

তবে সার্বিকভাবে, কন্যাশিশুদের নামকরণে গেম অব থ্রোন্স যতটা প্রভাব ফেলছে, পুত্রশিশুদের নামকরণে ততটা ফেলছে না। বরং একটি উল্লেখযোগ্য বিপরীত প্রভাবের কথা বলা যেতে পারে। জেইমি নামটি সেরা ১০০০-এর ভেতর আছে বটে, কিন্তু গেম অব থ্রোন্সের শুরুর দিকে জেইমি চরিত্রটি নেতিবাচক মনে হওয়ায়, এর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। তবে ২০১৩ সালে যখন জেইমি চরিত্রটি ভিন্নতা লাভ করতে শুরু করে, তখন থেকে আবারো নামটি একটু একটু করে তার হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পাচ্ছে।

এদিকে জন ও রবার্ট বরাবরই ছেলেদের নাম হিসেবে জনপ্রিয় হলেও, সরাসরি গেম অব থ্রোন্স-কেন্দ্রিক পুরুষ চরিত্রগুলির নাম যেমন ব্র্যান, থিয়ন ও জফরির ব্যাপারে দর্শকেদের একধরনের অনীহা রয়েছে। তাই এই নামগুলো সেরা ১০০০-এ প্রবেশ করতে পারেনি।

শেষ করার আগে আরেক হবু বাবা-মায়ের কথা বলা যেতে পারে, যারা কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে তাদের অনাগত কন্যাসন্তানকে অভ্যর্থনা জানাতে চলেছেন। ২০১৯ সালের আগস্টে ক্রিস্টিনা জেটি ও তার স্বামীর ঘর আলো করে একটি কন্যাসন্তানের আবির্ভাব ঘটার কথা রয়েছে, এবং তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেই সন্তানের নাম দেবেন ‘উইন্টার’। এজন্য প্রায়ই তারা একে অন্যকে বলেন,“উইন্টার ইজ কামিং!”

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

উইন্টার ইজ কামিং! Image Source: HBO

This article is in Bengali language. It is about how parents are naming their babies based on the characters from Game of Thrones. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © HBO

Related Articles

Exit mobile version