নাম শুনেই ব্যাপারটা একটু ভৌতিক লাগছে না? ব্যাপারটা আসলে একটু ওরকমই। কল্পনা করুন, কোনো জেলে মাছ ধরছে না, তবুও মাছ শিকার হচ্ছে। তাহলে মাছ ধরছে কারা? যেহেতু মানুষ মাছ ধরছে না, তবে অবশ্যই ভূতে মাছ ধরছে। লোককথা মতে- ভূতের নাকি মাছ অনেক প্রিয়! আর ভাজা মাছ হলে নাকি কথাই নেই!
তবে কি আসলেই সমুদ্রে বিভিন্ন জায়গায় মাছ যে আটকা পড়ছে ঐগুলো কি ভূতেই শিকার করছে? না মানুষ ভূতের রূপে? মাথা গুলিয়ে দেয় একদম। সেই মাছগুলো আসলেই আটকা পড়ছে মানুষ নামক ভূতের জন্যই। মানুষ সেখানে সরাসরি মাছ ধরছে না, তবে মানুষের জন্যই মাছগুলো সেখানে আটকা পড়ছে।
ঘোস্ট ফিশিং জিনিশটা আসলে কী? অনেক সময় সমুদ্রসহ বিভিন্ন জলাশয়ে অনেক ফিশিং গিয়ার হারিয়ে যায়। এই ফিশিং গিয়ার মাছ ধরার যেকোনো সরঞ্জামই হতে পারে, যেমন- বড়শি, জাল ইত্যাদি। যখন এগুলো পানিতে হারিয়ে যায় তখন এগুলো কী করে? এই ফিশিং গিয়ারগুলো দীর্ঘদিন পানিতেই পড়ে থাকে। অনেক সময় এগুলো তলদেশেও চলে যায়। সেখান থেকেই এসব সরঞ্জাম মাছ শিকার করে, যদিও সরঞ্জামগুলোর উপর তখন কোনো মানুষেরই আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন মাছ ধরা পড়ার এই ব্যাপারকেই বলা হয় ঘোস্ট ফিশিং।
এই পরিত্যক্ত ফিশিং গিয়ারগুলো হতে পারে হারানো বা স্বেচ্ছায় ফেলে দেওয়া। যেকোনো জলাশায়েই এগুলো পড়ে থেকে মাছসহ অন্যান্য জলজ জীব শিকার করে। যেকোনো ধরনের বক্স আকৃতির ফাঁদ বা বড়শির মাথা বা জাল এই ঘোস্ট ফিশিংয়ের কাজগুলো করে। এছাড়া সমুদ্রে ফেলে দেওয়া নানা আবর্জনা বা পরিত্যক্ত জিনিসও এসব জলজ প্রাণীকে আটকাতে পারে।
একবার আটকে গেলে আর বের হওয়ার উপায় থাকে না। তখন খাদ্যের অভাবে ঐ প্রাণীটি সেখানেই মারা যায়। বর্তমান বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাত লক্ষ জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে এজন্য। সমুদ্রতীরে প্রতি বছরই লক্ষাধিক মৃত সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন- ডলফিন, তিমি, হাঙর, সীল উদ্ধার করা হয়, যাদের পেটে খাবারের পরিবর্তে অন্যান্য আবর্জনার সাথে বিপুল পরিমাণে পাওয়া যায় এই মাছ ধরার পরিত্যক্ত সরঞ্জাম।
সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য আমরা কী ধরনের সরঞ্জাম ব্যাবহার করি? জাল, বড়শি, লম্বা ধাতব তার, নানা রকম ফাঁদ, মাছের ঝাঁকের অবস্থান জানার জন্য বিভিন্ন ডিভাইস ইত্যাদি। এসব জিনিসকে আমরা অনেক সময় ফেলে দেই বা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় হারিয়ে ফেলি। এ সকল সরঞ্জামকে একত্রে বলা হয় Abandoned, Lost, Discarded Fishing Gear (ALDFG)। বর্তমানে সমুদ্রে যেসব আবর্জনা রয়েছে তার কমপক্ষে দশ শতাংশই হলো এই ALDFG। যতদিন ধরে সমুদ্রে বাণিজ্যিকভাবে মাছ ধরা বৃদ্ধি পেয়েছে, ততদিন ধরেই খুব দ্রুত সাগরে এসবের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে সিন্থেটিক সরঞ্জাম, যেগুলো তুলনামূলক বেশিদিন টিকে থাকে।
প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ছয়শ মেট্রিক টন এই পরিত্যাক্ত মাছ ধরার সরঞ্জাম সাগরে মিশছে। এটা হতে পারে পরিত্যক্ত জাল, যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে সামুদ্রিক পরিবেশের। কোরালের ধ্বংসের অন্যতম কারণ এটি। সমুদ্রের স্বাভাবিক পানি প্রবাহেও বাধা দেয়। এরপরে আছে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ, অনেকটা খাঁচার মতো এগুলো। এগুলো এমনভাবে বানানো হয় যাতে একবার ঢুকলে আর কোনো মাছ বের হতে না পারে। সমুদ্র থেকে একটি বড় পরিমাণ কাঁকড়ার হারিয়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী করা হয় এগুলোকে। সাথে আছে বড়শির লাইন। এক লাইনে প্রচুর বড়শি থাকে। প্রতিবছর এ সকল বড়শিতে আটকা পড়ে প্রচুর ডলফিন, তিমি, কচ্ছপ।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও অনেক সময় সচেতনতার অভাবে এগুলো হারিয়ে যায়। অসাবধানতায় পড়ে গেলে বা ঝড়ে হারিয়ে গেলে জেলেদের আর কিছু করার থাকে না সেখানে। এছাড়াও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় অনেকেই সহজে এগুলো ডাম্পিংয়ের জন্য সরাসরি সাগরে ফেলে দেয়। অনেক সময় এই ধাতব তার বা জালগুলো সমুদ্রের তলদেশে থাকা পাথর, কোরাল, বা ডুবে থাকা অন্য কোনো নৌযান বা ফেলে দেওয়া আবর্জনার সাথে আটকে যায়। তখন এগুলো নিতে না পেরে জেলেরা এগুলো ফেলে যায় এবং গিয়ারগুলো তখন সেখানে একা একাই শিকার করে।
এছাড়া সেখানে যা মাছ আটকা পড়ে সেটি সংখ্যায় অনেক এবং সেখানের মাছের পরিমাণের উপর প্রভাব ফেলে। মাছগুলো সেখানেই মরে পচতে থাকে। পচে যাওয়ায় ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য হয় সেখানে। তখন এগুলো নানা রকম পানিবাহিত রোগের জীবাণুর হোস্ট হয়ে যায় এবং আশেপাশে অর্গানিজমগুলোতে রোগ ছড়ায়। বছরখানেক আগে, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে একটি জাল উদ্ধার করা হয় যেটিতে পাওয়া যায় শতাধিক মৃত সীবার্ড, দুটি হাঙ্গর ও দুশরও বেশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এছাড়া মৃত তিমি, সীল, কাছিম, সীহর্স অহরহ পাওয়া যায় এসব পরিত্যক্ত জালে।
এছাড়া অনেক জলজপ্রাণী বুঝতে না পেরে ওগুলোকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। প্লাস্টিক ও অন্যান্য অপচনশীল পদার্থ দিয়ে তৈরি এসব সামগ্রী হজমও হয় না। ফলে অনেক প্রাণীরই শরীরের ভেতরে এটি ক্ষত সৃষ্টি করে। সেই সাথে গলা ও অন্যান্য অঙ্গে আটকে গিয়ে স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। সমুদ্র থেকে একটি বিশাল পরিমাণ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের অন্যতম কারণ এই ঘোস্ট ফিশিং। মানুষের অজান্তেই এভাবে মানবসৃষ্ট একটি কারণে হারিয়ে যাচ্ছে বহু সামুদ্রিক প্রাণী। শুধু পরিবেশগত দিক থেকেই না, অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এগুলো। মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে মাছের বাজারে। ফলে লোকসান হয় সব পক্ষেরই।
এই ঘোস্ট গিয়ারগুলো সমুদ্রের সবচেয়ে বড় শিকারি। শুধু সংখ্যা দিয়ে নয়, সময় দিয়েও প্রচুর ক্ষতি করে এটি। স্থায়িত্ব বেশি হওয়ায় প্রায় কয়েক যুগ এটি একা একাই সমুদ্রে শিকার করে। তাই আমাদের এর পরিমাণ যত দ্রুত সম্ভব কমানো উচিত। ইতিমধ্যে অনেক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন সমুদ্র থেকে এই হারানো সরঞ্জামগুলো উদ্ধারে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে কাজ করায় অনেক ক্ষেত্রেই তারা সফল হচ্ছে।
প্রশ্ন আসতেই পারে- এর কোনো সমাধান আছে কি? নিশ্চয়ই আছে। যেমন-
- সরাসরি সমুদ্রে ফিশিং গিয়ারগুলো না ফেলা। জেলেদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে তারা তাদের নষ্ট সরঞ্জাম সমুদ্রে ফেলে না আসে। তা যেন তীরে এসে আবার মেরামত করা যায় বা অন্য কোনো কাজে ব্যাবহার করা যায়। স্কটল্যান্ডে একটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে এই কাজটি শুরু করেছে। এছাড়াও নিশ্চিত করতে হবে যে মাছ ধরার সময় কোনো সরঞ্জাম যেন সমুদ্রে হারিয়ে না যায়। এতে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক, উভয়ভাবেই লাভবান হওয়া যাবে। এছাড়া বর্তমানের আবিষ্কৃত Remote Operated Vehicle দিয়েও আমরা সমুদ্র থেকে গিয়ারগুলো তুলে ফেলতে পারি।
- এই ফিশিং গিয়ারগুলো সমুদ্র থেকে উদ্ধারের পর অন্য কাজেও লাগানো যায়। একটা প্রস্তাবনা এসেছিল- যদি কোনো জাল আর ব্যবহারোপযোগী না থাকে, তবে তাদের সেখানেই ব্যাগের মতো বানিয়ে সমুদ্র থেকে অন্যান্য আবর্জনা তুলে আনার কাজে লাগানো। কিন্তু এতে আবার প্রয়োজন হবে জেলেদের সাহায্যের। আর জালগুলোতে প্রচুর ছিদ্র ও গিট থাকায় তা অন্য কাজে লাগানোও ঝামেলা হয়ে যায়। ফলে নতুন পরিকল্পনায় এই সরঞ্জাম পাড়ে নিয়ে গিয়ে মেশিনে একদম কেটে ফেলা হবে, যাতে এগুলো অন্য কাজে লাগানো যায়। যেমন- সুতাগুলো আবার গার্মেন্টসে ফেরত পাঠানো। প্লাস্টিক গলিয়ে অন্য জিনিসপত্র তৈরি করা। এভাবেই আমরা ঘোস্ট ফিশিংয়ের হার কমাতে পারি।
আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের অন্যতম কারণ আমরাই। এই ঘোস্ট ফিশিংয়ের মূলেও রয়েছি আমরা। এটি বন্ধ করতে পারলে হয়তো বা আমরা আরো অনেক প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে আটকাতে পারব। এছাড়া যারা সংখ্যায় খুব কম আছে তাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে।