পূর্ববর্তী পর্বগুলোতে ইউরোমাইদানের ঘটনাবলি এবং ইউরোমাইদানে পশ্চিমা বিশ্বের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ইউরোমাইদানে রাশিয়ার ভূমিকা এবং ইউরোমাইদানের ফলাফল এই পর্বের আলোচ্য বিষয়বস্তু।
ইউরোমাইদানে রাশিয়ার ভূমিকা
ইউরোমাইদান ছিল কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এবং রাশিয়ার মধ্যেকার একটি মৃদু মাত্রার ‘প্রক্সি যুদ্ধ’। এই লড়াইয়ে ইউক্রেনীয় সরকারকে রাশিয়ার প্রক্সি হিসেবে এবং ইউরোমাইদানকে পশ্চিমা বিশ্বের প্রক্সি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু ইউরোমাইদান চলাকালে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো যেভাবে ইউরোমাইদান কর্মীদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত করতে পেরেছে, নানাবিধ কারণে রাশিয়া সেভাবে ইউক্রেনীয় সরকারকে পরিচালিত করতে পারেনি। সেজন্য ইউরোমাইদানের শুরু থেকেই ইউরোমাইদান কর্মীরা সুদৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে নিজেদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছে এবং নিজেদের সমস্ত সামর্থ্যকে ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, কিন্তু ইউক্রেনীয় সরকার প্রতিটি পর্যায়েই প্রস্তুতিহীনতা ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে এবং নিজেদের শক্তিসামর্থ্যকে সঠিকভাবে ইউরোমাইদানের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর ইউরোমাইদান শুরু হয় এবং ২৬ নভেম্বর রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউরোমাইদান সম্পর্কে নিজেদের মনোভাব ব্যক্ত করে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনকে যেকোনো মূল্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছুক এবং এজন্য তারা ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও ‘অবৈধ’ কার্যক্রমে অংশ নেয়ার জন্য ইউক্রেনীয় জনসাধারণের সরকারবিরোধী অংশকে উস্কে দিচ্ছে। অবশ্য তারা এটাও যোগ করে যে, ইউক্রেনের স্বাধীনভাবে যেকোনো অর্থনৈতিক জোটে যোগ দেয়ার অধিকারকে রাশিয়া বরাবরই সমর্থন করে এসেছে, কিন্তু কোনো জোটে যোগদানের পূর্বে ইউক্রেনের উচিত এর অর্থনৈতিক ফলাফল হিসেব করা। সরল ভাষায় বলতে গেলে, রাশিয়া ইঙ্গিত প্রদান করে যে, ইউক্রেন কর্তৃক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তি স্বাক্ষর ইউক্রেনের জন্য অলাভজনক হবে।
২ ডিসেম্বর রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে অনুষ্ঠিত একটি সংবাদ সম্মেলনে ইউরোমাইদানকে একটি ‘পূর্বপরিকল্পিত’ ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, ইউরোমাইদানের সঙ্গে ইউক্রেনীয়–ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কের সংযোগ সামান্যই। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় যে, রাশিয়া ইউরোমাইদানকে পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক ইউক্রেনকে রুশ বলয় থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করছিল। পুতিন ইউরোমাইদানকে ‘বিপ্লব’ নয়, বরং ‘পোগ্রম’ (pogrom) বা ‘সুসংগঠিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
৬ ডিসেম্বর রাশিয়ার সোচিতে পুতিন তদানীন্তন ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রুশ ও ইউক্রেনীয় সরকারের বক্তব্য অনুসারে, এই বৈঠকে তদানীন্তন রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্ক এবং রাশিয়ার মস্কোয় অনুষ্ঠিতব্য রুশ–ইউক্রেনীয় আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিশনের বৈঠক বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ইউরোমাইদান ও তাদের পশ্চিমা সমর্থকরা ধারণা করে যে, এই বৈঠকে ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনকে ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের (বর্তমানে ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন) কাস্টমস ইউনিয়নে যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর ফলে ইউরোমাইদান কর্মীরা আন্দোলনের মাত্রা আরো তীব্র করে তোলে।
১৩ ডিসেম্বর তদানীন্তন রুশ উপ–পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক্সেই মেশকভ মন্তব্য করেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ হস্তক্ষেপ করবে না এবং ইউক্রেনকে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দেবে। তিনি যোগ করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও অনুরূপ অবস্থান গ্রহণ করা উচিত এবং ইউক্রেনের ‘অভ্যন্তরীণ’ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
১৪ ডিসেম্বর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ইউক্রেনে সৃষ্ট সঙ্কটের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দায়ী করেন। তিনি মন্তব্য করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনীয় সরকারের ওপর জোরপূর্বক তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে এবং এই উদ্দেশ্যেই তারা ইউরোমাইদানের আয়োজন করেছে। তিনি যোগ করেন, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায় যেটির সঙ্গেই যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিক না কেন, রাশিয়া সেটিকে সমর্থন করবে, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে নিজেদের বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ইউক্রেনীয় সরকারকে চাপ দিচ্ছে। ইউরোমাইদান নেতা ভিতালি ক্লিচকো লাভরভের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন এবং ইউক্রেনের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে’ হস্তক্ষেপ বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার কাছে দাবি জানান।
১৭ ডিসেম্বর মস্কোয় রুশ–ইউক্রেনীয় আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং পুতিন ও ইয়ানুকোভিচ এই বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন। বৈঠক শেষে পুতিন ঘোষণা করেন যে, ইউক্রেনে চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের বাজেটকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে রাশিয়া তাদের ‘ন্যাশনাল ওয়েলথ ফান্ড’ থেকে ১,৫০০ কোটি (বা ১৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ইউক্রেনকে প্রদান করবে। তিনি যোগ করেন যে, এই সহায়তা প্রদানের বিনিময়ে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর কোনো শর্ত আরোপ করেনি এবং ইউক্রেনের ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের কাস্টমস ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়টি এই বৈঠকে আলোচিত হয়নি।
কিন্তু ইউরোমাইদান নেতা ক্লিচকো এই চুক্তির কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি উক্ত চুক্তির নথিপত্র জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবি জানান এবং দাবি করেন যে, ইউক্রেনের কৌশলগত স্থাপনাগুলো জিম্মি রেখে ইউক্রেনীয় সরকার উক্ত ১,৫০০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা লাভ করেছে। অবশ্য ক্লিচকোর দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ ছিল না। কিন্তু রাশিয়া কর্তৃক প্রদত্ত অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি ইউক্রেনীয় সরকারের তেমন কোনো কাজে আসেনি, কারণ এর ফলে ইউরোমাইদানের মাত্রা স্তিমিত হয়নি। তদুপরি, ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী মিকোলা আজারভের (যাকে রুশপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হতো) পদত্যাগের পর রাশিয়া প্রস্তাবিত আর্থিক সহায়তা প্রদান স্থগিত রাখে।
৪ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন মার্কিন ইউরোপীয় ও ইউরেশীয় বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ভিক্টোরিয়া নাল্যান্ড ও ইউক্রেনে নিযুক্ত তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেফরি পায়াটের মধ্যেকার ফোনালাপের রেকর্ডিং ফাঁস হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গিত প্রদান করে যে, এর সঙ্গে রাশিয়া জড়িত ছিল, কিন্তু রাশিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপিত হয়নি। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ একে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে দুর্বল করার জন্য রাশিয়ার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
৮ ফেব্রুয়ারি সোচিতে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের সময় ইয়ানুকোভিচ পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল, সেই প্রসঙ্গে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু ধারণা করা হয়, ইউক্রেনের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সচল করার জন্য ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ার কাছ থেকে ইতিপূর্বে উল্লিখিত আর্থিক সহায়তা চাচ্ছিলেন। কিন্তু রাশিয়া এই সহায়তা প্রদান করার আগেই ইউক্রেনীয় সরকারের পালাবদল ঘটে।
সামগ্রিকভাবে, ইউরোমাইদান চলাকালে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল প্রধানত মৌখিক, নিয়ন্ত্রিত এবং সতর্ক। এ সময় ইউক্রেনীয় সরকারকে কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান এবং বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান ব্যতীত মস্কো ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে সেরকম কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। রুশ প্রচারমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইউরোমাইদানের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, কিন্তু পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা যেরকমভাবে ইউক্রেনে এসে ইউরোমাইদান কর্মীদের প্রতি খোলাখুলি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন, রুশ রাজনীতিবিদরা ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে সেরকম কিছু করেননি।
বস্তুত অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ইউক্রেনের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে নিজেদের একটি বিস্তৃত সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে তোলার জন্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র) যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছিল এবং ইউক্রেনীয় তরুণ সম্প্রদায়কে পশ্চিমামুখী করে তোলার জন্য যেসব বিস্তৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তার বিপরীতে রাশিয়া উপযুক্ত পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। ইউক্রেনীয় জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রুশপন্থী হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া তাদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে সংগঠিত করতে পারেনি এবং ইউরোমাইদানের বিরুদ্ধে পাল্টা বিস্তৃত মাত্রার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।
অবশ্য ইয়ানুকোভিচ ও ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’ দলের দুর্বলতাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইয়ানুকোভিচ ও ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’ উভয়েই প্রাথমিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে আগ্রহী ছিল, সুতরাং ইউরোমাইদান কর্মীরা যে তীব্রতার সঙ্গে রুশ–নেতৃত্বাধীন ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়কে অপছন্দ করত, ইউক্রেনীয় সরকার ঠিক ততটা তীব্রতার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অপছন্দ করতো না। ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’ দলের আদর্শিক ভিত্তি ছিল দুর্বল এবং দলটির আইনপ্রণেতাদের বড় একটি অংশ ইউক্রেনীয় নব্য অভিজাতদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে দলটির সদস্যরা ঢালাওভাবে দল থেকে পদত্যাগ করতে শুরু করে। সর্বোপরি, ইয়ানুকোভিচ ইউরোমাইদানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ে কখনোই দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারেননি এবং শক্ত হাতে ইউরোমাইদানকে দমন করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
এমতাবস্থায় কেবল সীমিত ও পরোক্ষ রুশ সহায়তার ভিত্তিতে টিকে থাকা ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না, এবং রাশিয়া ইউক্রেনীয় সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী ছিল না, কারণ ইউরোমাইদানের পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনীয় জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রুশবিরোধী হয়ে পড়েছিল এবং এমতাবস্থায় ইউক্রেনের রুশ সামরিক হস্তক্ষেপ একটি প্রলম্বিত ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সৃষ্টি করতে পারত। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া ইউরোমাইদানের সময়ে বহুলাংশে নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু এর ফলে ইউক্রেনে চলমান প্রক্সি যুদ্ধে পশ্চিমাবিশ্ব সাফল্য লাভ করে, এবং এটি পরবর্তীতে রাশিয়ার জন্য একটি বিপজ্জনক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
ইউরোমাইদানের ফলাফল
২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নাগাদ ইউক্রেনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটি ছোটখাট গৃহযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে। এমতাবস্থায় পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ক্রমবর্ধমান চাপ এবং পার্তিয়া রেহিওনিভ থেকে বিপুল সংখ্যক সদস্যের প্রস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ইয়ানুকোভিচ ইউরোমাইদানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ‘ইউক্রেনের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন সংক্রান্ত চুক্তি’তে স্বাক্ষরের বিষয়ে একমত হন। ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে ইয়ানুকোভিচ এবং ইউরোমাইদানের পক্ষে ইউরোমাইদান নেতা ক্লিচকো, আরসেনি ইয়াৎসেনিউক এবং ওলেহ তিয়াহনিবোক এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তদানীন্তন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক–ওয়াল্টার স্টাইনমায়ার, তদানীন্তন পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদোস্লাভ সিকোরস্কি এবং ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘মহাদেশীয় ইউরোপ বিভাগে’র প্রধান এরিক ফোর্নিয়ে এই চুক্তির সাক্ষী ছিলেন। তদানীন্তন রুশ মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার ভ্লাদিমির লুকিন রুশ রাষ্ট্রপতির বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে উক্ত চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান এবং চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। বস্তুত এই চুক্তি বাস্তবায়িত হবে বলে রাশিয়া মনে করেনি এবং এটি ছিল তাদের এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার কারণ।
এই চুক্তি অনুযায়ী ২ দিনের মধ্যে ২০০৪ সালের সংবিধানের পুনঃপ্রবর্তন, একটি নতুন সরকার গঠন, সাংবিধানিক সংস্কার এবং ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজনের কথা ছিল। তদুপরি, এই চুক্তি অনুযায়ী কিয়েভের কেন্দ্রবিন্দু থেকে ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীদের প্রত্যাহার করে নেয়া এবং ইউরোমাইদান কর্মীদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিকট সকল অবৈধ অস্ত্র জমা দেয়ার কথা ছিল। একই দিনে ইউক্রেনীয় আইনসভায় ২০০৪ সালের সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়, সকল গ্রেপ্তারকৃত ইউরোমাইদান কর্মীকে মুক্তি প্রদান করা হয় এবং কিয়েভের কেন্দ্রবিন্দু থেকে নিরাপত্তারক্ষীদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কিন্তু ইউরোমাইদানের উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশ, যাদের নেতৃত্বে ছিল দিমিত্রো ইয়ারোশের অধীনস্থ ‘প্রাভিই সেক্তর’, এই চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ঘোষণা করে যে, পরবর্তী দিন সকালের মধ্যে ইয়ানুকোভিচ পদত্যাগ না করলে তারা রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও আইনসভায় আক্রমণ চালাবে।
এমতাবস্থায় কিয়েভের পরিস্থিতি ইয়ানুকোভিচের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং সেদিন রাতেই তিনি, ইউক্রেনীয় আইনসভার স্পিকার ভলোদিমির রিবাক ও রাষ্ট্রপতি প্রশাসনের প্রধান আন্দ্রি ক্লুয়েভ কিয়েভ ত্যাগ করে খারকিভে চলে যান। ইয়ানুকোভিচের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি তার ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণের আশঙ্কা করছিলেন এবং এজন্য নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি কিয়েভ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। সেদিনই ইউরোমাইদান কর্মীরা ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ, আইনসভা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবনগুলোকে দখল করে নেয় এবং ইয়ানুকোভিচের তাৎক্ষণিক পদত্যাগের দাবি জানায়। তারা ঘোষণা করে যে, কিয়েভ সম্পূর্ণরূপে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে রয়েছে। এমতাবস্থায় ইয়ানুকোভিচ ইউরোমাইদান কর্মীদের কার্যক্রমকে সদ্য স্বাক্ষরিত চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি ইউরোমাইদান কর্মীরা ইউক্রেনীয় আইনসভার অধিনেশন আহ্বান করে এবং আইনসভার ৪৫০ জন সদস্যের মধ্যে প্রায় ৩৩৮ জন এই অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে অনেককে জোরপূর্বক অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় এবং অনেকে অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ভোট গণনার সময় তাদের ভোট গণনা করা হয়। অর্থাৎ, পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল বিতর্কিত। এমতাবস্থায় তারা ওলেক্সান্দর তুর্চিনভকে আইনসভার নতুন স্পিকার নির্বাচন করে এবং আরসেন আভাকভকে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করে। ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনীয় টেলিভিশনে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করেন যে, তিনি পদত্যাগ করবেন না এবং আইনসভার নতুন সিদ্ধান্তগুলোও অনুমোদন করবেন না। তিনি আইনসভার সিদ্ধান্তগুলোকে ‘অবৈধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং ইউক্রেনে চলমান ঘটনাবলিকে ‘দস্যুবৃত্তি’ ও ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি আইনসভার নতুন স্পিকার তুর্চিনভ ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি ইয়ানুকোভিচের নাম ‘নিখোঁজ আসামী’দের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বস্তুত ইউক্রেনীয় সংবিধান অনুযায়ী, এটি ছিল একটি অসংবিধানিক সিদ্ধান্ত, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন ইউক্রেনীয় সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দনীয় প্রার্থী ইয়াৎসেনিউক ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং তার নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। ইয়ানুকোভিচ রুশ ‘স্পেৎসনাজে’র সহায়তায় ইউক্রেন ত্যাগ করে রাশিয়ায় গমন করেন এবং সেখান থেকে ইউক্রেনের নতুন সরকারের বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন।
ইউরোমাইদান কর্তৃক ক্ষমতা দখলের ফলে ইউক্রেনে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও চরম রুশবিরোধী সরকার ক্ষমতাসীন হয়। উক্ত সরকারটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের পাশাপাশি ইউক্রেনে বসবাসরত জাতিগত রুশদের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে তারা পশ্চিমা বিশ্বের সক্রিয় সমর্থন লাভ করে। সাধারণভাবে পশ্চিম ও মধ্য ইউক্রেনে নতুন সরকারের ক্ষমতা দখল ইতিবাচকভাবে গৃহীত হয় এবং উক্ত অঞ্চলে দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনে নতুন ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ইউরোমাইদান শুরুর পর থেকেই পূর্ব ইউক্রেনে ইউরোমাইদানবিরোধী মনোভাব বিস্তার লাভ করে এবং ইউরোমাদান কর্তৃক ইউক্রেনের শাসনক্ষমতা দখলের পর সেখানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমতাবস্থায় ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারে এবং ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে ন্যাটোকে ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ দিতে পারে, এই আশঙ্কায় রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ অধিকার করে নেয়। এদিকে পূর্ব ইউক্রেনে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমনের জন্য নতুন ইউক্রেনীয় সরকার সৈন্য প্রেরণ করে এবং তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য সেখানকার অধিবাসীরা স্থানীয় মিলিশিয়া গঠন করতে শুরু করে। দনবাস অঞ্চলে অবস্থিত দনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রদেশে স্থানীয় সরকারবিরোধীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং রুশ সহায়তায় ইউক্রেনীয় সরকার কর্তৃক প্রেরিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এভাবে আরম্ভ হয় দনবাস যুদ্ধ, যেটি এখন পর্যন্ত চলমান রয়েছে।
ইউরোমাইদানের সমর্থকদের ধারণা ছিল, ইয়ানুকোভিচের নেতৃত্বাধীন ইউক্রেনীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের যোগদানের পথ ইউক্রেনের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কার্যত সেরকম কিছুই ঘটেনি। তদানীন্তন ইউক্রেনীয় সরকারকে উৎখাত করার পর রাশিয়া ক্রিমিয়া অধিকার করে নিয়েছে এবং দনেৎস্ক ও লুহানস্ক স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, অর্থাৎ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে গুরুতর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই সংঘাত বজায় থাকা অবধি ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাটোর সদস্যপদ লাভের সম্ভাবনা সীমিত, কারণ রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সামরিক সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এমন কোনো রাষ্ট্রকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাটো নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নয়। অর্থাৎ, ইউরোমাইদান কার্যত ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তিকরণের সম্ভাবনাকে এগিয়ে আনেনি, উল্টো অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে।