হংকংয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকছে চীন?

নিজ দেশের জনগণের উপর নজরদারি ও বিরোধী মতকে কঠোরভাবে দমন করার জন্য চীনের কুখ্যাতি কারও অজানা নয়। রাজনৈতিকভাবে এক দলের দেশ হওয়ায় সেখানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিপরীত মতকে কোনোভাবেই সহ্য করা হয় না। উইঘুর মুসলিমদের উপর যেভাবে চীন নজরদারি ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালাচ্ছে প্রতিনিয়ত, তা কোনো সভ্য দেশের নীতি হতে পারে না। পশ্চিমা বিশ্বের তুমুল সমালোচনা সত্ত্বেও চীন তার অমানবিক রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, থোড়াই কেয়ার করছে শক্তিধর দেশগুলোর সমালোচনাকে।

১৯৯৭ সালে হস্তান্তর করার পর থেকে হংকং চীনের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা নিয়ে আছে। ‘এক দেশ দুই নীতি’ দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় হংকং চীনের অংশ হওয়ার পরও চীনা মূল ভূখন্ডের তুলনায় বাড়তি বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করে, ফলে তার একটি স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক পুঁজিবাদী দেশই হংকংকে চীনের কর্তৃত্ববাদী আচরণে ক্ষত-বিক্ষত না হওয়া একটি স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে বিশ্বাস করে এসেছে এতদিন। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ থাকার কারণে এখানে প্রচুর বিনিয়োগ করে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা। চীনের অর্থনীতির পাগলা ঘোড়া যেভাবে ছুটছে, তাতে হংকংয়ের অবদান নেহায়েত কম নয়।

Sbvsbvsvs
হংকং এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত জায়গাগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে;
image source: topuniversities.com

গত বছরের শেষ দিক থেকে হংকং বেশ আলোচনায় ছিল। চীনা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অধিক গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনকারী হংকংয়ের জনগণ সমর্থন পায় পুরো বিশ্বের কাছে। চীনের প্রতি অনুগত হংকংয়ের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর সবসময়ের মতো অমানবিকতা প্রদর্শন করেছিল। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সত্ত্বেও হংকংয়ের আন্দোলনকারীরা রাজপথ থেকে সরে আসেননি। সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন, চীনের অনুগত হংকংয়ের পুতুল শাসকদের চাপের মুখে রেখেছেন।

হংকংয়ের আন্দোলন দমন করা চীনের দিক থেকে তার জাতীয় স্বার্থের জন্য খুবই জরুরি, এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থনৈতিকভাবে হংকংয়ের বিপুল সুবিধা থাকায় চীনকে যেকোনো মূল্যেই হংকংয়ের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হয়। বিদেশি বিনিয়োগের তীর্থভূমি হিসেবে হংকংয়ের খ্যাতি বিশ্বজুড়েই সমাদৃত। বিনিয়োগ অব্যহত রাখার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আবশ্যিক পূর্বশর্ত। অধিক গণতন্ত্রের দাবিতে হংকংয়ের জনগণ চীনের আধিপত্যশীল চোখে যেভাবে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ তৈরি করেছে সেটি দমনের জন্য চীন আইনগত পদক্ষেপ নেবে, এটা খুবই প্রত্যাশিত।

হংকংয়ের নিজস্ব একটি তুলনামূলক স্বাধীন বিচারব্যবস্থা থাকলেও সেখানকার যে ছোট সংবিধান বা ‘বেসিক ল’ রয়েছে, তাতে একটু ত্রুটি রয়েছে। বেসিক ল-তে বলা হয়েছে, চীন চাইলে হংকংয়ের জন্য যেকোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে। এক্ষেত্রে হংকংয়ের জনগণ কিংবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কারোরই মতামত নেয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। সাদা চোখেই বোঝা যায়, চীনের কর্তৃত্ববাদিতা জারি রাখার জন্য এটি যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে।

Hduxycuc
হংকংয়ের ছোটো আকারের সংবিধান ‘বেসিক ল’; image source: chinaplus.cri.in

বেইজিং অনেক দিন ধরেই হংকংকে একটি কার্যকর ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইন’ তৈরিতে চাপ দিয়ে আসছে। হংকংয়ের ‘বেসিক ল’ নামের যে ক্ষুদ্র সংবিধান আছে, সেখানেও একটি কার্যকর জাতীয় নিরাপত্তা আইন তৈরির কথা বলা হয়েছে। হংকংয়ের নির্বাহী কর্মকর্তারা অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রনয়ণ করতে, কিন্তু জনগণের প্রবল বিরোধিতায় সেটি আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। “জনমতের চাপে হংকংয়ের প্রশাসনিক ব্যক্তিদের পক্ষে নিজ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা আইন সম্ভব নয়”– এটি ভেবে চীন নিজেই কোমর বেধে নেমেছিল হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন তৈরি করতে। চীনের প্রণয়ন করা হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন চীনের ‘রাবার স্ট্যাম্প’ পার্লামেন্টে পাস হয়ে ইতোমধ্যে কার্যকরও শুরুও হয়ে গিয়েছে ১লা জুলাই থেকে।

শুনতে অদ্ভুত শোনালেও সত্যি, হংকংয়ের জন্য যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে হংকংয়ের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সম্মতি নেয়া তো দূরে থাক, জাতীয় নিরাপত্তার মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত এই আইনের খসড়াও পড়ে দেখার সুযোগ দেয়া হয়নি তাদের। এমনকি হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যারি লামকেও দেখতে দেয়া হয়নি। খুব গোপনীয়তার সাথে চীনা পার্লামেন্টে আইনটি পাস হওয়ার পর সবাই আইনটি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। অতীতে হংকংয়ের প্রশাসনিক ব্যক্তিরা যেভাবে জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রণয়নে জনগণের বাধার মুখে পড়েছেন, সেটি ভালোভাবেই বিবেচনা করেছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি।

নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইনের ফলে চীন হংকংয়ে একটি জাতীয় নিরাপত্তা অফিস স্থাপনের অধিকার লাভ করেছে। এই অফিসের কর্মকর্তারা চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে নিয়োগ লাভ করবেন। আর তাদের কাজ হবে আইনটির প্রয়োগ ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা। হংকংয়ের আইনের অধীনে তারা থাকবেন না। অর্থাৎ হংকংয়ে অবস্থান করলেও হংকংয়ে কোনো আইন তাদের উপর বলবৎ করা হবে না।

এছাড়াও নতুন এই আইনের অধীনে হংকং একটি নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি গঠন করতে বাধ্য থাকবে, যেখানে বেইজিং একজন উপদেষ্টাকে নিয়োগ দেবে। নিয়োগপ্রাপ্ত উপদেষ্টার কোনো সিদ্ধান্তকে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না কেউ। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চীনের মূল ভূখন্ডে আইনের লঙ্ঘনের ফলে সৃষ্ট অপরাধের বিচার হবে।

চার ধরনের অপরাধের কথা চীনের প্রণয়ন করা এই জাতীয় নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে। এই অপরাধগুলোর মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসবাদ, বিদেশের সাথে যোগসাজশ, দেশের সাথে সম্পর্ক ভঙ্গ ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কাজে জড়ানো। এসব অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। যেসব ব্যক্তি আইনের উল্লেখকৃত অপরাধের সাথে জড়িত আছেন বলে প্রমাণিত হবে, তারা সরকারি চাকরিতে বহাল থাকতে পারবেন না। যদি কোনো কোম্পানি আইন ভঙ্গ করেছে বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে বিরাট অংকের জরিমানার বিধান রয়েছে।

Nsnsbsb
নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইনের ফলে হংকংয়ের গণযোগাযোগের অনেক মাধ্যমেই সেন্সরশিপ আরোপিত হবে;
image source: apc.org

বেইজিং বলছে, এই আইন প্রবর্তনের ফলে হংকংয়ের জনগণের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারগুলোর কোনো লঙ্ঘন হবে না, বরং জাতীয় নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইন হংকংয়ের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকার চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। রাজনৈতিকভাবে এতদিন ধরে হংকংয়ের নাগরিকেরা যেভাবে চীনের আধিপত্যবাদের অনুগত শাসকশ্রেণীর বিরোধিতা করে এসেছেন, তা এই আইনের ফলে এখন থেকে আর সম্ভব নয়। শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে অনেক রাজনৈতিক কার্যক্রমই এখন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যেহেতু যাবজ্জীবন কারাদন্ড রাখা হয়েছে, তাই রাজনৈতিক কর্মীরা এখন থেকে ভয়ে ভয়েই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।

চীনের মূল ভূখন্ডের আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক নীতি হংকংয়ে সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে এই আইন– এরকমটা ভাবছেন কেউ কেউ। চীনে যেভাবে মিডিয়াগুলোকে সেন্সরশিপ দিয়ে অনেক সত্য প্রকাশে বাধা দেয়া হয়, নতুন এই আইনে হংকংয়ের মিডিয়াগুলোরও সেই পরিণতি হবে। বিশেষ করে অধিক গণতন্ত্রের দাবিতে কোনো কিছুই আর স্বাধীনভাবে প্রচার করতে পারবে না হংকংয়ের মিডিয়া, ‘দেশদ্রোহিতা’ অপরাধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে।

Sbsbsbbs

সহিংস আন্দোলনগুলোকে এখন দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হবে এবং বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে; image source: npr.org

চীন হংকংয়ের জনগণের নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করছেন বলে এতদিন ধরে আন্দোলনকারীরা যে আন্দোলন করে আসছিলেন, তা সহিংসতায়ও রূপ নিতে খুব বেশি দেরি হয়নি। অনেক আন্দোলনকারী সরকারের উপর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দোকান লুট করেছিলেন, পুলিশ স্টেশনগুলোতে হামলা চালিয়েছিলেন, সরকারি যানবাহনে আগুন লাগিয়েছিলেন। কিন্তু নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইনের ফলে এগুলো সন্ত্রাসবাদ ও সরকারি সম্পত্তির বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কাজে জড়ানোর মতো অপরাধের এখতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত হবে, যেগুলোর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড পর্যন্ত হতে পারে।

এই আইনের দ্বারা চীন পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোকেও একটি বার্তা দিয়ে রাখলো। হংকংয়ের জনগণের আন্দোলনকে শুরু থেকেই চীন একটি বিদেশি সাহায্যপ্রাপ্ত চক্রান্ত, চীনের জাতীয় নিরাপত্তা বিনষ্ট করা ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপদে ফেলতে আমেরিকার চক্রান্ত হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা চালিয়েছে। চীন শুরু থেকেই মনে করছে হংকংয়ের সরকারবিরোধীদের উস্কে দেয়া পিছনে বিদেশিদের হাত আছে, যারা চীনের রাজনৈতিক ভারসাম্যে নেতিবাচক পরিবর্তন আনতে চায়। এই আইনের এখতিয়ারে এখন সেসব বিদেশী ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত হবেন, যারা হংকংয়ের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন। এই আইনের মাধ্যমে চীন তার পশ্চিমা শত্রুদেরগুলোর প্রতি একটি বার্তা দিয়ে রাখলো, “তোমরা যাদেরকে দিয়ে চীনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিবর্তন করতে চাও, তাদেরকেই দমন করার জন্য আইন প্রণয়ন করে ফেলা হয়েছে। তোমাদের ইচ্ছা কখনোই পূরণ হবে না।

হংকংয়ের জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে এই জাতীয় নিরাপত্তা আইনের প্রবর্তন একটি কালো অধ্যায় যোগ করলো। রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা জনগণের অধিকার, এটা কেড়ে নিলে জনকল্যাণের যে উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি পরিচালিত হয়, তা আর থাকে না। রাষ্ট্রের কাছে জনগণকে নিপীড়নের জন্য রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী, আর সশস্ত্র বাহিনীর অমানবিক কাজকে বৈধতা দেয়ার জন্য রয়েছে আইন। আইনের অপব্যবহার কখনই কাম্য নয়। ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইন’ এর মতো একটি সুন্দর নামের আড়ালে যে কালো, নিপীড়নবাদী আইন চীন প্রবর্তন করলো, তা হংকংয়ের সরকারবিরোধী জনগণ কীভাবে প্রতিরোধ করে সেটিই দেখবার বিষয়।

Related Articles

Exit mobile version