২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর এবং বিশেষত ২ আগস্টে মার্কিন আইনসভার নিম্নকক্ষ ‘হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস’–এর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান (আনুষ্ঠানিক নাম ‘চীন প্রজাতন্ত্র’) সফরের পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, চীন (আনুষ্ঠানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’) ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হতে পারে। অবশ্য এখন পর্যন্ত চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়নি এবং তাইওয়ানের সন্নিকটে সামরিক মহড়া পরিচালনার মধ্যে চীন তাদের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ রেখেছে। কিন্তু ভবিষ্যতে চীন যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাইওয়ানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে না, এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। উল্লেখ্য, তাইওয়ান (চীন প্রজাতন্ত্র) প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র, যেটি ১৬৮টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এবং যেটির ৯৯% ভূখণ্ড তাইওয়ান দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত।
চীন ও তাইওয়ানের মধ্যবর্তী সম্পর্ক বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ১৬৮৩ সালে চীনকেন্দ্রিক ‘মহান চিং রাষ্ট্র’ (চিং সাম্রাজ্য) তাইওয়ান দখল করে নেয় এবং পরবর্তী দুই শতাব্দী তাইওয়ান চীনা নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। ১৮৯৪–৯৫ সালের চীনা–জাপানি যুদ্ধে জাপানের নিকট চীনের পরাজয়ের পর চীন তাইওয়ানকে জাপানের কাছে হস্তান্তর করে এবং পরবর্তী অর্ধ শতাব্দী তাইওয়ান জাপানি নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির নিকট জাপানের পরাজয়ের পর জাপান তাইওয়ানকে চীনের কাছে প্রত্যর্পণ করে। এদিকে ১৯৪৯ সাল নাগাদ চীনা জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ‘চীন প্রজাতন্ত্র’ চীনা গৃহযুদ্ধে চীনা কমিউনিস্টদের কাছে পরাজিত হয় এবং ‘চীন প্রজাতন্ত্রে’র সরকার ও সশস্ত্রবাহিনী চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে পশ্চাৎপসরণ করে তাইওয়ানে আশ্রয় নেয়।
এরপর চীনা কমিউনিস্টদের দ্বারা চীনের মূল ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’ নিজেকে তাইওয়ানসহ সমগ্র চীনের একক প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করতে থাকে। অন্যদিকে, তাইওয়ানকেন্দ্রিক ‘চীন প্রজাতন্ত্র’ নিজেকে সমগ্র চীনের একক প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করতে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের দাবিই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং বিশ্বমঞ্চে ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোয় গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তাইওয়ানকে নিজেদের একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং ভূখণ্ডটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে, মাত্র ১৪টি রাষ্ট্র চীন প্রজাতন্ত্রের/তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব বর্তমানে তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না, কিন্তু চীনা–মার্কিন ও চীনা–পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে তারা তাইওয়ানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে।
বস্তুত ১৯৪৯ সাল থেকে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান এবং ১৯৫৪–১৯৫৫, ১৯৫৮ ও ১৯৯৫–১৯৯৬ সালে তাদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হওয়ার গুরুতর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কোনো যুদ্ধ হয়নি। ২০২২ সালে এসে আবার নতুন করে অনুরূপ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’ অনুসারে, চীন বর্তমান বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সামরিক শক্তি, আর উক্ত তালিকায় তাইওয়ানের অবস্থান ২১তম। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, চীনের পক্ষে তাইওয়ানকে যুদ্ধে পরাজিত করা খুব একটা কঠিন হবে না। কিন্তু চলমান রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি থেকে এটি স্পষ্ট যে, কেবল সামরিক সরঞ্জামের দিক থেকে এগিয়ে থাকলেই যে কোনো রাষ্ট্র সহজে যুদ্ধ জয় করতে পারবে, এরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। যুদ্ধে সাফল্য/ব্যর্থতার সঙ্গে আরো বহুসংখ্যক বিষয় জড়িত। সুতরাং চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে চীন যে সহজেই বিজয়ী হতে পারবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
প্রথমত, ১৯৮০–এর দশকের পর থেকে চীনা সশস্ত্রবাহিনী (আনুষ্ঠানিক নাম ‘গণমুক্তি ফৌজ’) কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। বস্তুত ২০২০ সালে ভারতের বিরুদ্ধে একটি ক্ষুদ্র সীমান্ত সংঘাত ছাড়া বিগত তিন দশকে চীন কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য সশস্ত্র সংঘাতে জড়ায়নি। অর্থাৎ, চীনা সশস্ত্রবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের বাস্তবিক সামরিক অভিজ্ঞতা অত্যন্ত সীমিত। সুতরাং, চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে চীনা অফিসার ও সৈন্যদেরকে সম্পূর্ণ অজানা একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রের অতি কঠিন বাস্তবতার মধ্যে প্রকৃত সামরিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। তাইওয়ানের বিরুদ্ধে দ্রুত বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, তাইওয়ান দ্বীপ তাইওয়ান প্রণালীর মাধ্যমে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। সুতরাং চীন যদি তাইওয়ান দ্বীপের ভূখণ্ডে সৈন্য প্রেরণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে চীনা নৌবহরকে উক্ত প্রণালী অতিক্রম করে তাইওয়ানের উপকূল পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে তাইওয়ান দ্বীপের ভূখণ্ডের যে অংশটি সবচেয়ে কাছাকাছি, সেখান থেকেও চীনের মূল ভূখণ্ডের দূরত্ব ১২৮ কিলোমিটার। তাইওয়ানে সৈন্য প্রেরণের ক্ষেত্রে চীনা নৌবহরকে তাইওয়ান দ্বীপের যেসব বন্দরে পৌঁছাতে হবে, চীনা মূল ভূখণ্ড থেকে সেগুলোর দূরত্ব আরো বেশি।
চীন বিপুল সংখ্যক পরিবহন বিমান ব্যবহার করে আকাশপথে অল্প কয়েক হাজার সৈন্যকে তাইওয়ান দ্বীপের ভূখণ্ডে প্রেরণ করতে পারবে ও তাদের রসদপত্র সরবরাহ করতে পারবে, কিন্তু তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সেটি পর্যাপ্ত হবে না। তাইওয়ান অধিকার করতে হলে চীনকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করতে হবে এবং নৌপথ ব্যতীত অন্য কোনো পথে তাদেরকে তাইওয়ানে প্রেরণ করা সম্ভব হবে না। তদুপরি, উক্ত সৈন্যদের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক যান, আর্টিলারি, গোলাবারুদ, খাদ্য, জ্বালানি, চিকিৎসা সামগ্রী প্রভৃতিও নৌপথে সরবরাহ করতে হবে।
এই বিপুল সংখ্যক সৈন্য ও বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ও রসদপত্র তাইওয়ানে প্রেরণের জন্য শত শত জাহাজ প্রয়োজন হবে এবং এই বিরাট নৌবহরকে তাইওয়ান প্রণালী অতিক্রম করতে হবে। চীনা নৌ ও বিমানবাহিনী উক্ত নৌবহরের সুরক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, কিন্তু নৌবহরটি দীর্ঘ সময় খোলা সমুদ্রে থাকবে। সেসময় তাইওয়ানিরা আকাশপথে আক্রমণ চালিয়ে, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এবং সাবমেরিনের মাধ্যমে আক্রমণ চালিয়ে উক্ত নৌবহরটির উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে পারবে। অর্থাৎ, চীনা সৈন্যরা তাইওয়ান দ্বীপের ভূখণ্ডে পৌঁছানোর আগেই ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
তৃতীয়ত, তাইওয়ান দ্বীপের ভূখণ্ডে অবতরণের জন্য চীনা সৈন্যদেরকে তাইওয়ানের সমুদ্রবন্দরগুলো দ্রুতগতিতে ও তুলনামূলকভাবে কার্যকর অবস্থায় অধিকার করতে হবে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের সময় তাইওয়ানিরা উক্ত সমুদ্রবন্দরগুলোয় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এর ফলে একদিকে যেমন চীনা সৈন্যদের জন্য উক্ত বন্দরগুলো দ্রুতগতিতে অধিকার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, অন্যদিকে উভয় পক্ষের তীব্র লড়াইয়ে বন্দরগুলোর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে চীনা সৈন্যদের জন্য তাইওয়ান দ্বীপের ভূখণ্ডে অবতরণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
চতুর্থত, তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে চীনা সৈন্যদেরকে তাইওয়ানের বিমানবন্দর ও বিমানঘাঁটিগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে এবং সেখানে চীনা পরিবহন বিমানগুলোর অবতরণের আগ পর্যন্ত সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হবে। কিন্তু তাইওয়ানি সশস্ত্রবাহিনী এরকম পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সুতরাং ধরে নেয়া যেতে পারে যে, তাইওয়ানি বিমানবন্দর ও বিমানঘাঁটিগুলো অধিকার করা চীনা সৈন্যদের জন্য সহজ হবে না এবং এক্ষেত্রে কঠিন প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে পারে। তদুপরি, এরকম লড়াইয়ে বিমানবন্দর ও বিমানঘাঁটিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পঞ্চমত, বর্তমান যুগে যে কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাফল্য অর্জনের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে এয়ার সুপেরিয়রিটি অর্জন করা আবশ্যক এবং এজন্য যুদ্ধের শুরুতেই রাষ্ট্রগুলো প্রতিপক্ষের বিমানবাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। সুতরাং এটি ধরে নেয়া যায় যে, যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে চীনারা তাইওয়ানি বিমানবাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালাবে। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হবে কিনা, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। তাইওয়ানি বিমানবাহিনীতে প্রায় ৭৫০টি বিমান রয়েছে এবং একসঙ্গে এগুলোর সবগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করা ও ধ্বংস করে দেয়া এমনিতেই যথেষ্ট কঠিন কাজ। তাইওয়ানি বিমানবাহিনীর গ্রাউন্ড ক্রুরা অত্যন্ত সুপ্রশিক্ষিত এবং ক্ষিপ্রগতিতে ক্ষতিগ্রস্ত যুদ্ধবিমান ও রানওয়ে মেরামত করতে সক্ষম। তদুপরি, তাইওয়ানি বিমানবাহিনী এখন তাদের বিমানগুলোকে তাইওয়ানের পার্বত্য অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ বিমানঘাঁটিগুলোয় সুরক্ষিত রেখেছে।
তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেইয়ের কাছে একটি পর্বতের নিচে হেং শান মিলিটারি কমান্ড অবস্থিত এবং এটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে অবস্থিত মার্কিন ইন্দো–প্যাসিফিক কমান্ডের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। মার্কিন আর্লি ওয়ার্নিং রাডার, কৃত্রিম উপগ্রহ ও গোয়েন্দা বিমানগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি সরাসরি সেখানে পৌঁছে যায়, সুতরাং চীন আকস্মিকভাবে তাইওয়ানি বিমানবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালালেও তাইওয়ানিরা সেই সম্পর্কে আগেই জানতে পারবে। তাইওয়ান জুড়ে এরকম বেশ কয়েকটি বিকল্প কমান্ড সেন্টার রয়েছে, কাজেই এরকম একটি কেন্দ্র ধ্বংস হলেও অন্যান্য কেন্দ্র কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। সুতরাং, যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে চীনাদের পক্ষে পুরো তাইওয়ানি বিমানবাহিনীকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে কিনা, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ।
তাইওয়ানি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তেমন শক্তিশালী নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সেটিকে ধ্বংস করা একেবারে সহজ কাজ হবে না। সুতরাং, চীনা বিমানবাহিনীর পক্ষে তাইওয়ানের আকাশে মুক্তভাবে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। তদুপরি, তাইওয়ানি বিমানবাহিনীতে রয়েছে দুই শতাধিক মার্কিন–নির্মিত ‘এফ–১৬ ফাইটিং ফ্যালকন’ ও ফরাসি–নির্মিত ‘মিরেজ–২০০০’ যুদ্ধবিমান। যদি চীনারা যুদ্ধের শুরুতেই তাইওয়ানি বিমানবাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে না পারে, সেক্ষেত্রে এগুলো চীনা বিমানবাহিনীর জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সামগ্রিকভাবে, সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে চীনের জন্য তাইওয়ানের বিরুদ্ধে এয়ার সুপেরিয়রিটি অর্জন করা কঠিন হবে। আর চীন যদি এয়ার সুপেরিয়রিটি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।
ষষ্ঠত, তাইওয়ানের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলো চীনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে তাদেরকে সুবিধা প্রদান করবে। তাইওয়ান দ্বীপের ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য একটি অংশে ঘন জঙ্গলে আবৃত পার্বত্য অঞ্চল অবস্থিত। পার্বত্য অঞ্চলটির পশ্চিমে উর্বর সমভূমি অবস্থিত এবং সেখানে রাজধানী তাইপেই–সহ তাইওয়ানের বড় বড় শহরগুলোর অবস্থান। তাইওয়ান দ্বীপের পশ্চিমাংশে বহুসংখ্যক নদী ও খাল রয়েছে। এর ফলে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে চীনা সৈন্যদের জন্য ক্ষিপ্রগতিতে তাইওয়ানের অভ্যন্তরে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। বিশেষত এই সম্ভাবনা রয়েছে যে, তাইওয়ানি শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য চীনা সৈন্যদেরকে রক্তাক্ত ও প্রলম্বিত শহুরে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে।
তদুপরি, তাইওয়ান দ্বীপ ‘চীন প্রজাতন্ত্রে’র একমাত্র ভূখণ্ড নয়। তাইওয়ান দ্বীপের আশেপাশের ১৬৭টি দ্বীপ চীন প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু দ্বীপপুঞ্জ (যেমন: মাৎসু, কিনমেন প্রভৃতি) চীনের মূল ভূখণ্ডের একেবারে কাছে অবস্থিত। অন্যদিকে, পেংহু দ্বীপপুঞ্জ তাইওয়ান দ্বীপের কাছে অবস্থিত ৯০টি ছোট–বড় দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত একটি উপদ্বীপ। তাইওয়ানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে এই দ্বীপগুলো চীনা সৈন্যদের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই দ্বীপগুলো অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং বড় দ্বীপগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাহাজ–বিধ্বংসী ও বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, আর্লি ওয়ার্নিং রাডার সিস্টেম ও সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য রয়েছে।
এই দ্বীপগুলোতে মোতায়েনকৃত সৈন্যরা সম্ভাব্য চীনা আক্রমণের সময় চীনা নৌবহরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারবে এবং চীনা জাহাজগুলো তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই সেগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করতে পারবে। এজন্য যুদ্ধের শুরুতেই চীনাদের এই দ্বীপগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রয়োজন হবে এবং এগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য তাদের হাজার হাজার কমান্ডোর প্রয়োজন হবে। সামগ্রিকভাবে, সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে তাইওয়ানের ভৌগোলিক অবস্থান অগ্রসরমান চীনা সৈন্যদের জন্য বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করবে।
সর্বোপরি, চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তাইওয়ানি অভিজাত শ্রেণি, সশস্ত্রবাহিনী ও জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সেটির ওপর যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বহুলাংশে নির্ভর করবে। যদি তাইওয়ানিরা চীনাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে চীনাদের জন্য এই যুদ্ধ জয় করা মারাত্মক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে এবং তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। তদুপরি, চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো চীনের সঙ্গে তাদের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে তাইওয়ানকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করবে। এমতাবস্থায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। কিন্তু সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে তাইওয়ানিদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সেটি অনিশ্চিত এবং খুব সম্ভবত সত্যিকার যুদ্ধ না হলে এটি সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব হবে না।
অর্থাৎ, চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের ক্ষেত্রে চীনকে বহুসংখ্যক সামরিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, সামরিক শক্তির দিক থেকে চীন তাইওয়ানের চাইতে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী এবং এজন্য তাইওয়ান যদি একাকী চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, সেক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তাইওয়ান চীনের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবে, এরকম সম্ভাবনা কম। শেষ পর্যন্ত চীন তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে, এরকমটিই ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাইওয়ানিরা প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলে সেক্ষেত্রে চীনাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে এবং তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে।