বর্তমান যুগটাই হলো অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার যুগ। তার প্রজন্মের অন্য অনেক কিশোর-কিশোরীই ভাইরাল হয়েছে মজাদার টিকটক ভিডিও বানিয়ে, ইউটিউবে কাপ সং গেয়ে, কিংবা ইনস্টাগ্রামে মেক-আপ টিউটোরিয়াল আপলোডের মাধ্যমে। অনলাইনের কল্যাণেই ভাইরাল হয়েছেন ১৬ বছর বয়সী সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থানবার্গও। কিন্তু তার কাহিনী কিছুটা আলাদা। তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন কিশোরীসুলভ কোনো কাজের মাধ্যমে নয়, বরং বিশ্বনেতাদের মুখে ঝামা ঘষে দেয়ার মতো এক বক্তৃতার মাধ্যমে।
গ্রেটার খ্যাতির শীর্ষে পৌছানোয় বড় অবদান রাখা সেই বক্তৃতার ভিডিওটির আবির্ভাব ঘটে এ বছরের জানুয়ারিতে। বার্ষিক ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে উপস্থিত শীর্ষ নেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন,
“কিছু মানুষ বলেন, আমরা সবাই মিলে নাকি জলবায়ু সংকট তৈরি করেছি। কিন্তু সেটি সত্যি নয়। যদি কোনো একজন অপরাধী হয়, তার জন্য সবাইকে দায়ী করা উচিত নয়। যারা অপরাধী, তাদেরকেই দায়ী করতে হবে। আর জলবায়ু সংকটের পেছনে দায়ী হলো কিছু মানুষ, কিছু প্রতিষ্ঠান, এবং কিছু নীতি-নির্ধারক, যারা খুব ভালো করেই জানেন অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে তারা পৃথিবীর কী ভীষণ ক্ষতি করে চলেছেন। এবং আমার বিশ্বাস, সেইসব মানুষদের মধ্যে অনেকেই আজ এখানে উপস্থিত আছেন।”
সেদিন সবার সামনে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন চিত্তে বলা কথাগুলোর কল্যাণে গ্রেটা আজ শুধু বিশ্বব্যাপী পরিচিত নামই নয়, পাশাপাশি তিনি পেয়ে গিয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মনোনয়নও। নরওয়ের তিনজন সংসদ সদস্য নোবেল কর্তৃপক্ষের কাছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য গ্রেটার নাম প্রস্তাব করেছেন।
এ প্রসঙ্গে নরওয়ের সমাজতান্ত্রিক সংসদ সদস্য ফ্রেডি আন্দ্রে অভস্তেগার্ড বলেন,
“আমরা গ্রেটা থানবার্গের নাম প্রস্তাব করেছি, কারণ আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কিছু না করি, তাহলে এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, সংঘাত এবং শরণার্থী সংকট বেড়ে যাবে। গ্রেটা থানবার্গ একটি গণ আন্দোলনের সূচনা করেছেন, যেটিকে আমি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি বড় অবদান হিসেবে দেখছি।”
ঠিক কী আন্দোলন করছেন গ্রেটা?
অনেকেই ভাবতে পারেন, স্রেফ একটি ভাইরাল ভিডিওর কারণেই হয়তো নোবেলের জন্য মনোনয়ন পেয়ে গেছেন গ্রেটা। সেটি ভুল ধারণা। জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী সবার নজর কেড়েছেন বটে, কিন্তু লড়াইটা তিনি শুরু করেছেন আরো আগে থেকেই।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে স্কুল বাদ দিয়ে টানা তিন সপ্তাহ সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে বসে থাকেন গ্রেটা। এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, সেজন্য প্রতিবাদ। তিনি তার কর্মকাণ্ডের কথা ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে পোস্ট করেন, এবং তখন থেকেই ক্রমান্বয়ে জনমত তৈরি করতে থাকেন।
এরপর, সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ঘোষণা দেন প্রতি শুক্রবার তিনি সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন, যতদিন পর্যন্ত না তারা তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার ব্যাপার অঙ্গীকার দেয়। উল্লেখ্য, তার এই প্রস্তাবের সাথে ফ্রান্সের প্যারিস চুক্তির সাদৃশ্য রয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত গ্রেটার সবচেয়ে বড় আন্দোলনটি হয়েছে ১৫ মার্চ, শুক্রবার। এই আন্দোলনের নাম রাখা হয়েছে ‘ফ্রাইডেস ফর দ্য ফিউচার’।
ফ্রাইডেস ফর দ্য ফিউচার
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে #FridaysForFuture ট্রেন্ডের মাধ্যমে স্কুলগুলোতে বিক্ষোভের আয়োজন করেছেন গ্রেটা, যেটি প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৫ মার্চ। এদিন তার ডাকে সাড়া দিয়ে জার্মানি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ ১০৫টি দেশের ১,৬৫৯টি স্থানে শিক্ষার্থীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ ও মিছিল করেছে।
ইতিমধ্যেই গ্রেটার ডাকা এ বিক্ষোভ কর্মসূচি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে রাস্তায় নামবে, এ বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না রক্ষণশীল অনেক মানুষই। তবে কেউ কেউ আবার এটিকে কেবল নৈতিকই নয়, সম্পূর্ণ যৌক্তিক বলেও মনে করছে। তাদের মতে, বর্তমানে অবস্থা যতটা সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে, তাতে এ ধরনের আন্দোলনের প্রয়োজন আছে।
এ বিষয়ে দ্য কনভার্সেশনে দার্শনিক রুপার্ট রিড লিখেছেন,
“বিষয়টি যখন জলবায়ু পরিবর্তন, আমাদের প্রাপ্তবয়স্কদের এখন বোঝা দরকার যে আমাদের এখন আর সেই অবস্থা নেই যে বাচ্চাদেরকে বলব তাদের কী করা উচিত বা উচিত না। আমাদের এই আন্দোলনে এ কারণেই সমর্থন জানানো উচিত যে, এতদিন আমাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই এখন আমরা এ ব্যাপারে কিছু বলবার মতো নৈতিক অধিকার হারিয়েছি।”
যদি গ্রেটা নোবেল জেতেন…
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল জয়ের রেকর্ডটি রয়েছে পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের দখলে। ২০১৪ সালে যখন নারী অধিকার ও শিক্ষার জন্য কাজ করার ফলে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন, তখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর। তাই যদি গ্রেটা এ বছর নোবেল জেতেন, মালালাকে টপকে তিনি পরিণত হবেন ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ীতে।
গ্রেটার নোবেল জয়ের সম্ভাবনা কতটুকু?
মনোনয়ন পেয়েছেন বলেই যে গ্রেটা নোবেল জিততে পারবেন, এমনটি বলার কোনো উপায় নেই। কারণ গ্রেটার প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। নোবেল কমিটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২০১৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন প্রাপ্তির সংখ্যা মোট ৩০১। এদের মধ্যে ২২৩ জন একক ব্যক্তি, এবং ৭৮টি সংগঠন। তবে কারো নামই তারা প্রকাশ করেনি। এমনকি গ্রেটার নামও না। তারা মনোনীতদের তালিকা প্রকাশ করবে ৫০ বছর পর।
গ্রেটাকে যারা মনোনীত করেছেন, তারা নিজেরা এমনটি দাবি করার ফলেই আমরা এ ব্যাপারে জানতে পেরেছি। রাজনৈতিক নেতা, সাবেক নোবেল লরেট, একাডেমিকসহ নোবেল কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেয়া শর্ত পূরণ করতে পারে, এমন যেকোনো ব্যক্তিই তাদের পছন্দের প্রার্থীর নাম নোবেল জয়ের জন্য প্রস্তাব করতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়ী কে হবে, সে সিদ্ধান্ত নোবেল কর্তৃপক্ষেরই। অক্টোবরে তারা বিজয়ীর নাম ঘোষণা করবে, এবং ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের রাজধানী অসলোতে বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে।
শেষ কথা
নিজেকে টুইটারে ‘১৬ বছর বয়সী অ্যাসপার্গার সিনড্রোমে আক্রান্ত জলবায়ু কর্মী’ হিসেবে পরিচয় দেয়া গ্রেটা টাইম ম্যাগাজিনের ২০১৮ সালের সবচেয়ে প্রভাবশালী কিশোর-কিশোরীদেরও একজন। এবং এখন নোবেলের জন্য মনোনীত হওয়ার মাধ্যমে তার সাফল্যের মুকুটে যোগ হলো আরো একটি পালক।
কিন্তু কী হবে, যদি গ্রেটা নোবেল জিততে না পারেন? তিনি কি হতাশ হয়ে পড়বেন? তার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বে? গ্রেটার কর্মকাণ্ড দেখে কিন্তু একদমই তা মনে হয় না। নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েও তিনি আবেগ-উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েননি। টুইটারে এ খবর জানিয়ে, এটিকে ‘বিশাল সম্মান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বটে এবং এজন্য কৃতজ্ঞতাও জ্ঞাপন করেছেন, কিন্তু এর আগে-পরে সকল পোস্টেই তিনি ১৫ মার্চের আন্দোলনকে সফল করার ব্যাপারেই কথা বলে গেছেন। নিজের প্রকৃত লক্ষ্য থেকে এক চুলও সরে যাননি তিনি।
নিজের কাজের প্রতি এমন অসাধারণ দায়বদ্ধতা যদি ধরে রাখতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে কেবল নোবেল পুরস্কারই নয়, আরো অনেক কিছুই অপেক্ষা করে থাকবে তার জন্য। বিশ্বকে অনাগত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষায় গ্রেটার মতো কিশোর-কিশোরীকে যে এখন বড্ড প্রয়োজন!
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/